আমার এক পায়ে পথ চলা

Hasin Jahan
হাসিন জাহান

হাসিন জাহান: বছর তিনেক আগে হঠাৎ করেই আমার ডান হাঁটুতে সমস্যা দেখা দিল। সমতলে চলাফেরা করতে পারি, কিন্তু সিঁড়ি ভাঙ্গতে পারিনা, এমনকি দু-একধাপ ওঠানামা করাও দুরূহ হয়ে পড়লো।

শুরু হলো ডাক্তার-এক্সরে।ডাক্তার একমনে প্রেসক্রিপশন লিখে চলছেন। জানতে চাইলাম, আমার কি হয়েছে? উনি বললেন যে আমার ডানহাঁটুর মাঝের ফাঁক কমে আসছে, তাই ব্যথা হচ্ছে। আমার পরের প্রশ্ন,বাঁ হাঁটুর এক্সরেতেও তো একই অবস্থা, তবে সেটাতে ব্যথা নেই কেন? উনি মোটামুটি রক্তচক্ষু মেলে তাকালেন। সাথে সাথেই বুঝলাম-ভুল করে ফেলেছি। রোগী হিসাবে এরচেয়ে বেশী জানবার অধিকার আমার নেই। পরদিন থেকে শুরু ফিজিওথেরাপি; গেলাম ট্রমা সেন্টারে যা আমার মত রোগীদের সেবার জন্য নামকরা একটি হাসপাতাল। সেখানে ১৩ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে গ্রাউন্ডফ্লোরে পৌঁছলাম। লিফটে চড়ে ওখানে যাবার বিকল্প পথটি আন্ডারগ্রাউন্ডে যেটা সাধারণত অ্যাম্বুলেন্সে আসা রোগীদের জন্যই ব্যবহৃত হয়। যাহোক,এবার ফিজিওথেরাপী নেয়ার পালা; খোঁজ করে জানলাম অভিজ্ঞ কোন নারী থেরাপিস্ট নেই।

যিনি আমাকে ফিজিওথেরাপি দেয়া শুরু করলেন তার কাছে প্রশ্ন রাখলাম, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি কখনও ভেবে দেখেছে যে ১৩ ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে আসাটা রোগীদের জন্য কতটা কষ্টকর! ভদ্রলোক আনন্দের সাথে তখন শানে নু্যুল বলতে শুরু করলেন। এইভবনের স্বত্বাধিকারি প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী যিনি অতিশয় কৃপণ। তিনি ভবনটির নক্সা তার এক বন্ধুপুত্র-আর্কিচেকচারের ছাত্রকে দিয়ে কম খরচে করিয়েছেন। তার ভাষায় এটা কৃপণতা আর অনভিজ্ঞতার ফলাফল। কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝলাম থেরাপি নেয়ার লাভের চেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠার কষ্ট অনেক বেশী।

এরপর আসলাম বিখ্যাত সি আর পি (মিরপুর)-তে থেরাপি নিতে। এখানে একেবারে বিদেশী নিয়মকানুন, সময় ৯-৫টা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনু্যায়ী ঘড়ি ধরে সার্ভিস দেয়া হয়। আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, কাজেই আমার অফিসে উপস্থিত হবার নির্ধারিত সময় আছে; কিন্তু ছুটির কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। ভাবলাম, হায় হায়, এই সার্ভিস নিতে হলে তো আমার রিটায়ারমেন্ট ছাড়া গতি নাই। যাহোক, অফিস থেকে একমাসের অনুমতি নিলাম যে সকালে থেরাপী নিয়ে অফিসে যাব আর বাড়তি সময় কাজ করে সেটা পুষিয়ে দেব। এবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেবার পালা। কিন্তু হায়, দেখলাম পরবর্তী একমাসের সকালের আর শেষ বিকালের সব স্লটই বুকড।

