সহমত-শিবব্রতের আকালের সন্ধানে

মাসকাওয়াথ আহসান:

সাড়ে পনেরো বছর বিপু ভাইয়ের ক্ষেতের কলাটা-মূলোটা খেয়ে; হানিফ ভাইয়ের চিংড়ির ঘেরের গলদা চিংড়ি পেয়ে; ভটভটি বুবুর বাগান বাড়িতে কবজি ডুবিয়ে শসাটা-গাজরটা সাটিয়ে; বাজারে যে যেতে হয়; এ কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো সহমত ও শিবব্রত।

আর ছিলো নানা দিবস পালনে বিরিয়ানি খাওয়া; বৌ বাচ্চার জন্য বিরিয়ানির প্যাকেট বেঁধে নিয়ে ঘরে ফেরা। জন্মদিনে সারপ্রাইজ পার্টি দিয়ে কেক কেটে একেবারে মুখে তুলে দিতো ললিতা আপা।
গণভবনে প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি’র আসর শেষে ফ্রি লোডিং করে পকেটে পিঠা-পুলি ভরে বাসায় ফিরতো তারা। এমব্যাসির অনুষ্ঠানে পাঁচ পাত্তর মেরে আবার টলতে টলতে এগিয়ে যেতো বিষের টেবিলের দিকে। আরাফাত ও পলক ভাইয়েরা গাড়ির ডিজ্ঞিতে ভরে বাসায় ড্রপ করে গেলে; সারারাত কেটে যেতো স্বপ্নে স্বপ্নে। আর পাপিয়ার আসর হলে তো কথাই নেই, মুখ গহবরে মাউথ ফ্রেশনার স্প্রে করে, চুল জেল দিয়ে ব্যক ব্রাশ করে ওয়েস্ট ইনের করাত কলের কাছে পৌঁছালে; উর্বশীরা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতো সুইমিংপুলে; কাতলা মাছের মতো ভেটকি দিয়ে ফটো তুলতো খোকন সোনারা।

আজ ভাবলে মনে হয়; সে ছিলো মোমেনের বেহেশতের জীবন। নক্সী পাঞ্জাবি পরে সুগন্ধী মেখে বাবু বিলাসের সেই সোনার তরী কোথায় গেলো আজ। তদবিরের কমিশনের টাকাগুলো দরবেশের জিম্মায় রেখে ডিম ফোটাতে দিয়ে মায়ানগরীর স্বপ্নে বিহবল হয়ে পড়ে ছিলো তারা। কিছু টাকা পিকে মেরে দিয়ে ভারতে চলে গেলেও গায়ে লাগেনি। লাগে টাকা দেবে আপা সেন।

৫ অগাস্ট সকালেও মনে হয়েছিলো; ঠা ঠা ঠা গুলি করে বিদ্রোহ ও বিপ্লব দমন হয়ে গেলে গণভবনে বসবে পিঠাপুলির আসর। কিন্তু দুপুর বেলা বোঝা গেলো, একটা বদ হাওয়া লেগেছে গায়, কখন পাখি উড়ে যায়।
তারপর এই পলাতক জীবন; বউ বাচ্চারা বাসা পালটে ছোট ঠিকানায় উঠেছে; সাড়ে তিনহাজার স্কোয়ার ফিট সংকুচিত হতে হতে সাতশো স্কোয়ার ফিট। পুনর্মূষিকো-ভব । বিগিনিং পয়েন্ট ইজ দ্য এন্ড। পলায়নে আবার বাটার বন কলা; নিউজ পেপার দিয়ে তেল চিপে ইটালিয়ান হোটেলে এক টুকরো পারাটা খাওয়ার জন্য মন উন্মন। ঠিক যেরকম সদরঘাটে নেমে দিশেহারা লাগতো; মেরুল বাড্ডায় আড্ডাহীন খরখরে জীবন যন্ত্রণা ছিলো; আবার সেই অনিশ্চিত জীবন।

বাজার করতে গেলে শাক-সবজির দাম দেখে বুকের মধ্যে হাহাকার জাগে; ফাইভ স্টার হোটেলে রুপোর এগ পট থেকে সেদ্ধ ডিম তুলে ফাটিয়ে খাওয়ার দিনগুলো আর সোনার খাঁচায় রইলো না; এখন মুরগীর খাঁচার পাশ দিয়ে গেলে ওকেও নিজের চেয়ে বেশি দামি মনে হয়।
সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদার ফেসবুক হয়ে ওঠে গণি মিয়া গরীব চাষীর বাজারের ফর্দ। সারাদিন পেঁপে বরবটি শালগমের দামের হিসাব। একটা ইলিশের টুকরা কিনতে কতো লাগছে; এটা ভাবতেই মনে পড়ে; আতিক ভাই ডেকে আদর করে গোয়ালন্দের ইলিশ খাওয়াতো আর গাইতো ইশকুল খুইলাছেরে মওলা ইশকুল খুইলাছে।

বউয়ের ফোন ধরতে ভয় লাগে; সারাদিন নাই নাই খাঁই খাঁই; পনেরো বছরের সাদা হাতির সংসার সহসা এমন ছুঁচোর কেত্তনে পরিণত হবে; তা কে-ই বা জানতো।
ব্যবসা করে মুনাফা করার জন্য যাদের টাকা দিয়েছিলো, তারা আর ফোন ধরে না। ব্যাংক একাউন্টগুলো ফ্রিজ হয়ে আছে। যে আত্মীয় স্বজন সহমত ভাই শিবব্রত দাদা বলে মুখে ফেণা তুলে ফেলতো; তারা কেউ আর পাত্তা দেয়না।
রেষ্টুরেন্টের বাইরে থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে রহমত ভাইকে বড্ড আয়েশ করে তেহারি খেতে দেখে। দেড় দশকের ক্ষুধা; গোরুড়ের মতো হাড্ডি চিবিয়ে খাচ্ছে।

এক জায়গায় ইসলামি জলসার প্যান্ডেলের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখে শরিয়ত ভাই ডেকচি থেকে ভুনা খিঁচুড়ি বেড়ে খাওয়াচ্ছে নেয়ামত ভাইকে। পলাতক জীবনে দাড়ি বড় হয়ে এখন পোকিত মোল্লা মনে হচ্ছে নিজেকে। ইচ্ছা করে মুসল্লীর লাইনে বসে ভুনা খিঁচুড়ি খায়।
পেছন থেকে হাত চেপে ধরে শিবব্রত দাদা। নিয়ে যায় পাশের পার্কে। একটু চিঁড়ে কিনেছে; তাই ভাগ করে খেতে হবে; আর পুজোর সময় জমিয়ে রাখা বাতাসার একটি সহমত ভাইকে দিয়ে একটি নিজে নেয়। বুদ্ধি দেয়, বাতাসা শুধু চিঁড়ার ওপর ধরে রেখে বাতাসার ছায়া দিয়ে চিঁড়া খেলে মিষ্টি লাগবে।

একটু পরে ললিতা আপা আসে। ছোট্ট পলিথিনে একটু কাঁচাবাজার। দুটো বরবটি, দুটি গাজর, একটি টমেটো আর কটা লেটুস পাতা বের করে ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়। লিখে দেয়, হ্যাশট্যাগ স্টেপ ডাউন ইউনুস।

 

মাসকাওয়াথ আহসান: রম্যলেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: