একজন মুরাদ হাসান এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরুষতান্ত্রিকতা

সুমু হক:

একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের আদৌ কতটা সম্মান করে কিংবা তাঁদের কল্যাণের প্রতি কতখানি মনোযোগী হয়ে থাকে, তার অন্যতম একটি মাপকাঠি তার সরকার কিংবা বলা ভালো তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার।
তেমনি একটি রাষ্ট্রের সরকার যখন সেই রাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি নাগরিক যেই নারী সমাজ, তাঁদের প্রতি অত্যন্ত বিদ্বেষমূলক, ইংরেজিতে যাকে আমরা মিসোজিনিস্টিক মনোভাব বলে থাকি তা পোষণ করে, তখন তা বোঝার জন্যে সে রাষ্ট্রের সরকার প্রধান এবং তার অধীনে থাকা সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের আচরণই যথেষ্ট। তা সেই কর্তাব্যক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পই হোন, কিংবা বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই হোন।
শেখ হাসিনার জায়গায় অন্য যেকোনো সংবেদনশীল, রুচিবান ব্যক্তি হলে শুধুমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন মিসোজিনিস্টিক, কদর্য মানসিকতার ব্যক্তির সাথে এক সারিতে তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে বলেই হয়তো সেই ব্যক্তি লজ্জিত হতে পারতেন, কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান কর্ণধারের কাছ থেকে সেটা প্রত্যাশা করা যে নিতান্তই অবাস্তব কল্পনা, সেকথা বলাই বাহুল্য।

তার কারণ নারীরাও যে পুরুষতান্ত্রিক একটি সমাজব্যবস্থার অংশ হয়ে ভীষণরকমভাবে পুরুষতন্ত্র এবং পুরুষতান্ত্রিক শোষণকে জিইয়ে রাখতে পারেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধান দলগুলোতে অংশ নেয়া অধিকাংশ নারীরাই তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
একারণেই আমরা দেখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা গত দেড় দশক ধরে বিভিন্ন সময় একের পর এক নারীর প্রতি অবমাননাকর, অসম্মানজনক আচরণ করে পার পেয়ে এসেছেন বিন্দুমাত্র কোন শাস্তি কিংবা প্রতিফল ভোগ না করেই।
আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ তো রীতিমতো পরিচিতিই পেয়ে গেছে ধর্ষক লীগ হিসেবে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রীর সুস্পষ্ট সমর্থন ছাড়া কি এসব কোনদিন সম্ভব হতো?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আঁতাত করে বাল্যবিবাহ আইনের পরিবর্তন, দেশের পাঠ্যপুস্তকগুলোর ইসলামিকরণ, সমস্ত দেশে কওমি মাদ্রাসার প্রসার এবং এই বিশেষ ধরণের মৌলবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নানারকমভাবে দেশের নারীসমাজের পায়ে বেড়ি তো পরিয়েই চলেছেন, অন্যদিকে তার সাথে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের নারীবিদ্বেষও সীমাহীন মাত্রা ধারণ করে চলেছে।

গত ২ ডিসেম্বর নাহিদরেইনস নামক একটি অনলাইন লাইভে এসে তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার নাতনী জায়মা রহমানকে নিয়ে যে লিঙ্গবাদী, কুৎসিত যৌন হয়রানিমুলক মন্তব্য প্রদান তার সাম্প্রতিক নমুনা মাত্র। এটা হয়তো প্রকাশ পেয়েছে বলে আমরা জানতে পারছি। কিন্তু একইরকম বিদ্বেষমূলক মনোভাব যারা পোষণ করে তাদের দিয়েই যে ক্ষমতাসীন সরকার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, তা বলাই বাহুল্য।
মুরাদ হাসান নামক অত্যন্ত নিম্ন রুচির পুরুষতান্ত্রিক একটি দ্বিপদ শ্বাপদ কী মন্তব্য করেছে তার পুনরাবৃত্তি এখানে অনাবশ্যক, এরই মধ্যে প্রায় সবাই তা জেনে গেছে, শুনে ফেলেছে, তাছাড়া তাকে আমি এখানে অনর্থক পাবলিসিটিও দিতে চাইনা। আর তার রুচি বিষয়ে যদি কারও বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহের অবকাশ থেকে থাকে, তাহলে গতকাল ফাঁস হওয়া তার সাথে একজন অভিনেত্রী টেলিফোন সংলাপ সেই সন্দেহ নিরসনের পক্ষেও যথেষ্ট।

না, আমি একটি স্বাধীন দেশে যে কোন স্বাধীন নাগরিকের ব্যক্তিগত টেলিফোনালাপে আড়িপাতার পক্ষপাতী নই। কিন্তু একইসাথে এ কথাও সত্য যে সেই ব্যক্তিটি যখন একজন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সেই ক্ষমতার দম্ভে যখন তিনি একজন নারীকে তাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না করে ডিজিএফআই, এনএসআইসহ রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে আসার হুমকি দেবার স্পর্ধা করেন, তখন তা জানার অধিকার রাষ্ট্রের জনগণের আছে বৈকি! ভুলে যাবেন না, সেই প্রতিমন্ত্রীর বেতন-ভাতা, সমস্ত খরচ, সেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যাবতীয় খরচ সবকিছু কিন্তু চলে এই দেশের জনগণের আয়করের টাকাতেই। তাই ওই মুরাদ হাসান শুধু কেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের মানুষের চাকরিই করেন।

আর মুরাদ হাসানের ভাষার অশ্লীলতার বিষয়ে কিছু আর নাই বললাম! সেই অনলাইন লাইভে আরো বহু বহু বিবমিষাকর মন্তব্য এই নরপশুটি করেছে। তার খানিকটা শুনে পুরোটা শোনার রুচি হয়নি আমার। তবে টেলিফোনালাপটির খানিকটা এই লেখার প্রয়োজনে শোনার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, আমি যদি মুরাদ হাসানের কন্যা হতাম, তবে এইরকম একটা লোককে নিজের পিতা হিসেবে পরিচয় দিতে অস্বীকার করতাম। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি, তেমন কিছুই হয়তো ঘটবে না। তার স্ত্রী-কন্যা-পুত্রবধূরা চিরকাল যেমন হয়ে এসেছে তেমনিভাবে হাসিমুখে ফেসবুকে আদর্শ সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপন করে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেও তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তার কারণ এর আগে তাঁর ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা ধর্ষণ তো বটেই, নারীর প্রতি অবমাননাকর আরো অনেক কাজই করেছে, অনেক নোংরা আচরণই করেছে, এবং সেসব করে বছরের পর বছর ধরে পারও পেয়ে গেছে। এই প্রধানমন্ত্রীর দলের গালিবাজ গ্রুপই তো এদেশে অনলাইনে নারীদের নিয়ে অশ্লীলতার জনক এবং তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে উচ্চশিরেই বিরাজমান। শুনেছি তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে স্থানও করে নিয়েছেন গালাগালির ওপর বিশেষ ডিগ্রি লাভের কারণে।
এদেশে আনভীরের বিচার হয় না, নিহত মুনিয়াদের চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া চলে শুধু।

খুব ভালো করেই জানি, আগামী দিন সাতেকের ভেতর চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির চৌদ্দ পুরুষ ধরে যত নারীরা আছেন, সবার চরিত্র নিয়ে রসালো গসিপে মিডিয়া সয়লাব হয়ে যাবে আর তার ভেতর হারিয়ে যাবে মুরাদ হাসান নামে একজন ইতর রাজনীতিবিদের গল্প। আর নাহিদরেইনস নামের সেই লাইভে অশ্লীল হাসি হেসে যেতে থাকা সেই অপদার্থ টকশো সঞ্চালক আরও রসালো কোন বিষয়ের খোঁজে নতুন কোন নারীর চরিত্র নিধনে নামবে। ওকেই বা কী দোষ দিই বলুন! আমজনতা যে ওইটাই খায়!

একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটির দোকানি পর্যন্ত, এই যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের রুচি, তখন আরেক বছরের মতো নারী এবং কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জাতিসংঘের কর্মসূচি উপলক্ষে অনুষ্ঠান শেষ করে ক্লান্ত আমি এবারকার মতো ছুটি নিই।
২০৩০ এর ভেতর নাকি এই সহিংসতা নির্মূল করা যাবে। তেমনটাই তো শুনেছি।

বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর পর কলকাতার রক্ষণশীল মুসলমান সমাজ নাকি তাঁকে সাধারণ কবরস্থানে সমাধিস্থ করতে পর্যন্ত দেয়নি। তাই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় গঙ্গা নদীর তীরে পানিহাটি গ্রামে। তা সে তো সেই ১৯৩২ সালের কথা। এতোদিন পরও পরিস্থিতি কি খুব বেশি পাল্টেছে? আজও অবধি আমরা কজন জানি সেই কঠিন সত্যিটার কথা?
আর এই বাংলাদেশেই বা কতটা পাল্টেছে নারীর অবস্থান? এখনো এই দেশে মাথায় ঘোমটা না দিলে নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্যে একজন নারীর মনোনয়ন পাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়! এখনও এই দেশে ধর্ষণের শিকার নারীর বিচার পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে তার চরিত্রের ওপর। তো, এই দেশে তো মুরাদ হাসানের মতো লোকেরাই মন্ত্রিত্ব পাবে! তার কথার আবার শ্লীল অশ্লীল কী! নারীর আবার কোন অধিকার আছে নাকি!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.