মামলা নয়, বিতর্ক ও সংলাপই হোক নতুন সমাজের ভিত্তি

মাসকাওয়াথ আহসান:

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টাই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করেছেন; কেউ উচ্চ শিক্ষা অর্জনে কেউবা পেশাগত কাজ করতে গিয়ে। তারা প্রত্যক্ষ করেছেন, বাক-স্বাধীনতার কী রকম মুক্তচর্চা হয় সেখানে। পশ্চিমে সরকার সমালোচনা তো নাগরিক সমাজের নিয়মিত চর্চার বিষয়। সরকারের কাজে সহমত অনুগত নাগরিক সমাজের দেখা পাওয়া ভার সেখানে।

আর গোপালগঞ্জের ভিলেজ পলিটিক্যাল কালচার হচ্ছে, সবাইকে মাতবর হাসিনার সঙ্গে একমত হতে হতো; ভিন্নমত পোষণ করলেই তকমা, হামলা, মামলা, কারাগার, গুম, খুন, আয়নাঘর। আওয়ামী লীগ পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র রাজনৈতিক দল যার প্রধান টেলিভাইজড বক্তৃতায় প্রতিপক্ষকে গালি দিতে শেখাতেন। ভিলেজ পলিটিক্সের অস্থি ধারণ করে হাসিনা ডকট্রিনের আওয়ামী লীগের প্রধান কৌশল হলো প্রতিপক্ষকে গান্ধা কইরা দেয়া। এই অশালীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে মুক্তি খুঁজতেই বাংলাদেশের তারুণ্য দেশকে হাসিনার আওয়ামী লীগের অভিশাপ মুক্ত করেছে।

৫ অগাস্টের পরের নতুন বাংলাদেশে সরকার সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস। সেখানে প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে কোন এক অতি উৎসাহীর করা হত্যা মামলা অত্যন্ত বেমানান এক কৌশল। আওয়ামী লীগের ভীষণ গ্রাম্যতার গন্ধ এই মামলায়।

গ্রাম ও গ্রামের মানুষ ও নিসর্গ খুব সুন্দর। অসুন্দর গ্রামের মাতবরের ভিলেজ পলিটিক্স, অন্যের বেড়ায় ফুঁচকি দিয়ে প্রাইভেসি ক্ষুণ্ণ করা আর পুকুর ঘাটে ‘কইয়া দিমু’র আদি রসাত্মক আলাপ। জমি দখলের জন্য খুনাখুনি, চর দখলের জন্য বংশানুক্রমিকভাবে চোখের বদলে চোখ স্টাইলের চর দখলের লড়াই। এই সবগুলো বৈশিষ্ট্য আওয়ামী লীগের অন্তঃসলিল প্রবাহ; তাই এ লেখায় ‘গ্রাম্য’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। আপাত আধুনিক পোশাক, শহুরে ওভার স্মার্টনেসের খোলসের ভেতরে সেই কুচুটে গ্রাম্যতার কলকল আমরা প্রায়শই দেখি।

অন্যদিকে গ্রামে বসবাসকারী অনেক মানুষ স্পষ্টচিন্তার বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠেন জীবন চর্যায় ও আচরণে।
জেড আই পান্না একজন দক্ষ আইনজীবী, প্রবীণ গার্ডিয়ান এঞ্জেল। সবশেষ জুলাই বিপ্লবকালে ডিবি অফিসে আটকে রাখা ছাত্রনেতাদের মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই লড়েছেন তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, দেশের সেবা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ব্যবসায়ীদের অপছন্দ করেছেন। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, ঐ স্বপ্নের পিছেই জীবন ব্যয় করেছেন। অত্যন্ত সচেতনভাবেই আওয়ামী লীগের পচন প্রক্রিয়ায় পাশ দিয়ে নাক ঢেকে সোজা হেঁটে গেছেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে।

একজন সৎ, প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে বোঝা অসম্ভব যে জুলাই বিপ্লবের এই জেনজি সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বৈষম্যের স্টিম রোলারে পিষ্ট হয়েছে, অপমানিত হয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। ফলে তারা আর কোনভাবেই এই আওয়ামী দলীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুভ কোন বোধ বলে মানতে অপারগ।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন পাকিস্তানের চেতনা ঠিক যেভাবে বায়ান্ন-বাষট্টি-ঊনসত্তর-একাত্তর হয়ে বৈষম্য, নিগ্রহ, ঘাতক পন্থার মাধ্যমে তরুণ জেড আই পান্নার কাছে প্রত্যাখাত হয়েছিলো; এ সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। জিন্নাহ’র জন্মদিন, মৃত্যুদিন, মুসলিম লীগের একজন প্রবীণের কাছে যত আদরণীয় পালনযোগ্য দিন ছিলো, তরুণ জেড আই পান্নার কাছে তা ছিলো না। কারণ জিন্নাহর আনা ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা’ হয়ে উঠেছিলো তার জীবনে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীর জীবনে একইরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই স্বাধীন চেতা; সার্বভৌমত্বই তার প্রধান স্বপ্ন। জেড আই পান্না তাই পাকিস্তান উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। আর একালের তরুণেরা ভারত সমর্থিত আওয়ামী দলীয় উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে ৫ অগাস্ট স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অনুবাদ করেছে নিজেদের জীবনে।
জেড আই খান পান্না আইনের মানুষ, যুক্তিনিষ্ঠ; তাঁর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করে আবার একসঙ্গে বসে চা খাওয়া যায়। তাঁকে বোঝানো যায়, পৃথিবীর কোন সভ্য ও কল্যাণ রাষ্ট্র বারো মাসে তের দিবস পালন করে না, দেশপ্রেমকে কেবল দিবসভিত্তিক পূজা-নামাজের রিচুয়ালে আটকে না রেখে; মাত্র একটি-দুটি জাতীয় দিবস পালন করে তারা। বরং দেশপ্রেমের প্রতিফলন ঘটায় প্রতিটি নাগরিকের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর অকল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতেই যত দেশপ্রেমের লিপসার্ভিস দিয়ে দেশ ডাকাতি ও ধাপ্পাবাজির অপকৌশল।

আইনজীবী পান্নার ভিন্নমত প্রয়োজনীয় এন্টিথিসিস; যা চিন্তার সিনথেসিসকে থিসিসে পৌঁছে দিতে পারে। উনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার মতো একই ভুল আওয়ামী লীগ করেছিলো দার্শনিক ফরহাদ মাজহারকে গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে অপমান করে। যে মানুষের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্ক করা যায়; সেই এথেন্সের প্রাচীন গিমনেসিয়ামের মতো করে; তাকে কেন মামলা কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার হয়রানির মতো গোপালগঞ্জের পাটগাঁতির কুস্তি কালচারে যেতে হবে!

হাসিনার আলফাডাঙ্গা মার্কা স্থূল অপরাজনৈতিক শাসন ও ত্রাসন সংস্কৃতির কালো ছায়া থেকে বেরিয়ে আধুনিক, যুক্তিবাদী, গণতান্ত্রিক ও সভ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রবর্তনই আমাদের এ মুহূর্তের আকাংক্ষা। মামলা নয়, গোয়েন্দা সংস্থার গুলাগ নয়; বিতর্ক ও সংলাপই হোক নতুন সমাজের ভিত্তি।

 

মাসকাওয়াথ আহসান: রম্যলেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: