স্বামী বা শ্বশুর, কেউই নষ্ট পুরুষের ঊর্ধ্বে নয়

কাকলী তালুকদার: বউ কথা কউ পাখিটা অনবরত ডেকেই চলেছে। মনে মনে মায়াবতীও পাখিটার মতো সুর মিলাচ্ছে, “চৈতার বৌ গো টেকা দেওগো, কাঁঠাল পাকে, লোকে দেখে”।

মায়াবতী এই গ্রামের নতুন বউ। এই শ্রাবণ মাসেই তার বিয়ে হলো। ধুম-ধাম করেই মায়াবতীর বাবা রজতের সাথে বিয়ে দিলো। রজত থাকে ঢাকা শহরে, গার্মেন্টসে কাজ করে। রজতরা তিন ভাই, এক বোন। রজত সবার বড়, মেঝো ভাইটাও গার্মেন্টসে কাজ করে। ছোট ভাই বাবার সাথে গানের দলে ঘুরে বেড়ায়। ছোট বোন সুজলার বিয়ে হয়ে গেছে এক বছর হলো। ঘরে মানুষ বলতে মায়াবতীর শাশুড়ী, শ্বশুর আর ছোট দেবর সুবল। রজত ছুটিতে বাড়িতে আসে।

kakoli
কাকলী তালুকদার

মায়াবতীর মনে বউ কথা কউ পাখিটা আজ রজতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বার বার।
বিয়ের পর মানুষটার সাথে চার/পাঁচ বার দেখা হলো। সেই দিনগুলোর কথা মায়াবতীর মনে হলেই এক ভালো লাগা কাজ করে। ওই মানুষটা যখন তারে আদর করে বুকের কাছে টেনে নেয় মায়াবতীর খুব শরম লাগে, কিন্তু খুব ভালোও লাগে। তিন-চার দিনের ছুটি নিয়ে মানুষটা আসে। যাওয়ার সময় মায়াবতীর রজতকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না।

মায়াবতী ভাবতে থাকে, মানুষটারে যদি আঁচলে বাইন্ধা রাখন যাইতো।

মায়াবতী রজতের কাছে জানতে চায়, কবে তারে ঢাকা শহরে নিয়ে যাবে।মায়াবতী কোনদিন ঢাকা শহর দেখেনি। রজতের কাছে গল্প শুনছে, এই গ্রামের কত মানুষ ঢাকা শহরে থাকে। যারা গার্মেন্টসে কাজ করে তারা বেশীর ভাগই থাকে গাজীপুর। ছোট ছোট ঘর ভাড়া করে সবাই এক সাথে গ্রামের মতোই থাকে।

মায়াবতীর ভাবনা ভেঙে গেলো শাশুড়ী বাসনার কথায়। ‘কীগো বউ, ভাতের  আসকালে মুইট্যা নাই, তোমার শশুর খাইয়া মঙ্গলবারের ছেসরাখালীর বাজার ধরবো। বেইলা বেইলা বাজার থাইকা  ফিইরা না আইলে রাইতে গানের দল লইয়া ভাইট্টা গাঁও যাইবো কেমনে’?

বলতে বলতে বাসনা নিজেই গোবরের মুইট্যা চুলায় দেয়। শাশুড়ীর কথায় মায়াবতীর হাত হঠাৎ করেই দ্রুত চলতে থাকে। নিজের ক্ষেতের ছোট ছোট আলু দ্রুতগতিতে মায়াবতী কাটতে থাকে। মুশুরির ডাল রান্না শেষ করেই মায়াবতী ভাত বসায় চুলায়। দুইটা চুলা থাকলেও বাসনার কথা মতো এক চুলায় জ্বাল ধরায় মায়াবতী। ভাটি অঞ্চলে, লাকড়ির খুব অভাব। গোবর দিয়ে ঘষি আর মুইট্যা দিয়েই সারা বছর রান্নার কাজ চালাতে হয়।

