ফারদিন ফেরদৌস:
বাংলাদেশে পুরুষতন্ত্রের সংকট নতুন কিছু নয়, তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, এটি কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই নারী ধূমপান করছিল বলে এক পুরুষ তাদের হেনস্তা করল। আরেক পুরুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে তাঁর পোশাক ও পর্দা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। এই দুই ক্ষেত্রেই পুরুষেরা তাদের অপসংস্কার, যৌনতাড়িত মানসিকতা এবং নিয়ন্ত্রণপরায়ণ স্বভাবকে বৈধতা দিতে ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ এখনো মনে করে, নারীর শরীর, পোশাক এবং চলাফেরা নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার তার রয়েছে। কেন? কারণ সমাজ পুরুষদের শেখায় যে, নারী তার অধীনস্ত, তাকে শাসন করা যাবে, তার চলাফেরার রাস্তাটি ঠিক করে দেওয়া যাবে। নারীর স্বাধীন চলাচল, পোশাক বা ধূমপান করার মতো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এই পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
কিন্তু বিষয়টি শুধু পুরুষতন্ত্রের গোঁড়ামি নয়, এর গভীরে রয়েছে পুরুষের নিম্নাঙ্গকেন্দ্রিক মানসিকতা। যখনই একজন নারী স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে, পুরুষের অবচেতন মনে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় জন্ম নেয়। নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা পুরুষের জৈবিক আধিপত্যবাদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।
এ কারণেই, একজন নারী প্রকাশ্যে ধূমপান করলে, সেটি অনেক পুরুষের জন্য যৌন উত্তেজনার এক অনির্বচনীয় সংকেত হয়ে ওঠে। আর যেহেতু সমাজ নারীর যৌন স্বাধীনতাকে অনুমোদন দেয় না, তাই পুরুষ নিজের কামনা গোপন করতে গিয়ে নারীকেই দোষারোপ করে। সে ধর্মের নামে নারীকে শাসন করতে চায়, কিন্তু আসলে এটি তার নিজের যৌনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারারই বহিঃপ্রকাশ।
পুরুষের যৌনতাড়িত সংকট ও ধর্মের শরণ নেয়ার স্বরূপটি আসলে কেমন? “মনোসমীক্ষণ”(Psychoanalysis) নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক ও “মনোবীক্ষণের জনক” হিসেবে পরিগণিত সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষের চিন্তা ও আচরণের প্রধান চালিকা শক্তি তার যৌন-তাড়না বা Libido। কিন্তু এই তাড়নাকে যদি সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে তা বিকৃত রূপ নেয়। বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্রে ধর্মের অপব্যাখ্যা সেই বিকৃতির অন্যতম হাতিয়ার।
যখন কোনো নারী স্বাধীনভাবে ধূমপান করে, তখন সেই পুরুষেরা মনে করে, এই নারী তার দেহের ওপর “নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে”—যা তাদের জন্য এক “হুমকি” হয়ে দাঁড়ায়। যখন কোনো নারী নিজস্ব ইচ্ছামতো পোশাক পরে, তখনও তারা মনে করে, সেই নারী পুরুষের কামনা মেটানোর জন্য উপলব্ধ নয়, বরং তার নিজস্ব চেতনা আছে। ফ্রয়েড বলেন, যখন যৌনতাড়িত কামনা দমন করা হয়, তখন তা আগ্রাসনে রূপ নেয়। এই পুরুষরা নিজেদের অক্ষমতা, দমন ও যৌন হতাশাকে আড়াল করতে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। তারা নিজেদের কামনা ও ব্যর্থতাকে লুকানোর জন্য নারীর পোশাক, চালচলন, স্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে আক্রমণ করে।
নারীকে দমিয়ে রাখার মানসিকতার ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণ কী বলে? ফ্রয়েড তাঁর “The Ego and the Id” বইতে বলেছেন, মানুষের মানসিক গঠনের তিনটি স্তর আছে—
• Id (আবেগ ও কামনা): এটি পশুত্বের স্তর, যেখানে মানুষ কেবল তার জৈবিক চাহিদা নিয়েই বেঁচে থাকে।
• Ego (বাস্তবতাবোধ): এটি আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা।
• Superego (নৈতিকতা ও সামাজিক বিধান): এটি আমাদের মূল্যবোধ তৈরি করে।
বাংলাদেশের এই পুরুষরা Id স্তরে আটকে গেছে, যেখানে তারা শুধু নারীর শরীরকে নিয়েই ভাবে। Superego, অর্থাৎ নৈতিকতার পরিশীলন, এখানে নেই। ফলে তারা তাদের দমন করা যৌনতাড়নাকে ধর্মের মুখোশ পরিয়ে বৈধতা দিতে চায়।
ফ্রয়েড আরও বলেন, “সেক্সুয়াল রিগ্রেশন”, অর্থাৎ যদি কেউ তার যৌনতা নিয়ে সুস্থ মানসিক বিকাশ না ঘটাতে পারে, তবে সে অপরাধমূলক বা বিকৃত পথে চলে যায়। এই পুরুষদের ক্ষেত্রেও আমরা সেটাই দেখি। তারা হয় নারীর ওপর সহিংস হয়, নয়তো ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সত্যিকারের ধর্মীয় চেতনা নয়, আসলে কামনার নিয়ন্ত্রণ চায় তারা। এই পুরুষদের আসল সমস্যা ধর্মীয় অনুভূতি নয়, বরং তাদের নিজের দমিত যৌনতাড়িত মানসিকতা। তারা নারীর পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলে, কিন্তু পুরুষের পোশাক নিয়ে কোনো কথা বলে না। তারা নারীর ধূমপান নিয়ে আপত্তি তোলে, কিন্তু পুরুষের ধূমপান নিয়ে কিছু বলে না।
এটি স্পষ্টভাবে “Double Standard”, যা ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের ভাষায় “Projection” নামে পরিচিত। অর্থাৎ, পুরুষ তার নিজের কামনা ও যৌন হতাশাকে স্বীকার করতে চায় না, বরং নারীকে দায়ী করে।
আমরা বলতে পারি পুরুষকে তার বোধসম্পন্ন মগজে ফিরতে হবে। বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্র আজ নিম্নাঙ্গের দাসত্বে বন্দি। এই মনস্তাত্ত্বিক জেলখানা থেকে বের হতে হলে প্রথমেই আমাদের স্বীকার করতে হবে—আমাদের সমাজ যৌনতাড়িত পুরুষদের হাতে বন্দি হয়ে আছে, যারা নিজেদের দমন করতে না পেরে নারীর ওপর সেই দাসত্ব চাপিয়ে দিতে চায়।
ধর্মীয় মূল্যবোধকে যৌনশাসনের হাতিয়ার বানিয়ে রাখা পুরুষদের জন্য সুবিধাজনক, কারণ এটি তাদের কামনার দায় নারীর ওপর চাপানোর সুযোগ দেয়। কিন্তু যদি এই বাস্তবতা আমরা মেনে নিই, যদি আমরা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকি, তবে এই মানসিক দাসত্ব চিরকাল চলতেই থাকবে।
তাই আমাদের প্রশ্ন করতে হবে—আমরা কি মগজের শক্তিতে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, নাকি আমরা নিম্নাঙ্গের দাসত্বে পড়ে থেকে ধর্মের নামে আমাদের লালসাকে জায়েজ করে যাব?
বাংলাদেশের পুরুষরা যদি সত্যিই উন্নততর স্তরে পৌঁছাতে চায়, তবে তার মগজকে কাজে লাগাতে হবে। নারীকে “নিয়ন্ত্রণের বস্তু” নয়, বরং “মানুষ” হিসেবে দেখতে হবে। ধর্মকে যৌন হীনম্মন্যতার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। নিজের কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নারীকে নয়। যদি তা না পারে, তাহলে এই পুরুষেরা আজীবন নিম্নাঙ্গের দাস হয়েই থাকবে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
• Freud, Sigmund – “Three Essays on the Theory of Sexuality” (1905)
• Freud, Sigmund – “The Ego and the Id” (1923)
• Judith Butler – “Gender Trouble: Feminism and the Subversion of Identity”
• Klaus Theweleit – “Male Fantasies”
লেখক: সাংবাদিক
৬ মার্চ ২০২৫