ফারদিন ফেরদৌস:
গতবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে দেশকে গৌরবান্বিত করেছিল বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। সেই জয় উদ্যাপনে বাফুফে ঘোষণা করেছিল দেড় কোটি টাকার বোনাস। বাহবা পেয়েছিল তারা। কিন্তু সেই ঘোষণার আট মাস পরও, প্রাপ্য অর্থ বুঝে পাননি নারী ফুটবলাররা। এবার, আরও এক ইতিহাস -এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠবার গৌরব অর্জন করলেও বাফুফের তরফে এক কানাকড়ি জোটেনি, উপরন্তু খেলোয়াড়দেরকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে গভীররাতে গভীর ঘুমে ঢাকাবাসী চৈতন্য হারানোর পর।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ঘোষণা করেছেন ৫০ লাখ টাকার পুরস্কার। তবে সেই অর্থ আদৌ তাঁদের হাতে পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ এই দেশে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের চেয়ারে কতক্ষণ থাকবেন, তার নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারে না।
প্রথম আলোর ক্রীড়া প্রতিবেদক মাসুদ আলম লিখেছেন,
“রাত তিনটা পেরিয়েছে। রাজধানী ঢাকা তখন প্রায় ঘুমন্ত। কিন্তু হাতিরঝিলের পানির ওপর নির্মিত অ্যাম্ফিথিয়েটারের মঞ্চে আলো আর হাততালির শব্দে জেগে ওঠে চারপাশ। মিয়ানমারকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল জায়গা করে নিয়েছে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে। তাদের এ বিজয় উদ্যাপন করতে রোববার রাত দেড়টায় ইয়াঙ্গুন থেকে দল ঢাকায় ফেরার দেড় ঘণ্টা পর আয়োজন করা হয়েছিল অভিনব এক সংবর্ধনার। যার সৌন্দর্য যতটা চোখে লেগেছে, তার চেয়ে বেশি লেগেছে মেয়েদের জন্য কোনো প্রণোদনা বা পুরস্কার ঘোষণা না করায়।”
অনুষ্ঠানে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আওয়াল কোনো পুরস্কার বা প্রণোদনার ঘোষণা না দিয়ে বলেন, “যেভাবে আমরা নারী দলের পেছনে ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকবো। আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের পেছনে আমরা আছি।”
প্রশ্ন উঠছে -এই মধ্যরাতের সংবর্ধনার তাৎপর্য কী? অনুষ্ঠানস্থলে বিশাল বিলবোর্ড, ব্যানার, খেলোয়াড়দের ছবি, বড় পর্দায় খেলার ক্লিপ দেখানোসহ ডিজিটাল চাকচিক্য থাকলেও দর্শক সংখ্যা এক-দেড় হাজারের বেশি ছিল না। গ্যালারির এক-তৃতীয়াংশ পূর্ণ হয়নি। শেষ রাতের নির্জনতায় আনন্দধারা বইয়ে দিতে পারেনি এই কৃত্রিম উদ্দীপনা।
বাফুফে জানিয়েছে, দুজন খেলোয়াড় চার ঘণ্টা পরই ভুটানে চলে যাবেন বলে তাদের উপস্থিতিতে এত রাতে অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তারা ফিরে এলে পুনরায় একটি গণসংবর্ধনা দেয়া কি অসম্ভব ছিল?
নারী ফুটবলারদের বাস্তবতা বড় করুণ। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও তারা দীর্ঘদিন বেতনহীন ছিলেন। ঘরোয়া লীগে খেলার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। বাফুফে নারীদের জন্য আলাদা কোনো ক্রীড়াপঞ্জিও রাখে না। চুক্তি নবায়নের পর শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের মাসিক বেতন মাত্র ৫৫ হাজার টাকা, বাকিদের বেতন আরও কম।
অন্যদিকে প্রাপ্তিযোগ তেমন কিছুই না থাকলেও দেশের পুরুষ ক্রিকেটারদের বেতন রীতিমতো ঈর্ষণীয়। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট অনুযায়ী A+ গ্রেডে মাসিক বেতন ৭.৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। C ও D গ্রেডেও বেতন এক থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে। পুরুষ ফুটবলারদের নির্দিষ্ট মাসিক বেতন না থাকলেও ক্লাব পর্যায়ে তাদের আয়ের সুযোগ অনেক বেশি। ম্যাচপ্রতি সম্মানীও তারা পান।
ইতিহাসগড়া নারী ফুটবলারদের সংবর্ধনা কেন রাতের গভীরে? দিনের আলোয় কি একটি গণসংবর্ধনা আয়োজিত হতে পারত না? জয়ের পরও যাদের প্রাপ্য অধিকার মেলেনি, তারা কিন্তু আশাহত হননি। ঋতুপর্ণা চাকমা, যিনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোড়া গোল করে বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন, বলেন—
“আমরা জানি কীভাবে কঠিন সময় পেরোতে হয়। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন, আমরা বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে নিতে চাই।”
এই আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বরে গর্বিত হবার বদলে আমরা তাদের সংবর্ধনা দিই নিশীথে। এটা কি কেবল নিছকই সময়সামঞ্জস্য? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও কোনো অস্পষ্ট গূঢ় রহস্য?
সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে প্রকাশ্য জনসভায় প্রত্যাখ্যান করে বাতিল করবার দাবি তুলেছে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের জোট। সেই আহ্বানে একাত্মতা জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)র অন্যতম শীর্ষ নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ্। সেই মঞ্চেই নারীদেরকে ঢালাওভাবে ‘ব’ বর্গীয় শব্দে গালাগাল করে তাদের অধিকার, স্বাধীনতা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, খেলাধুলা ও ক্ষমতায়ন রুখে দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে।
এই বাস্তবতায় -খোলা চুলে, হাফপ্যান্ট পরে, সবার চোখের সামনে প্রবল ক্ষিপ্রতা ও তীব্র গতিতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মাঠজুড়ে দাবড়ে বেড়ানো নারী ফুটবলারদের প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকাবাসীর সামনে সংবর্ধনা দিতে অন্তর্বর্তী সরকার কুণ্ঠিত হলো না তো? যদি তাই হয়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ নারী প্রজন্মের জন্য এ এক বিরাট অশনিসংকেত।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাস্তবে রূপ নিলে, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী কূপমণ্ডুকতা ও চরম পশ্চাৎপদতার পথেই হাঁটবে বাংলাদেশ। এসব দলের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন ফোরামে গিয়ে ক্ষমতায় গেলে কাবুলের স্টাইলে ধর্মীয় আইন জারি করবেন বলে ন্যারেটিভ দাঁড় করাচ্ছেন। তাদের কাঙ্ক্ষিত সেই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যদি বাংলাদেশে সফল হয়, তবে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীরা লেখাপড়া ও বহিরাঙ্গনের কর্মনিপুণতা শিকেয় তুলে গৃহকোণে অবগুণ্ঠিত থেকে পতিসেবা ও সন্তান উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হবেন। সেদিন পুরুষের জন্য রিজার্ভ রাখা দিনের পুরোভাগ দূরের কথা রাত্রির একপলকের সামান্য প্রশংসাও হয়তো নারীর কপালে জুটবে না।
লেখক: সাংবাদিক
৮ জুলাই ২০২৫