পাখির ডাকের সাথে সাথেই মায়াবতী ঘুম থেকে উঠে। পিঁড়িগুলো কল পারে নিয়ে প্রতিদিন ধুইতে হয়। গোবর পানিতে মিশিয়ে সারা বাড়ি ছিটিয়ে দিয়ে বাসী বাড়ি শুদ্ধ করে, সবাই ঘুমে থাকতে থাকতেই মায়াবতী ঘর ঝাড়ু দিয়ে কলে স্নান সেরে নেয়। স্নানে যাওয়ার আগে রান্নার চুলাটাও লেপা শেষ করে প্রতিদিন।
মায়াবতী স্নান শেষ করে এসেই চুলায় জ্বাল ধরায়। বাসনা ততক্ষণে স্নান শেষ করে এসে চায়ের কাপ আর ঘরে ভাজা মুড়ি, শাড়ীর কুচড়ে নিয়ে পিঁড়িতে বসে। ‘আইজ তোমার শ্বশুর বাজারে যাইবো, রান্ধাডা তাড়াতাড়ি কইরো। ডাইল, আলু ভাজা আর টানাইল ছোডু মাছটি দিয়া চরচরি কইরা লাইও’।
চা খেয়ে বাসনা গোবর নিয়ে বাড়ির নামায় চলে যায় মুইট্টা দিতে। মায়াবতী কাজের ফাঁকে চা খেয়ে কাজ করতে থাকে। মাঝে শ্বশুরকে চা-মুড়ি দিয়ে আসে উঠানে। উঠানে বসে সুশীল গানের সুরটা ঠিক করে নিচ্ছিল রাতের আসরের জন্য।
সকাল সকাল খেয়ে সুশীল বাজারে চলে যায়। হাঁটার পথ, এক দেড়ে ঘন্টা তো লাগেই বাজারে পৌঁছাতে।

দুপুরে আজ আর রান্না নেই, বাসনা রতন জর্দা দিয়ে পান মুখে দিয়ে কড়া হলুদ রঙের কাঁথাটা মাটিতে পাটির উপর বিছায়। ‘বউ দুপুরে তো রান্না নাই, খেতা সেলাইয়ে হাতটা লাগাও। মায়াবতী শাশুড়ীর কথা মতো সুঁই এর মধ্যে কালো সুতা লাগিয়ে সেলাইয়ে হাত লাগায়। বাসনা বলতে থাকে, এবার পুত আইলে বড়ি-টরি খাইও না। একটা নাতির মুখ দেখি, ঘরডা খালি খালি লাগে।

Nariমায়াবতী নিজের শাশুড়ীর কথা শুনে ঘোমটাটা আরেকটু লম্বা করে টানে। বাসনা বলে যেতে থাকে, ‘আমার বিয়া অইলো ষোল বছর বয়সে, তোমার শ্বশুর গেছিল আমরার গাঁওয়ে গান গাইতে, গানের আসরেই আমারে দেখছিল। পরে গ্রামের মানুষের কাছে খবর লইয়া বিয়ার প্রস্তাব ফাডাইছিন আমার বাবার কাছে। তোমার শ্বশুরের গান আমার বাবার  খুব পছন্দ হইছিল এর লাইগা আর অমত করে নাই। তোমার শ্বশুর যখন রাম-সীতার বনবাস পালা করতো তখন রামের চরিত্রটা করার সময় মনে ওইতো আমিই সীতা’।  

মায়াবতী মাঝে মাঝে হু বলে গল্প শুনতে থাকে বাসনার। ‘বিয়ের দুই মাসের মধ্যেই আমার রজত পেটে আসে, তোমার শ্বশুরের খুশি কেডা দেখে। ওই সময় প্রায় প্রতিদিন গানের দল লইয়া তোমার শ্বশুর ঘুইরা বেড়ায়। আবার রাইতে ফিরা আয়ে। ঘরে আমার কেউ নাই, রাইতে যদি একলা ডরাই, তোমার শ্বশুর খুব চিন্তা করতো আমার লাইগা। আর আমারে থইয়া কুথাও থাকতোও ফারে না মানুষটা। হেই লাইগা বাপের বাড়িত গিয়াও কোনদিন শান্তি পাইছি না আমি। তিন দিনের বেশি থাকতে দেয় না। সাথে গিয়া সাথে লইয়া আইয়া ফরতো’।

মায়াবতী শাশুড়ীর গল্প শুনতে শুনতে রজতের কথা ভাবতে থাকে। তারও তো রজতকে ছাড়া ভালো লাগে না। সারাদিন কাজের ফাঁকে মানুষটার কথা কতো মনে পড়ে। এই মাসেই ধান কাটা লাগবো, রজত আইবো কইছিল ধান কাটা লাগলে। দুই আরা জমি করছে, এই সময়ে ঘরের মানুষটি ঘরে থাকলে খুব কাজে লাগে।

মায়াবতী ভাবে, এবার রজত আসলে খুব শক্ত করে বলবে, তারে ঢাকা নিয়ে যেতে। রাতে তার একা ভালো লাগেনা, চিন্তায় মগ্ন হয়ে মায়াবতী মধ্য রাতে পেঁচার ডাক শুনে বুঝতে পারে অনেক রাত হলো এবার। এক সময় মায়াবতী ঘুমিয়ে পড়ে। একদিন রাতে মায়াবতীর চিন্তায় বাদ সাধে তার শাশুড়ির নিচু গলার ফিস ফিস কথায়। টিনের ছোট্ট ঘরটির এক পাশে ঝাপ দিয়ে মায়াবতীর এক চিলতে বিছানার রুম। বড় ঘরের  চকিতে শ্বশুর-শাশুড়ি ঘুমায়। ছোট্ট আরেকটি ঘর আছে উত্তর দিকে, তিনটা গরু থাকে, আরেকটা বিছানাও আছে, ওখানে তার দেবর সুবল ঘুমায়।
মায়াবতী স্পষ্ট ফিসফাস শুনতে পায়, ‘আমার অখন এইতা বালা লাগে না, জায়গাডা খুব জ্বলে’।
তবুও ধস্তাধস্তির শব্দ শুনতে পায় মায়াবতী। ‘বয়স হইছে না তোমার’? বলতে বলতে মুখ থেকে উ উ শব্দ বের হয় বাসনার।
মায়াবতী তার শরীরের উত্তাপ টের পায়, সারা রাত তার ঘুম আসে না সেদিন।

তিন দিন পর রজত বাড়ি আসে, মায়াবতী বলতে থাকে, এবার তুমি আমারে নিয়ে যাও তোমার সাথে। রজত বলে, ‘আরেকটু বাও কইরা লৈয়া নিবাম তোমারে। তুমি গেলেই একটা বাসা নিতে অইবো, কত টেকার দরকার বুঝো তুমি? মায়াবতী চুপসে যায়। বোরো ফসল ঘরে তুলে রজত আবার ঢাকা চলে যায়।

মায়াবতীর এই মাস থেকে মাসিক হয় না, বমি বমি লাগে আর সব কিছুতে নাকে গন্ধ লাগে।  একদিন বমি করার সময় বাসনা জানতে চায়, কি গো বউ এই মাসে তোমার ছান হইছে না?
মায়াবতী মাথা দুই ধারে নেড়ে ‘না’ জানায়। বাসনা খুব খুশি হয়, ‘আমার প্রথম ছেড়া ওইছিল, তোমারও ছেড়াই অইবো। অখন একটু নিয়ম মাইনা চলবা। খোলা চুলে বাইরে যাইও না, সইন্ধার পরে ঘর থাইকা বাইরে যাইও না। কাম-কাজ একটু ধীর অইয়া কইরো’।
বাসনার নিয়মের মধ্য দিয়াই মায়াবতীর পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ঘরের সবাই খুব খুশী হয়, মায়াবতী ছেলে নিয়ে আতুর ঘরে। কেউ একজন ঢাকা থেকে এসে মায়াবতীর শ্বশুর সুশীলকে খোঁজে।  

মায়াবতী কান পেতে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে আতুর ঘর থেকে। শুধু একটি কথা সে খুব ভালো করে শুনে, রজত আরেকজনের সাথে কোর্ট ম্যারেজ করছে। মায়াবতীর বুকে কেউ যেন পাথর নিক্ষেপ করলো, ছেলেকে বুকে নিয়ে বসে ছিল মায়াবতী। ছেলেকে বুকের কাছে আরও মিশিয়ে মায়াবতী ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো।
মায়াবতী প্রতিদিন কান্না করে, যখন তখন কান্না করে। মায়াবতীর রাত-দিন সমান কাটতে থাকে ঘুমহীন। খবর পেয়ে ভাই মায়াবতীকে নিতে আসে, মায়াবতী কোথাও যাবে না বলে জানিয়ে দেয় ভাইকে।
এই ঘটনার পর থেকে মায়াবতীর শাশুড়ী বাসনাও অসুস্থ হয়ে পরে দিন দিন। একদিন হুট করেই বাসনা উঠানে পড়ে যায়। গ্রামের ডাক্তার এসে বাসনার মৃত্যু নিশ্চিত করে। মায়াবতীর চোখের সামনে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। তার সন্তানের জন্মের পর রজত বাড়িতে আসেনি। মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে বাড়িতে আসে।

মায়াবতীর সাথে কোন কথা বলে না রজত। মায়াবতী  খুব স্বাভাবিকভাবেই সংসারের কাজ করে, বাড়ি ভর্তি মানুষ। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সবাই বাড়িতে এসেছে। ১৩ দিন শেষে মায়ের শ্রাদ্ধ শেষ করে রজত আবার ঢাকায় ফিরে যায়। যারা মৃত্যু উপলক্ষে এসেছিল সবাই একে একে নিজের বাড়ি ফিরে যায়। মায়াবতী এখন আর কান্না করে না, শুধু ছেলেটা একটু কান্না করলে তার বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠে। হাতের কাজ ফেলে সে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়।
বাড়িতে এখন শ্বশুর আর মায়াবতী। ছেলেকে শ্বশুরের কাছে রেখে মায়াবতী সংসারের কাজ সারে। শাশুড়ী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরও মনমরা হয়ে বসে থাকে।
‘বাবা, মেলা দিন ধইরা বাজারে যাইন না, ঘরে তো কত কিছু নাই, কাইল মঙ্গলবার। ছেসরাকালীর বাজার, সকাল সকাল খাইয়া একটু ঘুইরা আঈন গা বাজার থাইকা। আবুডা’র পেট ভরে না, একটা বালা দেইখা দুধের ডিব্বা আনুইন যে’।
সুশীল মায়াবতীর দিকে চেয়ে বলে, কী কী লাগবো লিস্ট কইরা রাইখো।

মায়াবতী, ভোরে ঘুম থেকে উঠে। শ্বশুরকে ভাত খাইয়ে বাজারের লিস্ট আর বাজারের ব্যাগটা হাতে দিয়ে দেয়।
বিকেলে বাজার নিয়ে ফিরে আসে সুশীল। মায়াবতীরে ডাকে সুশীল, বউ বাজারের ব্যাগে দেখো একটা দুধের ডিব্বা আছে। রজত তো আর আইজকাল বাড়িতে আইয়ে না, তোমার লাইগা একটা শাড়ী আছে ব্যাগে দেইখো। মায়াবতী বাজার গোছায়। দুধের কৌটা খুব যত্ন করে তাকের উপর উঠিয়ে রাখে। শ্বশুরের আনা খয়েরি রঙের শাড়ীটায় হাত বুলায়।

মায়াবতীর চোখ জলে ভরে আসে। প্রথম যখন রজত ঢাকা থেকে আসছিল, তার জন্য লাল রঙের একটা শাড়ী নিয়ে আসছিল। সেদিন মায়াবতী কত খুশীই না হয়েছিল।
বউ তোমার শাড়ী পছন্দ অইছে? অইছে বাবা, মায়াবতী উত্তর দেয়। কি দরকার আছিল আমার লাইগা টেকা খরচ করনের? এমনেই তো আফনের ঘারে পইড়া খাইতেছি।

সুশীল কথা বাড়ায় না,মৃদু হাসে।
রাতের খাবার শেষ করে মায়াবতী ছেলেকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। শ্বশুরের বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়েই মায়াবতী ঘুমাতে আসে। মায়াবতী খয়েরী শাড়ী আর রজতের কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরে।
হঠাৎ সে টের পায় তার বুকের মধ্যে কারোর হাত, সে চিৎকার করার আগেই সুশীল মুখ চেপে ধরে মায়াবতীর। চুপ চুপ, মাইনসে শুনবো, তোরে খারাপ কইবো, মুখ বন্ধ রাখ। মায়াবতী হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘বাবা, আফনের পায়ে পড়ি, আপ্নেরে আমি নিজের বাবা মনে কইরা এই বাড়িত পইড়া রইছি, আমারে ছাইড়া দেন’।
সুশীল মায়াবতীর কাপড় টেনে-হিঁচড়ে খুলতে থাকে, আর বলতে থাকে, ‘চুপ চুপ মাইনসে হুনবো’।
মায়াবতীর ছেলে ঘুমের মাঝে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে থাকে। মায়াবতী ছেলেকে বুকের কাছে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

 

শেয়ার করুন: