আমরা যারা একলা থাকি-২৫

imp 1উইমেন চ্যাপ্টার: মনিকা তখন একটা ওয়ার্কশপে, বেশ মনোযোগ দিয়ে রিসোর্স পারসনের কথা শুনছে। এমন সময় এক বন্ধুর কল আসে তার মোবাইলে। ওপাশ থেকে রীতিমতো হাউ মাউ করে কান্না। কখনও চিৎকার করে কাঁদছে, কখনও বা ফুঁপিয়ে। মনিকা বার বার বলছে, প্লিজ কুল ডাউন প্লিজ। বলো কী হইছে? ওপাশ বলে, কষ্ট হচ্ছে রে খুব। কীসের কষ্ট? জানি না, কিন্তু নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

এই নি:শ্বাস বা দম বন্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতাটা মনিকার খুব পরিচিত। পৃথিবীর সব দরজা যখন একে একে বন্ধ হয়ে আসে, অন্তত মনে হয় যে, বন্ধ হয়ে আসছে, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তখনই এমন বোধ হয়। মনিকার তো এই অবস্থা চিরচেনা, যাকে বলে ক্লস্ট্রফোবিয়া। দীর্ঘদিন ধরে সে এই ফোবিয়ায় ভূগছে। নিয়মিত ওষুধ খেয়ে তাকে এই অনুভূতি বন্ধ রাখতে হয়। মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ব্যাগের মধ্যে সবসময় বয়ে নিয়ে চলে নাজাল ড্রপ, ইনহেলার, আরও কতকি! এগুলো সবই মানসিক শান্তির জন্য।

ডাক্তার বন্ধুরাও বলেছে, এটা তোমার মানসিক সমস্যা। হতে পারে মানসিক সমস্যাই। কিন্তু যে সময়টুকু পার হয় এই ক্লস্ট্রফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে, তাকে তো যুগ যুগ মনে হয়। মৃত্যুভয় যে কি জিনিস, তা যে না পার করেছে এই ভয়, সে কোনদিনই বুঝবে না। লিফটে বা বন্ধ জায়গায় তো হয়ই, কখনও কখনও ভরা মধ্য রাস্তাতেও হয়। গাড়ি যদি কোন কারণে রাস্তার মাঝখানে থাকে, তাহলেই সর্বনাশ। এমন ঘটনাও ঘটেছে পুরো রাস্তা মনিকাকে গাড়ির দরজা খুলে আসতে হয়েছে।

মনিকা বলছিল, যেদিন তার সন্তানের বাবা মারা গেল, সেদিন কবর দিয়ে আসার পথে গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে টেম্পোসদৃশ একটা বাহনে করে আসছিল সেই মানুষটির কতিপয় বন্ধুর সাথে। ওরা সবাই আপসেট ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, একাকি জীবনে সেই মানুষটিও বেঁচে ছিল এই কতিপয়ের আলোছায়া ঘিরেই। কাল যে বন্ধুটি ছিল, আজ সেই চলে গেছে ওদের হৃদয় শূন্য করে। সবারই সংসার আছে, ব্যস্ততা আছে, জীবিকা আছে, হয়তো সেভাবে আর মনেও পড়বে না বন্ধুটিকে, তারপরও এই মূহূর্তের কষ্টটা শুধুমাত্র এই মূহূর্তেরই। অন্য সময়ের জন্য তোলা নেই। টেম্পোটি মফস্বল শহরে প্রবেশ করেছে।

এখানকার প্রতিটি ধূলিকণা মনিকার শৈশবের অনেক স্মৃতি বহন করে। বার বার সে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল, সম্বিত ফিরে পাচ্ছিল বন্ধুদের ডাকে। ওকে ‘তথাকথিত’ শ্বশুরবাড়ির গেইটে নামিয়ে দিয়ে গেল ওরা। গ্রিলের কবাট খুলে এক পা, দুই পা করে ঢুকতে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল মনিকার দুই পা। মনে বাজছে, ‘এ পথে আমি যে, গেছি বার বার’। এই গেইট, এই বাসা, অনেক পরিচিত, অনেক স্মৃতি। শুধু মানুষটাই নেই আজ, যে দরজা খুলে বলবে, ‘এসো, ভেতরে এসো’।

সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে মানুষটার মা, নির্বিকার। ছেলে নেই, এ নিয়ে তাঁর কোন ভাবনাও নেই। মনিকা আগেই জেনেছে, উনার স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। ভালোই হয়েছে একদিকে। যে স্মৃতি কষ্টের, তার ভ্রম হওয়াটাই শান্তির। কিন্তু না, মনিকাকে দেখে উনার গলাটা ভারী হয়ে গেল। বললেন, ‘এতো দেরি করলা যে, কখন মাটি দেয়া হয়ে গেছে!’ সবাই তখন মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, চিনেছেন এঁকে? উনি হেসে বলেন, ‘কি যে কও না তোমরা? আমার ছেলের বউরে আমি চিনতাম না!’ মনিকার ভিতরের অহংবোধ সব একে একে খসে পড়তে থাকে মাতৃস্নেহের কাছে। ছেলেহারা এক উন্মাদ মায়ের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়ায় মনিকা। এই অনুভূতিকে অস্বীকার করে, সে সাধ্য তার নেই।

বাসায় অনেক মানুষ। কতজন কত কথা বলছে। মানুষটার এতো গুণের কথা মনিকা কোনদিন শোনেনি আগে। কার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, কার ছেলের পরীক্ষার ফি দিতে হবে, সব জায়গায় সেই ছিল সহায়। তাই মানুষের ঢল নেমেছে বাসায়। কিন্তু সবার অলক্ষ্য দৃষ্টি যে মনিকাকে ঘিরে, সেই চোখগুলোর আঁচ সে টের পায়। এসব কথা শুনে মনিকার অভিমান হয়, রাগ হয়। সে একা দুহাতে উপার্জন করে সামলেছে ছেলেমেয়ে, আর এই মানুষটা কিনা অন্যদের সাহায্যে লাগতো! এ কেমন মানুষ! অনেকেই অনেক কিছু জানতে চায়, সবার কথার জবাব দেয়া হয় না। তবে মনিকাকে কটাক্ষ করেনি কেউ। সবাই যেন মেনেই নিয়েছে, এটা দুটো মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ননদ, দেবর সবাই তার কাছ ঘেঁষে ঘেঁষে থাকে, উষ্ণতা চায়, মনিকা কাউকে ফেরায় না। আজকের দিনে কোথাও মলিনতা থাকতে নেই। একজন মানুষ চলে গেছে, সেই মানুষটার প্রতি বিতৃষ্ণা, ক্ষোভ যাই থাকুক না কেন, ভালবাসাও তো ছিল কোন একদিন। সেটুকুই না হয় তোলা থাক আজকের দিনে!

রাত বাড়ছে, ওদিক থেকে বড় ভাইয়ের ফোন, বাসায় যাওয়ার তাড়া। ছেলেকে নিয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে সে, বড় ননদের মেয়েটি বড় আদুরে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আজকের দিনেও কি থাকা যায় না? নারে, কাল আবার আসবো, এই বলে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বাবার বাসায় এসে স্নান সেরেই মনে হয় পেটে রাজ্যের খিদে। বিশেষ করে ছেলেটা তো সারাদিন খায়নি কিছুই। ছেলেটির মনে কোন বিকার নেই বাবার জন্য। মায়ের জন্যও আছে কিনা সেই পরীক্ষা হয়নি। খেয়ে নেয় কোন দ্বিধা না করেই। মনিকা কোনরকমে দুগ্রাস খায়। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ছেলে ঘুমিয়ে পড়ে মূহূর্তেই। এবার মনিকার পালা।

এই ঘর, এই বাড়ি, বাসার পাশের রাস্তা জ্যোছনায় ছেয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষের পায়ের শব্দ। সেই শৈশবে এক ধরনের অদ্ভুত শব্দ করে হেঁটে যেতো মানুষটি, যাতে মনিকা শুনতে পেয়ে জানালায় ছুটে যায়। আজও যেন সেই শব্দ করেই কেউ হেঁটে যাচ্ছে। পাতার শন শন আওয়াজ পায়ের শব্দ বলে ভুল হয়। রাত গভীর থেকে গভীর হয়, মনিকা তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। এই বাড়ির সাথে কত স্মৃতি মানুষটার। আজ এই জানালার শিক ধরে তাকিয়ে থেকে মনিকার দৃষ্টি কেবলই শূণ্য ঠেকে। পাশের ঘরে বড় ভাই-ভাবীর প্রেম চলছে। দেয়াল ভেদ করে সেই শব্দ কানে আসছে। মনিকার কান্না আরও তীব্র হয়। এই শব্দও সেই ঘরে যাওয়ার কথা। জীবনটা বড়বেশি আশ্চর্য ঠেকে! একটি মৃত্যু কিছু মানুষকে কাঁদায়, শূণ্য করে দেয়, কিন্তু কিছু মানুষকেই আবার বিকারশূণ্য করে, তারা ভালবাসার রাত হিসেবে এই রাতটিকেই বেছে নেয়, তাও আবার মনিকার সামনেই? মনিকা বুঝে উঠতে পারে না জীবনের এই সমীকরণ!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.