লিটল রেড রাইডিং হুড এবং আমাদের মেয়েরা

সৌরিন দত্ত:

আমার যমজ দুই শিশুকন্যার পিতার কাছে আবদার শুধু গল্প বলার। অলস দুপুরে তাদের গল্প না বললে তারা ঘুমায় না। লিটল রেড রাইডিং হুডের গল্প পড়েছিলাম ছোটবেলায় – সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকাকালীন। ছোট্ট মেয়েটি মায়ের বানানো পিঠা নিয়ে নানীকে দেখতে যাবে। পই পই করে মা বলে দিলেন, রাস্তায় যেন কারও সাথে মেয়ে কথা না বলে। লাল টুপিওলা জামা পরা ফুটফুটে মেয়েটি হাতে খাবারের পোটলা নিয়ে যাওয়ার সময় এক নেকড়ের চোখে পড়লো। নেকড়ে শুধালো –কোথা যাও সুন্দরী? অবোধ বালিকা বলে দিলো – মায়ের বানানো পিঠে নিয়ে নানীর বাড়ী যাই, ওই যে বনের ধারে আমার নানীর বাড়ী, মা বলেছে একলা বুড়ীটাকে দেখে আসতে। নেকড়ে বললো, তা নানীর বাড়ী যাবেই যখন, নানীর জন্য কিছু ফুল নিয়ে যাও।

ছোট্ট মেয়ে যখন ফুল তুলতে গেল, ততক্ষণে নেকড়ে নানীর বাড়ী গিয়ে হাজির। তাড়াতাড়ি নানীকে খেয়ে নেকড়ে নানীর পোশাক পড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর  ছোট মেয়েটি এসে দেখে নানী বিছানায় শোয়া। ছোট্ট মেয়ে নানীকে বলে, নানী তোমার হাতের নখ এতো বড় কেন? নানীবেশী নেকড়ে বলে, যাতে তোকে আদর করতে পারি। নানী, তোমার দাঁত এতো বড় কেন? যাতে তোকে খেতে পারি –এই বলে যেই নেকড়ে ছোট্ট মেয়েটিকে খেতে যাবে, মেয়ে দিলো এক চিৎকার। আর সেই চিৎকার শুনে ছুটে এলো এক কাঠুরে। হাতের কুড়াল দিয়ে এক কোপে কেটে ফেললো দুষ্ট নেকড়েকে। তাড়াতাড়িতে হজম করতে পারেনি বলে নেকড়ের পেট থেকে আস্ত বেড়িয়ে এলো নানী। রূপকথার গল্প এখানেই শেষ।

ইউরোপের প্রায় প্রতি দেশের শিশুতোষ লোক সাহিত্যের এক অচ্ছেদ্য অংশ এই গল্প। গল্পের আধুনিক রুপটি গ্রীম ভাইদের অবদান হলেও গবেষণায় জানা গেছে, দশম শতাব্দীতেও ফ্রান্সে এই গল্প চালু ছিল। জার্মান গল্পে নেকড়ে নানীকে খেয়ে ফেলে, আর ফরাসী গল্পে নানীকে আলমারীতে আটকে রাখে। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এই গল্প এক সময় পৌঁছে যায় মার্কিন মুলুকে। সেখানে নেকড়ে আবার এক কাঠি বেশী, সাধারণ নেকড়ে নয়, ওয়ার ঊলফ। এমনকি চেরোকি ইন্ডিয়ানরাও এই গল্প বলে তাদের বাচ্চাগুলোকে ভয় দেখাতো যাতে তারা দূরে না যায়।

শিশু বয়সে এই গল্প যখন পড়ি তখন নেকড়ের হাত থেকে রেড রাইডিং হুডের রক্ষা পাওয়াতে কী যে শান্তি পেয়েছিলাম! শিউড়ে উঠেছিলাম ঠিক সময়ে যদি কাঠুরিয়া না পৌঁছাতো কী হতো তা ভেবে। আমাদের the radiant way  পড়াতেন মিসেস হেনরিয়েটা বেলাসো। চমৎকার বাচনভংগী আর কন্ঠস্বরের উঠানামায় কী যে এক যাদুকরী ছিলো তাঁর পাঠদান পদ্ধতি! ক্লাসে হাঁটতে হাঁটতে -‘ তারপর নেকড়ে করলো কী “- বলে তিনি যেই থামতেন, আমাদের মুখগুলো ততক্ষণে শুকিয়ে আমসি।  

ঈশ্‌শশ—কেন যে মেয়েটা নেকড়েটাকে বলতে গেলো! কখনো মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে, মেয়েটা কি একবারও ভালো করে নানীর দিকে তাকায়নি? তাকালেই তো সে বুঝে যেত, ওটা তার নানী না! আর মা’টাই বা কেমন- মেয়েটাকে একা যেতে দিলো কেন বনের ভিতর দিয়ে? মেয়েটার যদি একটা পোষা কুকুর থাকতো আমাদের বাঘার মতো, তাহলে কি আর নেকড়ে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতো না?

