ফারজানা নীলা: যে দুর্ঘটনা বার বার ঘটে সে দুর্ঘটনাকে মনে হয় মানুষ একসময় স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়। যেমন প্রায়ই খবরে পড়ি, ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু। আমার এক পরিচিত স্কুল পড়ুয়া মেয়ে, বছর দুয়েক আগে রিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে একটানে তার মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। কী ভয়ানক মৃত্যু!
ওড়না পরে যদি দুর্ঘটনায় মৃত্যুও হয় তবুও ওড়না পরতে হয়। কারণ এটি খুব মূল্যবান একটি ঢাকনা। এ দিয়ে নারীদেহের সবচেয়ে বড় উচ্চতা ঢেকে রাখা হয়। কেন ঢেকে রাখতে হয়? কারণ এটি ঢেকে না রাখলে মেয়েদের এই উচ্চতা দেখে অনেক ছেলের ঈমান নষ্ট হতে পারে, চোখ বার বার উচ্চতার দিকে যায়, বদ মতলব দেখা দেয় ছেলেদের মনে, খারাপ মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় মেয়েদের দিকে। সারমর্ম দাঁড়ায় ছেলেদের সমস্যার জন্যই মেয়েদের ওড়না পরতে হয়। অথচ শরীরটা কিন্তু মেয়েদের। এবং যদি কেউ ওড়না না পরে তবে সে খারাপ মেয়ে, বুক দেখাতে চায় ছেলেদের ইত্যাদি, আরও অনেক অশ্লীল কথার বন্যা বয়ে যায় চারিদিকে।
কেন বুকের উপর আমাকে অতিরিক্ত কাপড় জড়াতে হবে? শরীর ঢাকার জন্য যতোটুকু পোশাক পরতে হয় তা একটি কামিজ এবং একটি সালোয়ার দিয়ে খুব সুন্দরভাবে হয়ে যায়। এর উপর ওড়না কেন? কারণ আমার বুক উঁচু হয়ে থাকে তাই? আমার স্তন নামে একটি মাংসপিণ্ড আছে তাই? জামার উপর আরও একটি কাপড় দিয়ে ঢাকলে কি আমার স্তন গায়েব হয়ে যাবে? আমার হাত-পা-চুল-ঘাড়-মুখ দেখা গেলে বুকের উচ্চতা কেন বুঝা যেতে পারবে না? এটাও শরীরের একটি অংশ। “বিশেষ অংশ” পুরুষ তোমরা বানিয়েছ। তোমাদের লালা ঝরে, তোমাদের চিন্তায় গলদ, তোমাদের চোখে লালসা। এইজন্য মেয়েরা কাপড়ের উপর কাপড় জড়াবে আর না জড়ালে “খারাপ মেয়ে” ট্যাগ পড়ে।
ওড়না পরতে পরতে মরে গেলেও কেউ ওড়না পরার কুফল স্বীকার করে না। আজও খবরে এসেছে রাজধানীর পল্লবীতে রিক্সায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু। এবং এর জন্য সবাই দায়ী করবে মেয়েটির অসাবধানতা। “কেন সে রিক্সায় ওড়না সামলে বসে নি? আরও মেয়েরা তো পরে, তাদের তো হয় না”! ওহে মহৎ চিন্তাকারীরা, শুনেন, সবাই পরার মধ্যেই কিন্তু ঐ মরে যাওয়া মেয়েরাও ছিল। তারা মানুষ বলেই সারাক্ষণ সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে পারে না। আর যে জিনিষে সামান্য এদিক ওদিক হলেই মরণ, সে জিনিশ থেকে দূরে থাকাই যে শ্রেয় তা আপনাদের মহান চিন্তায় আসে না।
অবশ্য এখন ওড়না একটি জাতীয় পোশাক। “ওড়না গলায় কেন, বুকে ওড়না চাই” নামক ফেসবুক পেইজ থেকে এখন পাঠ্যপুস্তকেও ওড়না শোভা পাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের মগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছি মেয়েদের ওড়না পরতে হয়। বাচ্চাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, ওড়না কেন পরে? শিখবে ওড়না পরে বুকের উচ্চতা ঢাকতে। কী চমৎকার ভাবে বাচ্চারা শিখে গেল, বুক ঢেকে রাখতে হয়, নইলে খারাপ বলবে সবাই।
এবার আসি মেয়েদের দিকে। তোমাদের উপর একটা অতিরিক্ত কাপড় চাপিয়ে দিলো আর তোমরা এটাকে ইজ্জতের অংশ ভেবে নিয়েছ। পরিচিত অনেকেই দেখি ওড়না ছাড়া বাইরে যাওয়াকে রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় বলে মনে করে। ওড়না ছাড়া তো দূরের কথা ওড়না যদি ভুল বশত সড়ে যায় তাতেই তারা আঁতকে উঠে যেন তাদের বুকের দিকে কেউ তাকালে জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। মেয়ে, তোমার হাত দেখা যাওয়া যেমন স্বাভাবিক তেমনই বুকের উচ্চতা দেখা যাওয়াও স্বাভাবিক। ওড়না না পরলে তোমাকে খারাপ মেয়ে বলবে সবাই, এই ভয়?
ভালো মেয়ের তকমা পাওয়ার জন্য ওড়না পরা বাধ্যতামূলক না। একে বাধ্যতামূলক করেছে পুরুষের কু দৃষ্টি। যে পোশাকে তুমি নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্য আর শালীন মনে করো সেই পোশাকই তোমার পরা উচিত। তোমার অন্তর যদি শালীন হয় তবে অন্যদের মন্তব্যে তোমার শালীনতা নষ্ট হয় না। যতই ওড়না নিয়ে ঢাকাঢাকি করবে ততই এই তথ্য স্পষ্ট হবে তোমার ঢেকে রাখার মত নিষিদ্ধ কিছু আছে। যতদিন তোমার বুককে তোমার হাত পায়ের মত স্বাভাবিক ভাববে না ততদিন নিজের শরীর নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগবে। ততদিন তোমার প্রাণ বাঁচাতে ওড়না সামলাতে হবে।