ফিস্টুলা – অভিশপ্ত জীবনের আরেক নাম

Fistulaপুন:প্রকাশিত

বাচ্চাদের মতোন বিছানায় রাবার ক্লথ বিছানো, কী প্রচণ্ড এক অস্বস্তি সবার চোখে-মুখে। সারাক্ষণ ভিজে থাকে কাপড়, কোথাও বসা যায় না, গন্ধে কেউ কাছে আসে না। স্বামী ছেড়ে গেছে অনেক আগেই, নিজের মা পর্যন্ত দূর দূর করে। এমন অভিশপ্ত জীবন
বরগুনার ফাতেমার একার নয় আজ, শত শত মেয়ের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে ফিস্টুলা নামক সমস্যার কারণে।

ফাতেমা বলছিলেন, ‘সন্তান জন্মের পর থেকে কেবলই প্রস্রাব ঝরছে। সারাক্ষণ ভিজে থাকে কাপড়চোপড়। এ অবস্থায় স্বামী আর ঘরে রাখতে চাইলো না, তাড়িয়ে দিলো। মরা সন্তান জন্ম হয়েছে বলে জীবনে মা ডাকও আর শুনতে পেলাম না। সন্তানও নেই, সংসারও নেই। স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে ফিরেও শান্তি নেই, সবাই আমাকে জঞ্জাল মনে করে। দূর দূর করে, ঘেন্না করে ঘরের এক কোণায় ঠাঁই দিয়েছে। বিছানা ভিজে যাওয়ার ভয়ে কারো ঘরে গিয়ে খাটে বসি না। আমারে দেখলেই সবাই নাকে কাপড় দেয় তাই কারো সঙ্গে কথাও বলি না।’

ফাতেমা বর্তমানে নগরীর ১৮/২ বকশী বাজারে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগী চিকিৎসা, আরোগ্য ও পুনর্বাসন প্রকল্পের কার্যালয়ে কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে কথা হলো, আরো কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে। কথা বলতে প্রথমে খানিকটা লজ্জা পেলেও এক সময় এই নারীদের কথায় পেয়ে বসে। একজন যখন চোখের পানি ফেলছেন, তখন অন্যদের চোখেও পানি। সমাজচ্যুত এই নারীদের জীবনের কাহিনী সবারই প্রায় একই রকম। বেশির ভাগ নারীরই স্বামী তালাক দিয়ে আরেক বিয়ে করেছে। যেসব নারীর স্বামী এখনও তালাক দেয়নি তাঁরাও নিশ্চিত নন স্বামী কতদিন রাখবেন। স্বামী আবার বিয়ে করবে না তারও নিশ্চয়তা নেই। স্বামী আবার বিয়ে করতে চাইলেও কিছু করার নেই তাও জানিয়ে দিলেন এই নারীরা।

সমাজচ্যুত হওয়ার পেছনে এই নারীরা কতটুকু দায়ী এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই এই নারীদের। অনেকে দীর্ঘ ১৫/১৬ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে সমাজে অযাচিতভাবে বেঁচে আছেন। এতোদিন ভাগ্যের এ পরিণতির জন্য নিজের ভাগ্যকেই দায়ী করে আসছেন। অনেকে ভেবেই নিয়েছিলেন, এ ধরনের পরিণতি একমাত্র তাঁর জীবনেই ঘটেছে। তাঁরা জানতেনই না যে এর কোনো চিকিৎসা আছে। কিন্তু অনেক জায়গা ঘুরে পরে এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে জানতে পেরেছেন, এ সমস্যার জন্য তাঁদের কোনো দোষ নেই। শুধু সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নানান জটিলতার শিকার হয়ে তাঁরা আজ এ অবস্থায়।

ফাতেমা বলেন, ‘বিয়ার আগে তো আমার শরীরে কোনো খুঁত আছিলো না। সন্তান হওয়ার সময় আমারে হাসপাতালে না নিয়া বাড়িতে ফালাইয়া রাখছিলো বইলাই আমার এই অবস্থা। অন্যের অবহেলায় আজ আমার জীবনের এই হাল।’

নারীদের অনেকেই জানালেন, প্রস্রাবের জন্য দীর্ঘদিন ন্যাকড়া ব্যবহারের কারণে প্রজনন অঙ্গে ঘা হয়ে গেছে। গরমে জ্বালাপোড়া বাড়ে। একটু পরপর ন্যাকড়া পাল্টাতে হয়। এই ন্যাকড়া পুকুরে বা টিউবয়েলে ধুতে গেলেও পরিবারের সদস্যদের গঞ্জনা শুনতে হয়। প্রস্রাব বেশি হবে বলে এই নারীরা পানি কম খান। এতে করে কিডনিসহ অন্যান্য সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা। এই নারীরা লজ্জায় কারো সামনে কাঁদতেও পারেন না। তাঁরা জানালেন, তাঁদেরকে কাঁদতেও হয় লুকিয়ে।

ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারীরা এসব নানা বিড়ম্বনার কথা ভেবে এটিকে লুকানোর জন্য সারাক্ষণ তটস্থ থাকেন। এতে করে একধরনের আতঙ্ক সবসময় তাদের ঘিরে থাকে।

একজন বলেন,‘স্বামী তো দূরের কথা, নিজের মা’ই আমারে দূর দূর করে। গন্ধে কাছে আয় না।’

