সোভিয়েত নারীর দেশে-৩

Leningraসুপ্রীতি ধর: ভাল লাগা-মন্দ লাগার এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ইনট্যুরিস্ট বাসটা এসে থামলো ‘উনিভারসিচিয়েত’ বা ‘ইউনিভার্সিটি’ হোটেলে। পথে দেখতে দেখতে এলাম বিশাল বিশাল সব ‘রাজপ্রাসাদ’। সাথের বড় ভাইদের এটা বলতেই তারা হেসে গড়িয়ে পড়লো। এটা ‘রাজপ্রাসাদ’ না বোকা মেয়ে, এটা ‘মস্কো ইউনিভার্সিটি’। বলে কী? আমি কি তাহলে এখানেই পড়তে এসেছি? মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। তখনও কি জানি কোথায় আমার গন্তব্য!

হোটেলে পৌঁছানোর পর একটা রুম পাওয়া গেল বটে। জীবনের প্রথম কোন হোটেলে একা থাকা আমার। তাও আবার সেই উনিশে পা দিয়েই। একটা মিশ্র অনুভূতি খেলে গেল সারা শরীরে। এতো বছর স্মৃতি হাতড়ে যতদূর মনে পড়ে আমার একজন রুমমেট ছিল তখন শ্রীলংকা থেকে আসা। কিন্তু মাত্র একনজরের রুমমেট। সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে তাকে আর পাইনি। তার ব্যাগও ছিল না। মনে হয় সেদিনই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল অন্য শহরে। ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে কোনদিন তার নামটাও আমার আর জানা হলো না।

তো, যা বলছিলাম, সারারাতের ক্লান্তিশেষে যেই না গা এলিয়েছি, অমনি দরজায় ঠক ঠক। খুলে দেখি বড় ভাইদের সাথে আরও নতুন মুখ। তারা সবাই আমাকে দেখতে এসেছেন। এতো এতো ছেলে মানুষ আমাকে এমনভাবে দলবেঁধে দেখতে এসেছে, বাসার বড়রা জানলে যে কী ভাবতো তখন! কৈশোরে রাস্তা দিয়ে ছেলেরা গেলেও আমি বাসার বড়দের ভয়ে সেঁদিয়ে থাকতাম, এই বুঝি ছেলেগুলো কিছু করলো রাস্তায়, আর সব দোষ এসে পড়বে আমার ওপর, যে, আমার জন্যই এসব করছে ওরা! আহা, আজ আমি মহা মুক্ত এসব গ্লানি থেকে। 

সারাজীবনই আমি ছেলেদের সামনে লাজুকলতা ছিলাম, অবশ্য এখনকার আমাকে দেখে সেটা কেউ ভাবতেও পারবে না। যাই হোক পরিচয় পর্ব শেষ, আমি ময়মনসিংহের মেয়ে। একজন দেখি আমার মামা হোন সম্পর্কে। কী মুশকিল, এই বিদেশে আবার ‘মামা’ কেন? শুনলাম, উনি আমাকে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় দেখেছিলেন। নেত্রকোনা বাড়ি। মনে পড়ে গেল যে ওখানে আমাদের অনেক আত্মীয় আছে। উনারা আমাকে তৈরি হতে বলে নিচে চলে গেলেন।

ভাবতে বসলাম, তৈরি মানে কী? আমি তো তৈরিই। জামা-প্যান্ট সবই পরা। চুলটা আঁচড়ে নিচে নামতেই ‘মামা’ (আলোময় বিশ্বাস) এগিয়ে এসে বললেন, শীত তো বাইরে, জ্যাকেট আনোনি? ওওওওওও………………..। ছুটে গিয়ে দাদার কাছ থেকে চেয়ে নেয়া জ্যাকেটটা পরে এলাম। আমার তখন পেটে টান পড়েছে, কিন্তু কাকে বলি সেকথা? অপরিচিত লোকজনের কাছে খাবারের কথা বলি কী করে! হ্যাংলার মতোন শোনায় যদি! তাছাড়া সেই দলে তো বেশ অনেক কজন ‘ছেলে’ও আছে!

