উইমেন চ্যাপ্টার: নোমান সাহেবের একসময় সব ছিল, টাকা-পয়সা-সংসার-ছেলে-মেয়ে, সব। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরে সব ছক পাল্টে গেছে। এখন নিজের বাড়িতেই তিনি অবাঞ্ছিত। সম্পর্ক মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, তাকে না দেখলে বোঝা কঠিন।
এ অবস্থায়ও সেখানে আছেন কেন? জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘শুধুমাত্র মেয়েটার পায়ের শব্দ শোনার জন্যই ওখানে পড়ে থাকি আমি’। তবে প্রায়ই তার এই থাকাটা দু:সহ হয়ে উঠে। এই সেদিনও তিনি বলছিলেন, সারারাত ঘুমাতে পারেননি চেঁচামেচিতে। দূর থেকে বোঝাও যাচ্ছিল না কী হয়েছে, কিন্তু জোরে জোরে চিৎকার, মারের শব্দ আর কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, মেয়েটাকে মারছে ওর মা। কিন্তু গিয়ে যে ফেরাবেন, সেই পথও বন্ধ। কাগজেপত্রেই তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অপরপক্ষ থেকে। মাস শেষে মেয়ের খরচ বাবদ প্রতিশ্রুত টাকাটা দেয়া ছাড়া আর কোন দায়বদ্ধতা নেই নোমান সাহেবের।
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে তিনি যখন বিদেশে আসেন, তখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মোটামুটি ভালোই ছিল সংসার। সুখও ছিল। কিন্তু তা অ-সুখে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান বাড়ে, স্ত্রীর সাথে একই ছাদের নিচে থেকেও যেন দূর জগতের বাসিন্দা হয়ে যান নোমান সাহেব।
তিনি বলছিলেন, বিদেশে তিনি একাই শুধু এমন অবস্থায় পড়েছেন, তা নন। তার মতো আরও অনেকে আছেন। এমন উদাহরণও আছে যে, বিদেশে উপার্জিত সব অর্থ শুধুমাত্র ডিভোর্স সংক্রান্ত ঝামেলা মেটাতে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে অনেকের। সর্বস্বান্তও হতে হয়েছে। এমনকি একসময় ভালবেসে যে বাড়ি বা অন্য কোন সম্পদ কিনে দিয়েছিলেন স্ত্রীকে, সবাই হারাতে হয়েছে আইনী জটিলতা মেটাতে গিয়ে। একজন পরিচিত সাংবাদিক তো সব হারিয়ে দেশেই ফিরে এসেছেন। অথচ তারই কারণে আজ তার পরিবার এবং স্ত্রীর বাবার বাড়ির সবাই বিদেশে সেটেলড।
সমাজে নারীরাই যে কেবল একা হচ্ছেন, তা নয়। ব্যাপকহারে বাড়ছে উল্টো ঘটনার সংখ্যাও। পুরুষরাও এখন নিজেদের অনেকটাই অনিরাপদ ভাবেন ভবিষ্যত প্রশ্নে। বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকেন, তাদের কথা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি সন্তানের ওপর অধিকারের প্রশ্নেও পুরুষরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের একজন সেলিব্রিটিও জীবন বাজি রেখে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন শুধুমাত্র মেয়েদের মুখটা দেখবেন বলে। তার মেয়েদের মা অন্য জায়গায় বিয়ে করেছেন। সেই ঘরেও দুটি সন্তান আছে। আর এই দুটি মেয়েকে কিছুতেই তাদের বাবার কাছে আসতে দিতে নারাজ। ফলে বিষয়টা গড়িয়েছে আদালত পর্যণ্ত। সেলিব্রিটি এই বাবা ঠিক সময়মতো আদালতে হাজির হয়ে যান সেখানে মেয়েদের দেখতে পাবেন বলে। সযতনে গুছিয়ে রাখেন মেয়েদের জামা-জুতো-খেলনা। তার মেয়েরা স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে উঠছে, কিন্তু বাড়ছে না শুধু বাবার স্মৃতিতে। বাবার কাছে মেয়েরা সেই আগের মতোই ছোট্টটি রয়ে গেছে। মেয়েদের ফেলে যাওয়া জামা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে তিনি ঘুমান। স্বপ্ন দেখেন, একদিন না একদিন মেয়েরা তাকে বুঝবেই, সেদিন কেউ তাদের আটকাতে পারবে না। তিনি যখন মেয়েদের কথা বলেন, গলাটা বুঁজে আসে তার কষ্টে।
আবার এসব গল্পের ঠিক বিপরীত আরেকটা গল্প। হ্যাঁ, গল্পই তো। রায়হান কবির নিজের ছেলেমেয়ের খোঁজ রাখেননি কখনও, পাছে তাদের খরচ বহন করতে হয় ভয়ে। অথচ পাড়া-প্রতিবেশির ছেলেমেয়েদের সাথে তার দারুণ সখ্য। প্রতিবেশিরা ভাবেন, আহারে বেচারা, নিজের সন্তানদের পায়নি বলেই এ অবস্থা। কিন্তু তাকে তো কেউ না করেনি নিজ সন্তানদের পেতে। আয়-রোজগার যে একেবারেই নেই, তা নয়। যখন হাতে টাকা এসেছে, দুহাতে উড়িয়েছেন, পারলে পুরো বাসা টাইলস করিয়েছেন। ওদিকে তারই সন্তানের ভবিষ্যত দু:শ্চিন্তায় তাদের মা ভেঙে চলেছেন একের পর এক জমানো টাকা।
সেই তারই স্ত্রী, যিনি কিনা এই বিয়ের কারণে ছেড়ে এসেছিলেন সবাইকে, সেই তিনি সকাল-সন্ধ্যা একটা নয়, দুটা নয়, তিন-তিনটা কাজ করে সামাল দিয়েছেন সংসার। শরীরে বড় করেছেন সন্তানদের, পড়ালেখা করাচ্ছেন। এখনও টেনে যাচ্ছেন সংসারের ভার। কোথাও ক্লান্তি বিলাসিতারও ফুরসত নেই। দৌড়াচ্ছেন তিনি জীবনে পিছনে, আর জীবন তাকে কেবলই ঠকিয়ে দিচ্ছে, দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সময়, চোখের নিচে ভাঁজ, শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা জানান দেয়, বয়স বাড়ছে।
আসলে দুরকম গল্পই প্রচলিত আমাদের চারপাশে। আমরা মেয়েদের গল্পগুলো অনেক শুনি, তাদের বৈষম্য-বিড়ম্বনা-নির্যাতনের কাহিনী শুনি। কিন্তু এমন কত পুরুষের হাহাকার যে আছে, আমাদের তা শোনা হয় না। আমরা শুনি, সংসারের সব নির্যাতন-অত্যাচার সয়েও মেয়েরা পড়ে থাকে সংসার নামক অভিশপ্ত জীবনে, শুধুমাত্র সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সহ্য করে যায় সব।
কিন্তু ঠিক কতসংখ্যক পুরুষ যে শুধুমাত্র সন্তানের কারণেই এমনিভাবে সংসারে টিকে আছে, তার খবর কি আমরা জানি? (চলবে)