অতএব নিজেই বাসায় প্রাকটিস করি আর প্রতিদিন হাঁটি। মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আমার বাসা। মধ্যবিত্তের গুছানো এলাকা হিসেবে এটা পরিচিত- ফুটপাতসমেত চওড়া রাস্তা। সময়ের সাশ্রয়ের কথা ভেবে আমি এই ফুটপাতই বেছে নিলাম। কিন্তু একি! বহুকষ্টে আমার সম্বল বাঁ পা দিয়ে ফুটপাতে উঠি, আবার কয়েক কদম যেতে না যেতেই নেমে পড়তে হয়। গুণে দেখলাম, এখানকার সবচেয়ে দীর্ঘ ফুটপাতটা ৩২ কদম আর সবচেয়ে ছোটটার মাত্র ৩ কদম; এবং ছোটগুলোর সংখ্যাই বেশী। ফুটপাতের ধারগুলো অত্যন্ত উঁচু আর খাঁড়া। জানতে ইচ্ছা হয় কোন পারর্দশী ইঞ্জিনিয়ার এই ফুটপাত ডিজাইন করেছেন আর কেইবা সুপারভাইস করেছেন!

দিন কেটে যাচ্ছে, আমিও মোটামুটি এই জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি। ঈদ উপলক্ষ্যে আমার স্বামী জিজ্ঞ্যেস করলেন, “কি নিবে?” বললাম, “একটা স্টাইলিশ ওয়াকিং স্টিক।” দোকানে গিয়ে বললাম আমাকে সঞ্জয় দত্তের ‘সাজন’ সিনেমার মত একটা লাঠি দেন। দোকানী যার-পর-নাই বিরক্ত হলেন। তাকে আর বোঝানোর চেষ্টা করলাম না যে, এই লাঠি হবে আমার জীবনসঙ্গী। এরপর থেকে আমি বেশ স্বচ্ছন্দের সাথে লাঠি নিয়ে চলাফেরা করতে থাকলাম। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়। আমি যেখানে যাই, অন্য মানুষ অস্বস্তিবোধ করে, কি বলে আমাকে সান্ত্বনা দেবে অথবা কি করবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা।

অফিসের কাজে নিয়মিত ঢাকার বাইরে যেতে হয়, সেখানে হয়তো দোতলা/তিনতলায় মিটিং। একপায়ে ভর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আমার অনেক সময় লাগে, তাই সবাইকে বলি আগে চলে যেতে। কিন্তু ঢাকা থেকে আসা বড় অফিসার ভেবেই হোক বা শ্রদ্ধার কারণেই হোক, অনেকে কিছুতেই আগে যান না। সেক্ষেত্রে আমাকেই মহা অস্বস্তি নিয়ে সিঁড়ি বাইতে হয়।

কাজের সুবাদে যেতে হয় প্রত্যন্ত এলাকায়, কখনো নৌকায়, লঞ্চে, ভ্যানে কিংবা প্লেনে। হাঁটতে হয় মেঠোপথে। প্রথম প্রথম সাহায্যের জন্য বলতে হতো। কিছুদিন পর বুঝলাম, আমার পায়ের সমস্যাটা মোটামুটি অনেকেই জেনে গেছেন। নিঃসঙ্কোচে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়ান। একবার নৌকা থেকে নামার সময় খুব অসহায় লাগল। ঠিক এইসময়ে আমাকে নিতে আসা এক সহকর্মী আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ছেলেটার মুখে দাঁড়ি, মাথায় টুপি। আমি অকপটে তার হাতটা ধরলাম। কে কিভাবে নেবেন জানি না, তবে আমরা জানি এই আন্তরিকতায় কোন খাদ ছিল না।

আমি তখনও আশা ছাড়ি নাই। এবার গেলাম ব্র্যাকের মোহাম্মদপুর সেন্টারে। অবশেষে দেখা পেলাম নারী থেরাপিস্টের। পেলাম সকালের স্লট আর তার ওপরে ব্র্যাকের এক কর্মীর রেফারেন্সে যাওয়ায় পেলাম ডিসকাউন্ট। আমি তো আনন্দে আহ্লাদিত। কিন্তু বিধিবাম। দুজন থেরাপিস্টের মধ্যে একজন গেলেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। যিনি আছেন, তিনি নিয়মিত দেরী করে আসেন আর থেরাপির চেয়ে গল্পেই তার আগ্রহ বেশী। কদিন পর তিনিও তার শারীরিক কারণে লম্বা ছুটি নিলেন, আর আমিও ধৈর্য্য হারালাম।

এরপর আসল সুবর্ণ সুযোগ। অফিসের কাজে ব্যাংকক যাব। নিজ খরচে বাড়তি কদিন থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসব। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জানালেন, আমার পায়ের নার্ভ নষ্ট হয়ে গেছে, আর কখনও ভালো হবো না। শুনে আমি মোটামুটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচালাম – যাক আর চিকিৎসা করানো লাগবে না। মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ব্যাংককের চিকিৎসা, সেটাও পূর্ণ হলো। দেশে ফেরার পরে সবাইকে যখন জানালাম, দেখি আমার ছোট ছেলের চোখে পানি টলটল করছে। আমি সহজ গলায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এখনও তো আমার একপা ভালো আছে, যখন ওটাতেও সমস্যা হবে তখন হুইল চেয়ার নিয়ে চলাফেরা করবো। আমি কিছুতেই থেমে থাকব না।

প্রায় মাস ছয়েক হলো, হঠাৎ আবিস্কার করলাম কখন যেন আমি দুপায়ে চলা শুরু করেছি; আজকাল সিঁড়িও ভাঙ্গতে পারছি। আশ্চর্যজনকভাবে চিকিৎসাবিদ্যাকে ভুল প্রমাণ করে এখন আমি দুই পায়ে ভর করে চার-পাঁচ তলা পর্যন্ত উঠে যেতে পারি।

কদিন আগে লন্ডনের সাবওয়েতে লক্ষ্য করলাম একজন সিনিয়র সিটিজেন খুব কষ্টে টিউবে উঠলেন। তারদিকে আমার হাতটা প্রায় বাড়িয়ে দিচ্ছিলাম, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করলাম। হাত বাড়ালে উনি হয়তো অসম্মনিত হতেন। আমার দেশ হলে আমি কিন্তু নিশ্চয় হাত বাড়াতাম। আমি এদেশের মানুষের আন্তরিকতা দেখেছি, তাদের বাড়ানো হাত ধরেছি। আমি সম্মানিতই হয়েছি। এখনও বাইরে কোথাও গেলে,বড়ছেলে যখন চট করে আমার হাত ধরে তখন তাকে মনে করাই না যে, এখন আমি হাঁটতে পারি।

আমার এই একপায়ে পথ চলা আমাকে নতুন করে অনেক কিছু দেখতে শিখিয়েছে, ভাবতে শিখিয়েছে। এখন বুঝি, চলার জন্য পা থাকাটা সবসময় জরুরি না, চলার পথ চেনাটা অনেক বেশি জরুরি।

পাদটীকা:

পৈতৃকসম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে একটা এপার্টমেন্ট পাবো- মধ্যবিত্তের স্বপ্নের ঠিকানা। ডেভেলপারের কাছে শর্ত রাখলাম, এমনভাবে ডিজাইন করবেন যেন গ্রাউন্ডফ্লোর থেকে হুইলচেয়ার নিয়ে লিফটে ঢোকা যায়। ভদ্রলোক জানালেন, এমন অনুরোধ তার কাছে এই প্রথম। বাড়ির কিছু ইন্টেরিওরের কাজের দায়িত্ব দিলাম এক তরুণী আর্কিটেক্টকে। জরুরি নির্দেশনা হিসেবে বললাম, টয়লেটের দরজা হবে স্লাইডিং আর সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্টটা ডিসেবল ফ্রেন্ডলি। সে জানতে চাইলো কার জন্য, বললাম আমার জন্য। খুব অবাক চোখে বললো, এভাবে কাউকে ভাবতে দেখিনি, বলতেও শুনিনি।

১৫ জানুয়ারি ২০১৪

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.