ধুর , সব বাজে কথা! নেকড়ে কি কখনো মানুষ হতে পারে?

আকাশকুসুম ভাবনার সেই বয়সে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিলো না। লজ্জ্বায় প্রশ্নের উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করিনি, পাছে কেউ বুঝে ফেলে আমি ভয় পেয়েছি। ক্লাস টুতে পড়া একটা পুরুষ মানুষ কি এসব গল্প শুনে ভয় পায়? একথা সবাই যদি জানে আমি ভয় পেয়েছি, তাহলে আমাকে ভাববেটা কী! দশম শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী, এই এগারোশো বছরে পৃথিবীর কোটি কোটি শিশু এই গল্প পড়ে ভয়ে শিঊড়ে উঠেছে, নেকড়ের মৃত্যুতে খুশী হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর খুব কম মানুষই ভেবেছে- নেকড়ে এমন করে কেন? বিশেষত যাদের ভাবার কথা ছিল, তারা ভাবেননি। বা ভাবলেও কার্যকরি কোন কিছু করেননি। নেকড়ে যদি মেয়েটাকে খেতেই চাইতো, তবে বনের মধ্যে কেন তাকে খায়নি? সে তো মেয়েটাকে বলতে পারতো, আমাকে পিঠাগুলো দিয়ে দাও, আমি খাবো। কিংবা নানীকে খেলেই তো তার পেট ভরে যাওয়ার কথা- ওই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটাকেই কেন খেতে হবে? আর খাবিই যদি, সেটা শুধুমাত্র বিছানাতেই কেন?, নানীর কাপড় করে বিছানায় শুয়ে এতো ছলনা করার কী দরকার ছিলো?

এই গল্পে মা মেয়েকে পই পই করে বারণ করেন অপরিচিত কারো সাথে কথা না বলতে। অবুঝ মেয়ে সরল বিশ্বাসে কারো সাথে কথা বলতে পারবে না। মেয়ে বলেই তাকে সরলতা ত্যাগ করতে হবে। মেয়ে বলেই তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে মনের ভাব। একলা মেয়ে যদি কোথাও যায়, তার উচিত নয় কাউকে বলা আমি একেলা। নেকড়েকে জানান উচিৎ হয়নি আমি একা নানীর বাড়ী যাচ্ছি, আমার নানী একেলা এবং বৃদ্ধা। এতে হয়তো কেউ মনে করতে পারে মেয়েটি খাদ্য, অথবা সে  খাদ্য হতে চায়।

কারণ স্বাধীন নারী আমরা দেখতে চাই না। এ সমাজ এখনো একাকী নারীর জন্য প্রতি পদে বাধার সৃষ্টি করে।  “পিংক” ছবির সেই বিখ্যাত উক্তি- আমাদের সমাজে একাকী মেয়েকে নির্জনে দেখলেই আমরা ধরে নেই মেয়েটি খাদ্য, সমাজও তাকে ওভাবেই দেখে। কারণ ঘড়ির কাঁটায় আমাদের চরিত্রের বিচার হয়।

একা ছিল বলেই অনেক আগে দিনাজপুর শহরে ভোররাতে বাস থেকে নেমে মায়ের কাছে যাওয়ার সময় ইয়াসমীন নামে এক মেয়ে কিছু নেকড়ের কবলে পড়েছিলো। দুর্ভাগ্য কোনো কাঠুরিয়া তাকে বাঁচাতে আসেনি, বাস্তবে কাঠুরিয়ারা আসে না, এলেও দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। হয়তো হাজারে এক কাঠুরিয়া আসে, কিন্তু হাজারো নেকড়ের ভীড়ে সে অসহায়। হয়তো পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে একজন কাঠুরিয়া চেষ্টা করে কিছু নেকড়ের হাত থেকে এক রেড রাইডিং হুডকে বাঁচাতে, কিন্তু তারপর সবাই তা ভুলে যায়। ঘটনার দুবছর পরও একটা নেকড়েও ধরা পড়ে না। ফলত নেকড়ের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। আর লিটল রেড রাইডিং হুডেরা বুকের কান্না বুকেই কবর দেয়।

মেয়েকে বোধকরি সাজিয়ে দিয়েছিলো মা। সবচেয়ে সুন্দর টুপিওয়ালা লাল টুকটুকে জামাটা পরিয়ে দিয়ে মনে মনে ভেবেছে আমার মেয়েটাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! মা জানতো না, নেকড়েরা মনে করে এখনো মেয়েদের ইচ্ছামতো কাপড় পরা নিষেধ- দশম শতাব্দী থেকে এই একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত নেকড়েরা এখনও চিন্তাধারায় বদলায়নি। কেউ কেউ মনে করে মেয়েরা জিন্স পরে বলেই ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। কেউ ভাবে নেকড়ের লালা পড়ে – তা দোষের কিছু নয়। এক বিশেষ ফল দেখলে যেরকম সবার লালা পড়ে, সে তো সেই ফলের দোষ! যাদের লালা পড়ে তাদের কোনো দোষ নেই। তুমি সুন্দর সেটাই তোমার অপরাধ, সে তুমি খাদিজা হও বা রেড রাইডিং হুড হও। তুমি অসহায়-তাই তুমি খাদ্য –তুমি পার্বতীপুরের সেই পাঁচ বছরের মেয়েটি হও, বা  দিনাজপুরের ইয়াসমীন হও- নেকড়ের হাতেই তোমার নিয়তি!

ছোটবেলায় কোনমতেই মাথায় ঢুকতো না নেকড়ে কীভাবে মানুষের রূপ ধরে? এখন বুঝি, আসলে মানুষই নেকড়ের রূপ ধরে এবং শুধু মানুষই নেকড়ের রূপ ধরতে পারে। সাম্প্রতিক বলিউডি দুটি ছবি – হাইওয়ে এবং কাহিনী ২; দুর্গা রানী সিং, যার ঘটনা আবর্তিত হয়েছে পরিবারের ভেতর লুকিয়ে থাকা নেকড়ে নিয়ে। পেডোফাইলরা বনের মাঝে নয়, এই সমাজেই আছে। হাজার হাজার নেকড়ে আমাদের মাঝে আছে। ওরা  দেখতে অবিকল আমাদের মতন।

ইউরোপে যার নাম লিটল রেড রাইডিং হুড, আমাদের দেশে হয়তো তার নাম তনু, আফসানা, ইয়াসমীন, সীমা, পূর্ণিমা, বা কল্পনা চাকমা। নামে কীইবা আসে যায়! নেকড়ের শিকার যারা হয়, তারা শুধু ইউরোপে নয়, বাংলাদেশেও হয়, পদ্মার চরে হয়, ঢাকা শহরে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে হয়, গার্মেন্টস এ হয়, আবার বহুজাতিক কোম্পানিতেও হয়। হাজার বছর ধরে নেকড়েগুলো আছে।

আবারো পিংক ছবির কথা বলি – ‘না’ শুধু এক শব্দ নয়, না নিজেই একটি পরিপুর্ণ বাক্য। কোনো মেয়ে যখন না বলে, সে যেই হোক -পরিচিত বা অপরিচিত, স্ত্রী হোক বা যৌনকর্মী, ‘না মানে না’। কিন্তু আমরা কি না বলার অধিকার কোনো মেয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছি? সমাজের লুকিয়ে থাকা নেকড়েদের আমরা চিনতে পারি না, কিন্তু যদি চিনি তবে ঘৃণা করি।

মেয়েদের বিয়ের ন্যুনতম বয়স কমিয়ে দিয়ে আমরা কি সমাজে নেকড়ের সংখ্যা বাড়াবো? লিটল রেড রাইডিং হুডরা খুব কমক্ষেত্রেই বেঁচে যায়, আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মরে বেঁচে থাকে। আর নেকড়েরা? তারা বহাল তবিয়তেই থাকে। মাঝে মাঝে রাষ্ট্র তাদের পুরস্কারও দেয় বিয়ের ন্যুনতম বয়স কমিয়ে দিয়ে।

লেখক: সৌরিন দত্ত, হেড অব ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লাই চেইন, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.