ফারদিন ফেরদৌস:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল। আল্লাহর ঘর -একটি মসজিদ। তার দ্বিতীয় তলায়, প্রার্থনার কক্ষে পড়ে ছিল এক নিষ্পাপ শিশুর রক্তাক্ত নিথর দেহ। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী, মাত্র দশ বছর বয়স। নাম তার ময়না। নিখোঁজের পরদিন সন্ধান মিলল তার -নাহ্, জীবনের নয়, বেদনাবিধুর বিষন্ন মৃত্যুর।
লজ্জায়, ক্ষোভে, গ্লানিতে মর্মে মরে যাচ্ছি আমরা। কাপুরুষ কোনো এক জানোয়ারের লালসার শিকার হয়েছিল সে। তার পরণের সালোয়ার খুলে গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। দেহের প্রতিটি কোষে ছিল নির্যাতনের ছাপ, মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল সে। যেন হিংস্রতা ও ধর্মান্ধতার যুগপৎ চিহ্ন হিসেবে ময়না হয়ে উঠল এক মৌন প্রতিবাদ!
সন্তান শোকে তার মা এখন পাগলপ্রায়। কণ্ঠে ব্যথা, চোখে আগুন, গলায় ক্ষোভ। বিলাপ করে বলতেসেন, ‘মসজিদের দোতলায় পূব পাশে কিয়ের সাথে জানি, সেলোয়ারডারে খুলসে, খুইলা গলার সাথে বানছে। বাইন্ধা সাইরা আমার ঝিডারে উপুত কইরা ফালায়াতো রাখসে। সারা অঙ্গ কালা হইয়া গেসেগা। এই জায়গাডা মনে হয় ভাইঙ্গা গেসেগা। আমি দেইখা চিক্কইর মারসি। হুজুর আমারে অনুমতি দিসে। কয়, আফনে মা। যাইন মসজিদো, অসুবিধা নাই। আফনে যাইন। মেয়েডা উলঙ্গ…!’
এই কী আমাদের প্রার্থনার ঘর? এই কী আমাদের ঈমান? মসজিদে যেখানে প্রভুর নাম জপা হয়, সেখানে ঈশ্বর চুপ থাকলেন? আর ওই ঈশ্বরের গোলাম মানুষেরা হয়ে গেল হিংস্র পশুর চেয়েও অধম!
আমরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি ভিতর থেকে। ভাবছি -খোদা কেন আমাকে পুরুষ বানিয়েছিল? এই সমাজের, এই ধর্মবিশ্বাসের, এই লাম্পট্যের প্রতিনিধিত্ব করতেই কী আমি জন্মেছিলাম? এর চেয়ে মরে যাওয়া ক্লীব গাবগাছের জীবন ঢের ভালো ছিল। ক্ষুদ্র একটা পোকারও বিপদের কারণ সে হয় না। ময়নার চোখ দুটো যেন তাড়া করে ফিরছে আমাদেরকে -কঠিন জবাব চায়, প্রতিকার চায়, চায় যথোচিত বিচার!
আমরা মহাপ্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করি -আমাদের এ দুঃসহ নরক থেকে মুক্তির পথ দেখাও। এই পীড়নের সভ্যতা ভেঙে দাও। যেখানে মসজিদও নিরাপদ নয়, সেখানে ধর্ম শুধু প্রচার আর প্রভাবের হাতিয়ার হয়ে গেছে। নৈতিকতা, করুণা, মানবিকতা আজ কোথায়? বোধ আর বিবেক নির্বাসনে কোন আন্দামান নিকোবরে?
ধর্ম কি আমাদের ন্যূনতম নৈতিকতাও শেখাতে পারেনি? নিজেকে প্রশ্ন করুন। অন্তরাত্মার দরজায় টোকা দিন। ভাবা শিখুন। চিরায়ত অন্ধকার দূরীভূত করে চোখ মেলে সভ্যতার আলো দেখুন।
আমরা আর একজন ময়নাকেও এভাবে হারাতে চাই না। মনুষ্যত্ববোধকে হারতে দিতে পারি না। মসজিদ-মাদ্রাসায়, ইশকুলে-কলেজে, পথে-প্রান্তরে কিংবা ঘরের চারদেয়ালে আর একটি ছেলেমেয়েও যেন হায়েনার লালসার শিকার না হয়।
জবাব চাই সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, এবং সেই মহামহিম প্রভুর কাছেও, যিনি প্রার্থনালয় নামের নিজের ঘরেও মুখ ফিরিয়ে রাখলেন।
লেখক: সাংবাদিক
৬ জুলাই ২০২৪