তাদের পিছু পিছু রওনা হলাম অজানা মস্কো দেখতে। হাঁটছি আমি। এতো সুন্দর আর পরিস্কার রাস্তায় জীবনেও হাঁটিনি। কিছুদূর যেতেই দেখি সবাই মাটির নিচে নেমে যাচ্ছে। কী একটা জিনিস সুড়সুড় করে নিচে নামছে। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবাই চলে যাচ্ছে, হঠাৎই তপুর নজরে পড়লাম আমি। উঠে এসে হাত ধরে চলন্ত সিঁড়িতে নিয়ে গেল। আমি কি আর নামি? ও তখন বুঝিয়ে দিল, কিভাবে পা বাড়াতে হবে, কিভাবে ধরে দাঁড়াতে হবে। আমি ওই চলন্ত হাতলে না ধরে বরং ওর হাতটা ধরাই নিরাপদ মনে করলাম। বিস্ফারিত চোখ আর উচ্ছসিত মন নিয়ে নিচে নেমে এসে দেখি লংকাকাণ্ড। মাটির নিচে আরেক রাজ্য। এ হলো পাতাল রেল। ঝকঝকে ট্রেন আসছে-যাচ্ছে, নিজে থেকে দরজা খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সবাই উঠছে-নামছে। আমিও সবার সাথে সেই কাফেলায় যোগ দিলাম। মফস্বলের মেয়ে হলে কী হবে, তিন বছর ঢাকায় থেকে বেশ চালাক-চতুর হয়ে উঠেছিলাম। ধন্যবাদ নিজেকে।

এতোদিন গল্পই শুনতাম পাতাল রেলের। আজ আমি মাত্র একরাতের ব্যবধানে চাক্ষুষ সাক্ষী। ট্রেনের গতির সাথে তাল মেলাতে পারছিলাম না বলে কেউ একজন আমাকে বসিয়ে দিল আসনে। চারদিকে সাদা লোকের ভিড়ে আমার দলই কেবল তাম্রবর্ণের। নিজের হাতের দিকে তাকালাম, বেশ কালো কালো লাগছে আমাকে। দেশে থাকতে কিন্তু অতোটা কালো কখনই মনে হয়নি নিজেকে। কেউ বললে বেশ গর্ব করে বলতাম, আরে না, শ্যামলা আমি। এখানে কী তবে আমি কালো মেয়েই হয়ে গেলাম!

পার হয়ে এলাম কতগুলো স্টেশন, জানিও না। নেমে আবার ওপরে উঠার পালা। নিচে রাতের আবহ, আর বাইরে জ্বলজ্বলে দিন, ঠাণ্ডা বাতাসও আছে সেইসাথে। হঠাতই আমি ঢাকার সেই মেয়েটা পাল্টে যেতে লাগলাম। আমার পোশাক তখন হাস্যকর দেখাচ্ছিল কিনা, তা অবশ্য জানা হয়নি। কারণ এখনকার মতোন বঙ্গবাজারের দৌড় তখন ছিল না, পোশাক সম্পর্কে সচেতনও ছিলাম না আমি। আমাকে দলবল নিয়ে এলো প্যাট্রিস লুবুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হোস্টেলে। এখানে এসে দেখি চারদিকে বাঙালী গিজগিজ করছে। পুরনো অনেককেই কিছুটা উন্নাসিক বলেও বোধ হলো আমার। হতেই পারে। প্রতি বছরই তাদের এমন নতুন নতুন মুখের সাথে পরিচয় ঘটে কীনা!

তবে মূহূর্তেই সবার আন্তরিকতা আমাকে ভুলিয়ে দিল, একটুও দেশের জন্য মন কেমন করলো না আমার। ভাবলাম, এখানে আমার মোটেও খারাপ লাগবে না দেশের জন্য। আমি যে বিদেশে এসেছি, তাও মনে হয় ভুলে গেছিলাম। ভাগ্যে আরও অনেককিছুই যে তখনও অপেক্ষা করেছিল, কে জানতো!

আমার গৌরীপুরের শিশিরদার রুম, ছোটবেলা থেকেই তাকে চিনি। এই শিশিরদা ছাড়াও গৌরীপুরের আরও একজন দাদা (শান্তিময় চক্রবর্ত্তী) থেকে গেছেন রাশিয়ায়। তার বউ ছিল রুশ। মনে আছে, ছোটবেলায় ঘরে সাদা বিছানার চাদর টাঙিয়ে সেখানে প্রজেক্টরের সাহায্যে শান্তিদা আমাদের সবাইকে তার বউ-বাচ্চাকে দেখিয়েছিল। সেই ছোটবেলায় তখন বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে সেগুলো দেখেছিলাম। আর এতো বছর পর সেই দেশটাতেই আমি।

শিশিরদা রান্না করেছেন মাছ-ভাত। আমার মনে পড়লো, অনেকক্ষণ খাওয়া হয়নি। খিদেটা চাগা দিয়ে উঠলো। সবাই খেলাম। মনে হলো, এমন অপূর্ব রান্না আমি কখনও খাইনি। যাক, খাওয়া নিয়েও তাহলে কষ্ট হবে না এই দেশে, এমনটিই ভাবলাম।

খাওয়া-গল্প শেষে আমাকে আবার হোটেলে ফিরিয়ে দিয়ে গেল ওরা। রুমে ফিরে এই প্রথমবারের মতোন নিজেকে খুব একা মনে হলো, দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো, মায়ের কথা মনে পড়লো। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম, কিন্তু কেউ শুনতে পেল না, এমনকি হোটেলে আমার রুমের পাশেই যে ছেলেগুলো উঠেছে, তারাও জানলো না। সেই যে শুরু হয়েছিল আমার কান্না, তা চলেছে দীর্ঘ সাড়ে নয় বছরের প্রবাস জীবনেই। বিশেষ করে সকালে ঘুম ভাঙতেই এক অদ্ভুত বিষন্নতা, একাকিত্ব এসে ভিড় করতো পুরো মন জুড়ে, কিছুতেই সামাল দিতে পারিনি আমি। এখনও বিদেশের সকালটার কথা মনে হলেই বুকের ভেতর বাসা বাঁধে আমার সেই বিষন্নতার মুহূর্তগুলো।

পরদিন হোটেলের পাশে একটা হোস্টেলে থাকা আমারই সহপাঠি শাওন-রুমার সাথে দেখা। দেড়মাস আগে এসে ওরা ততদিনে পুরনো হয়ে গেছে। রুমা তো এমন ভাব করলো যে, সে বছর পাঁচেক আগে মস্কো এসেছে। ঢাকা বিমানবন্দরের সেই পট পট করা আমি ওর কাছে নস্যিমাত্র হয়ে গেলাম! মস্কোর ছেলেগুলোও বলিহারি, রুমা বলতে দেখি সবাই অজ্ঞান! আমাকে পাত্তাই দিলো না কেউ, কে জানে তখন পাত্তা দিলে আজ হয়তো আমি অন্য গল্প লিখতাম!

এদিকে দেশ থেকে দুমাস ধরে কষ্ট করে শিখে আসা রুশ জ্ঞান দেখি কোন কাজেই লাগছে না। মনটা বেজায় খারাপ খারাপ লাগছিল। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে জানালা দিয়ে তাকাতেই মনটা ভরে উঠেছিল। সেদিনই জানালা থেকে দেখেছিলাম নিচে সাদা সাদা বরফ। তাহলে এটাই সেই সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পেঁজা তুলোর মতো বরফ’ ? (চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.