কল্পনার নির্যাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই

সুপ্রীতি ধর:

কল্পনা নামের ১৩ বছর বয়সী একটি কিশোরী মেয়ে। প্রথম দেখায় মনে হবে কী সুন্দর একটি মেয়ে, হয়তো হেসে হেসে কথা বলছে! না, ও হাসেনি। ওর সামনের দাঁতগুলো নেই, মুখে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। ও আসলে কাঁদছে! হাতে-পায়ে বীভৎস ক্ষত। ওর করুণ চোখের আর্তি আর কান্না ভয়াবহ রকমের ট্রমাটাইজ করে দিয়েছে অনেককেই। বেসরকারি চ্যানেল ৭১ টেলিভিশন এর সাংবাদিক ইশতিয়াক ইমনের করা এই রিপোর্টটিতে চিরাচরিত গৃহকর্মি নির্যাতনের ঘটনা। পুরো বিবরণ পড়ার পর থেকেই একধরনের অবশ বোধ কাজ করছে।

রিপোর্ট অনুযায়ী, সাড়ে চার বছর ধরে কল্পনা রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় দিনাত জাহান আদর নামের এক তরুণীর বাসায় কাজ করতো। সেখানেই সে দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে এক ভিডিও বার্তায় তার অবস্থার কথা জানাতে পেরেছিল। সেখান থেকেই তাকে উদ্ধারের পর্ব শুরু হয়।

৭১ টিভির সাংবাদিক ইমন ইশতিয়াকের রিপোর্টের ভিত্তিতে ভাটারা থানার পুলিশ গতকাল শনিবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার একটি বাসা থেকে কল্পনাকে উদ্ধার করে। আটক করা হয় দিনাত জাহানকে। সবশেষ খবর অনুযায়ী তাকে একদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এখানেই আপত্তি। এই নির্যাতন প্রমাণ হলে ওর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা চাই। দিনাতের ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি দেখে কেউ কোনদিন ভাবতেও পারবে না যে ওর ভিতরে এরকম নৃশংস একজন মানুষ আছে। ওর চেহারা দেখে কেউ যেন কোনরকম সহানুভূতি না দেখায়, সেদিকেও সোচ্চার থাকতে হবে সবাইকে।

রিপোর্টে জানা যায়, দিনাত জাহান নির্যাতন করে কল্পনার সামনের চারটি দাঁত ভেঙে দিয়েছে। হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাঁকার ক্ষতগুলোর কোনো কোনোটা শুকিয়ে টান ধরেছে। কোনটা এখনও দগদগে। বুক, পিঠসহ সারা শরীরে মারের চিহ্ন। সবশেষ রিপোর্টে ওকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) দেখলাম, সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সংক্রমণ রোধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

এই সেই নির্যাতক দিনাত জাহান। কে বলবে সে এ ধরনের নৃশংস, নারকীয় কাজ করতে পারে?

চিকিৎসকরা তাদের সর্বোচ্চ করবেন বলে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আইনি ও চিকিৎসা সহায়তাসহ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের কর্মকর্তা এই ঘটনায় অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরাও আশাবাদী। অন্তত এইবার যেন একটা পদক্ষেপ নেয়া হয়!

৭১ টেলিভিশনের ওই প্রতিবেদনে কল্পনা জানায়, দীর্ঘদিন ধরে তাকে মারধর করা হয়েছে। পাশাপাশি দিনে একবেলা খাবার দেওয়া হতো। চুল স্ট্রেইট করার যন্ত্র দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো তাকে। বেত দিয়ে মারধর করা, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়া এবং বন্দী করে রাখা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছে।

সিলেটের হবিগঞ্জের মেয়ে কল্পনা। তার পাঁচ বোন ও এক ভাই। এই ঘটনায় কল্পনার মা আফিয়া রোববার বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০২০) এর অধীনে ভাটারা থানায় দিনাত জাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

আমার প্রশ্ন, এই সাড়ে চার বছরে নির্যাতনকারী বলে অভিযুক্ত দিনাতের পরিবারের কেউ কি জানতে পারেনি এই কথা? তাদের চোখে পড়েনি? পড়লে কেন কোন পদক্ষেপ কেউ নেয়নি?  কল্পনার মা-বাবাই বা কেন মেয়েকে এভাবে খোঁজখবর নেয়া ছাড়াই ফেলে রেখেছে? মানুষের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য কি আসলেই নেই?

উপরন্তু অভিযুক্ত দিনাতের বড়বোন নাকি কল্পনার মা আফিয়াকে দুই লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টির আপোস করতে প্রস্তাব দিয়েছে। এটা আরেকটি অন্যায়। এই বোনকেও আইনের আওতায় আনা উচিত। আফিয়া এক্ষেত্রেও মনে হয় মামলা করতে পারেন ওই বোনের বিরুদ্ধে। আরও শুনলাম, দিনাত একাই থাকতো, তার নির্দিষ্ট কোন আয়ের উৎস না থাকলেও প্রায়ই বিদেশে যেত। সাংবাদিকদের সামনে এখন অনেকগুলো সুযোগ সাংবাদিকতার। দিনাতসহ ওর পুরো পরিবারের আয়ের উৎস নিয়ে খোঁজ করলেও ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো’ অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।

আগামী দিনগুলোতে কল্পনার সুচিকিৎসা এবং ওর সুস্থ জীবনে ফিরে আসার পাশাপাশি অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করার খবরসহ আরও অনেককিছু জানার অপেক্ষায় রইলাম।

 

সুপ্রীতি ধর: প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার

শেয়ার করুন: