বলিতে আপন দুঃখ, পরনিন্দা হয়

ফাহমিদা নীলা:

ভাবী, আসলে যে কীভাবে, কোথা থেকে শুরু করবো, বুঝতে পারছি না।

ইতস্তত ভঙ্গিতে তৃতীয়বারের মতো একই কথা বলে নড়েচড়ে বসলেন মিসেস জামান।

টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট নিয়ে আনমনে খেলছে তাঁর হাতদুটো। মাঝে মাঝেই বাম হাতটা তুলে বাম গালে আলতো করে ছোঁয়াচ্ছেন তিনি। বিশ ডিগ্রীতে রাখা এয়ার কন্ডিশনারের বাতাসেও তাঁর কপালখানি বারবার ঘেমে উঠছে।

আমি চুপচাপ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি নিজে ইচ্ছে করেই সবার শেষে চেম্বারে ঢুকেছেন। যদিও আমি আমার এটেন্ডেন্ট মেয়েটাকে বলেই রেখেছিলাম, উনি এলেই যেন সুযোগমতো ওনাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় দ্রুত। হয়তো একটু আরাম করে আলাপ করবেন বলেই সবশেষে ঢুকেছেন, যেন কোনো তাড়া না থেকে।

আমি তাঁকে সামলিয়ে নেয়ার সময় দিলাম। উনি একটু ধাতস্থ হয়ে নিজে থেকেই আস্তে আস্তে কথা বলুক। আমার মনে হয়, এসব ক্ষেত্রে গাইড করলে ক্লায়েন্ট ঠিকমতো মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তিনি বেশ কয়েকবার কথা শুরু করার এটেম্পট নিয়েও আবার থেমে গেলেন। এই ফাঁকে আমি তাঁকে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলাম। তাঁর চেহারা খানিকটা আটপৌরে হলেও পোষাক, কথাবার্তা, আচার-আচরণে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। উনার হাজবেন্ড এই শহরের ক্ষমতাধর বিজনেস আইকনদের একজন। উনি নিজে টুকটাক লেখালেখি করেন, সাথে বিভিন্ন সোশ্যাল ওয়ার্ক। শহরের একটা নামীদামী নারী সংগঠনের কর্ণধার তিনি। সপ্তাহ দুয়েক আগে একটা এলিট ক্লাবের পার্টিতে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। সেই সূত্র ধরেই তিনি আমাকে ভাবী বলে সম্বোধন করছেন, তা না হলে এখানে আসা প্রায় সবাই আমাকে ম্যাডাম বলেই ডাকেন।

-ভাবী, আমি শুরু করি।

-আমি আপনার শুরুর অপেক্ষাতেই বসে আছি। নিঃসঙ্কোচে বলুন।

-ভাবী, আমি যা বলবো, সেটা আপনার আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে আশা করি।

-এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন। ক্লায়েন্টদের প্রাইভেসির ক্ষেত্রে আমি খুবই প্রফেশনাল। এ নিয়ে আপনার সন্দেহের অবকাশ নেই।

উনি আবারও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। আমি এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। ভদ্রমহিলা আমার চেয়ে বছর দু’তিনেকের বড়ই হবে হয়তো। যদিও তাঁর মেকআপ-গেটআপে তাঁকে আমার চেয়ে বেশ ছোটই দেখায়। ওনার বেবীফেসটাও এক্ষেত্রে দায়ী বোধ হয়। বয়স আটত্রিশ হলেও ওনাকে এক নজর দেখলে মনে হবে, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের অবিবাহিত যুবতী। প্রচলিত সমাজে খুব সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা হয়তো উনি নন, তবে ওনার স্মার্টনেসের কারণে আর দশটা সুন্দরীর চেয়ে কোন অংশেই কম আকর্ষণীয়ও তিনি নন। হঠাৎই একটু এগিয়ে এসে বাম গালটা আমার দিকে ঘুরিয়ে তিনি বলে উঠলেন,

-ভাবী, দেখেন তো, এই গালটা কি আপনার এবনরমাল মনে হচ্ছে?

আমি কিছুটা বিব্রত হলেও নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। আমি ডাক্তার নই, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির শিক্ষক। আমার কাজ কাউন্সেলিং করা,কারো শরীরের এবনরমালিটি ধরার ক্ষমতা আমার নেই।

-কেন বলুন তো? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

-একটু ভালো করে দেখুন না ভাবী!

আমি বেশ ভালভাবেই খেয়াল করলাম। না, তার দু’গালের কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা আমার চোখে পড়লো না। বরং এই বয়সে অন্যদের যখন এইখানে বয়সের চিহ্ন হিসেবে মেছতার ছায়া দেখার কথা, সেইখানে ওনার দু’গাল বেশ উজ্জ্বল, চকচকেই দেখলাম, বয়সের কোন ছাপই সেখানে পড়েনি।

-আপনি ঠিক দেখছেন তো? কোন ছাপ দেখতে পাচ্ছেন কি?

-ছাপ? কীসের ছাপ? আপনার স্কিন তো খুবই সুন্দর দেখছি, বয়সের কোন ছাপই নেই।

-না, না, বয়সের ছাপ নয়। অন্য কোন ছাপ দেখা যায় কি?

আরেকটু খেয়াল করে দেখলাম। গালে বেশ সুচারুভাবে করা মেকআপের গোলাপি আভা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। আমার মুখ দেখে না-সূচক উত্তরটা পেয়েই বোধ হয় আবার নিজে থেকেই কথা শুরু করলেন,

-কেউ কিছু খুঁজে পায় না, জানেন? অথচ আমি ফিল করি।

-কী? লিড করার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এলো শব্দটা।

-আমি বুঝতে পারি, আমার বাম গালটা ফুলে আছে। মাঝে মাঝে ব্যথা করে জায়গায় জায়গায়। আবার হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে উঠে। আমি হাত দিয়ে নেড়ে দেখি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। সবাই বলে কোন প্রবলেম নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি বুঝতে পারি, গালটা ভারী হয়ে আছে। আমি বারবার গালটাতে হাত বুলিয়ে দেখি। এটা যে আমি সজ্ঞানে করি তাও না, আনমনেই আমার হাতটা বাম গালে চলে যায়। ডাক্তারদের কাছে গেলে বলেন, এটা নাকি আমার সাইকোলজিক্যাল সমস্যা।

ভদ্রমহিলা থেমে গেলেন। এই প্রথম আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রশ্ন করলাম।

-ঠিক কতদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে এটা?

মিসেস জামান আবারও দরদর করে ঘামতে লাগলেন। আমি টিস্যু বক্স থেকে দুটো টিস্যু তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

-আপনি সঙ্কোচ ছাড়াই বলুন। এ কথা এ রুমের বাইরে যাবে না।

ভদ্রমহিলা মিনিট পাঁচেক বাদে আমার দিকে তাকালেন। তার দু’চোখ খানিকটা ভেজা। কিছুটা আড়ষ্টতা নিয়ে শুরু করলেন,

-আসলে একদিন আমি আর জামান বসে গল্প করছিলাম। জামান আধাশোয়া হয়ে ছিল, আমি ওর ডানপাশে বসে ছিলাম। হঠাৎ একটা সামান্য কথায় সে আমার বাম গালে সজোরে একটা চড় মারে। এতো জোরে যে, ওটার শব্দ আমার কানে এখনও বাজে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।

ভদ্রমহিলার চোখে জমে থাকা পানিগুলো স্রোতের আকারে দু’গাল বেয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। আমি নিজেও খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারছি, তার এখন কিছুটা আস্থা প্রয়োজন, কিন্তু এই মুহূর্তে কোন কথা বললে মূল বিষয়টা চাপা পড়ে যেতে পারে ভেবেই আমি চুপ করে রইলাম। কেবল আমার ডান হাতটা এগিয়ে তার ডান হাতের উপর রাখলাম। উনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমি চুপচাপ তাঁর নিজেকে সামলিয়ে নেবার অপেক্ষায় হাতে হাত রেখে বসে রইলাম।

-আপনি কিন্তু তাকে খারাপ ভাববেন না। সে ভালো মানুষ। এই ঘটনার আগে-পরে অনেক সুন্দর সময় একসাথে কাটিয়েছি আমরা। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম তাকে। সে আমাকে ভালবাসে, অনেক ভালবাসে। আমি যতোটুকু বাসি, তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু সে আমার ব্যাপারে খানিকটা পজেসিভ। তার সারাক্ষণ মনে হয়, আমি তাকে ছেড়ে চলে যাবো। সে আমার ফোনের কললিষ্ট চেক করে, আমার মেসেঞ্জার চেক করে। আমার ফেসবুকে কে কয়টা লাইক দিল, কমেন্ট করলো, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। আমি কোন পুরুষের কমেন্টের উত্তর দিলে তার মেজাজ গরম হয়ে যায়। আমার কোন বন্ধু আমার খুব প্রশংসা করলে সে সহ্য করতে পারে না। এসব কারণে আমি সব বন্ধুদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি, অনলাইনে, অফলাইনে সব জায়গায়। তারপরেও অনেক পুরনো বন্ধুদের সাথে একটু-আধটু যোগাযোগ তো রয়েই যায়। সেসব দেখলেই তার মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়।

আমি বারবার তাকে বলেছি, আমি কোনদিন তোমার প্রতি অবিশ্বস্ত হবো না,আমার প্রতি আস্থা রাখতে পারো। কিন্তু সে এটাও স্বীকার করে না যে, সে আমাকে অবিশ্বাস করে। কিন্তু ঠিকই আমাকে সন্দেহ করে। সবসময় চায়, আমি শুধু তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তার বক্তব্য, তাকে ছাড়া আমার আর কোন পুরুষ বন্ধু লাগবে কেন? সেই হবে আমার একমাত্র বন্ধু।

মিসেস জামান কিছুক্ষণ থামলেন। আরও এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার কথা বলা শুরু করলেন।

‘সেদিন তেমনি এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ রাখার সূত্র ধরে সে আমাকে থাপ্পড় মারলো। মারার পরেও তার রাগ কমলো না। সে একটিবারের জন্যও আমার কাছে মাফ না চেয়ে রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও রাগ করে তাকে না বলেই বাবার বাড়ি চলে গেলাম। খুব কৌশলে মা-বোনের কাছে গালে থাপ্পড়ের চিহ্ন লুকিয়ে রাখলাম। কিন্তু আমার গালটা ফুলে রইলো দুদিন, ব্যথাও রইলো, মাঝে মাঝে জ্বলে যাচ্ছিল, ভারী হয়ে থাকলো গালটা। আমি মাঝে মাঝেই আয়নায় চেক করলাম গাল। গায়ের রঙ খানিকটা চাপা হওয়ার কারণে লাল দাগগুলো সেভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু গালের অস্বস্তির কারণে বারবার আমার হাত চলে যাচ্ছিল সেখানে।
আমি ভাবলাম, দু’চারদিন পার হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিনের পর দিন পেরিয়ে গেল, জামান আমার কাছে মাফ চাইলো,আমাদের আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু হলো, শুধু আমার গালের অস্বস্তিগুলো গেল না। প্রতি মুহূর্তে আমি আমার বাম গালের অস্তিত্ব আলাদাভাবে টের পাই। আমার মনে হয়, সবাই দেখতে পাচ্ছে আমার গালে পড়া জামানের চার আঙুলের ছাপ, আমি একা থাকলেই শুনতে পাই জামানের দেয়া থাপ্পড়ের শব্দ। এই দেখুন, এখনো আমার গালের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। আপনি কি কিছু বুঝতে পারছেন?

আমি কিছুক্ষণ কোন উত্তর দিতে পারলাম না। নির্বাক তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মাঝে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে। মিসেস জামানের কাউন্সেলিং সেশন শেষ হয়েছে অনেকদিন। উনি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। যদিও তাঁর বাম গালে বার বার হাত বুলানোর অভ্যাসটা রয়ে গেছে।

মিসেস জামানের আহ্বানে নারী নির্যাতন বিষয়ক এক কর্মশালায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম আজ। আমি নারীর মানসিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করলাম। সবশেষে মিসেস জামান ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য বিদায়ী বক্তব্য শুরু করলেন। ওনার বক্তৃতাপটুতার অনেক গল্প শুনেছিলাম সবার মুখে। আজ নিজের কানে উনার বক্তৃতা দেয়ার স্টাইল শুনে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। ফিরে আসার পথেও সারা রাস্তা আমার কানে গুঞ্জরিত হতে থাকলো দীর্ঘশ্বাসভরা তাঁর শেষ কথাগুলি।

-সবাইকে ধন্যবাদ, শেষ করছি বেগম রোকেয়ার একটা প্রিয় উক্তি দিয়ে, “বলিতে আপন দুঃখ,পরনিন্দা হয়”।

০৭/০৯/২০১৮ইং

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.