চিকিৎসকদের মতে, প্রসব ব্যথা ১২ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হলে বা বিলম্বিত প্রসবের সময় সন্তানের মাথা জরায়ুর মুখে আটকে থাকার ফলে মূত্রথলী এবং পায়ুপথ চাপের মধ্যে থাকে। ফলে এইসব জায়গায় রক্ত চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং পচন ধরে এবং কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে ফুটো তৈরি হয়। মূত্রথলী ও যোনী পথের মধ্যে অস্বাভাবিক সংযোগ হলে তাকে ভেসিকোভ্যাজিনাল ফিস্টুলা (ভিভিএফ) এবং পায়ুপথ ও যোনী পথের মধ্যে সংযোগ হলে তাকে রেকটোভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা (আরভিএফ) বলা হয়।

ফিস্টুলার কারণ: ফিস্টুলা হওয়ার জন্য কম বয়সে বিয়ে এবং তাড়াতাড়ি সন্তান নেওয়া, গর্ভ পরবর্তী সেবার অভাব, বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত প্রসব, প্রসব সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, দক্ষ ধাত্রী এবং হাসপাতালে ফিস্টুলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারীর অনুপস্থিতি বা অভাবসহ বিভিন্ন কারণ দায়ী। এছাড়া হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত প্রসবেও ফিস্টুলা হতে পারে।

ফাতেমার বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সে। প্রসব ব্যথা উঠার পর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। দাই (ধাত্রী) বলেছেন, বাড়িতেই সন্তান হবে। এভাবে চলে যায় তিন দিন। তারপর সন্তান হলেও সে আর পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেনি। স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে না পারা, অনবরত প্রস্রাব ঝরাসহ বিভিন্ন অজুহাতে একসময় ফাতেমাকে তার স্বামী তালাক দেন। তবে ফাতেমা বুঝতে পারেন না এক্ষেত্রে তাঁর দোষ কোথায়?

২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ফাতেমার ফিস্টুলার অস্ত্রোপচার হয়। ফিস্টুলা আক্রান্ত অনেক নারীর কয়েকবার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। ফাতেমার আবার যে অস্ত্রোপচার হবে তার তারিখ ঠিক হয়নি। তাই এ সময়টুকু তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্রে কৃষিকাজের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। টাকার হিসাব মেলানো, নাম লেখাসহ অন্যান্য পড়াশোনাও করছেন ফাতেমা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ইউএনএফপিএ’র সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২৮ জন নারীর থাকার ব্যবস্থা আছে। সব বিছানার পুরোটাতে নীল রংয়ের রাবার ক্লথ বিছানো। কেন্দ্রের ভেতরেই বেকারি, সেলাই, রান্না, সবজি বাগান তৈরি ও হাঁস মুরগি পালনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে এই নারীরা এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হালিমা সন্তান জন্ম দিতে মা’র বাড়ি গিয়েছিলেন। দাই জেদ করে হালিমাকে হাসপাতালে নিতে দেয়নি। হালিমা বলেন,‘ সবাইরে কত বলছি আমারে সদর হাসপাতালে নিয়া যান। পরিচিত একজন আছে, টাকা লাগবো না বইলাও জানাইছিলাম। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না। পরে পেটের মধ্যেই বাচ্চাটা মইরা গেলো। টানাহেঁচরা কইরা বার করলো আমার সন্তানরে। আর তারপর থাইক্যাই আমার এই হাল।’

হালিমার আগেও একবার ফিস্টুলার অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে ভালো হননি। ২০১১ সালে পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ শেষে একটি সেলাই মেশিন পান। তারপর থেকে বাড়িতে বসে সেলাই করে হালিমা ১০ হাজার টাকা জমিয়েছেন। হালিমার স্বামী এখনও হালিমাকে তালাক দেয়নি। তবে হালিমা এখন আর তা নিয়ে চিন্তিত নন। হালিমার ভাষায় ‘এখন স্বামী ছাইড়া দিলেও আর ভয় পাই না।’

পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ উইমেন্স হেলথ্ কোয়ালিশন। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৮২ জন নারীকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এদের মধ্য থেকে ৮২ জন নারী কমিউনিটি ফিস্টুলা অ্যাডভোকেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা নতুন রোগীদের খুঁজে বের করেন।

এ প্রকল্পের একজন সমন্বয়কারী জানান, চিকিৎসা এবং প্রশিক্ষণ শেষে এই নারীরাই যখন এক মুখ হাসি নিয়ে বলেন, তাঁদের আর প্রস্রাব পড়ছে না সেই মুহূর্তটিই আমাদেরকে নতুন করে কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়। কুমিল্লার শাহিনাসহ কয়েকজন অস্ত্রোপচারের পর সন্তানেরও মা হয়েছেন বলেও তিনি জানান।

দেশে জাতীয় পর্যায়ে ফিস্টুলা বিষয়ে কোনো জরিপ এ পর্যন্ত হয়নি। তবে ফিস্টুলা নিয়ে কর্মরতরা বলছেন, গত ১০ বছরে দেশে ফিস্টুলা রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। ফিস্টুলা প্রতিরোধ না করে শুধু চিকিৎসা দিয়ে এ জটিলতা দূর করা সম্ভব হবে না।

কোথায় সেবা পাওয়া যাবে: বর্তমানে ইউএনএফপিএ’র সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাতীয় ফিস্টুলা সেন্টারসহ দেশের ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইউএসএআইডি’র সহায়তায় ঢাকা এবং যশোরের আদ-দ্বীন হাসপাতালে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ল্যাম্ব হাসপাতালে এনজেন্ডারহেলথ্ ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। নগরীতে এই রোগীদের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রও পরিচালিত হচ্ছে।

শেয়ার করুন: