নারী স্বাধীনতা আন্দোলনে পারস্য উত্তাল- কোন পথে বাংলাদেশ?

ফারদিন ফেরদৌস:

গুগল করলেই দেখে নেয়া যায় ষাট বা সত্তরের দশকের বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ইরানের নারীদের জীবনধারা কেমন ছিল। আর এখন কোথায় সেঁধিয়ে দেয়া হয়েছে!

আচারিক জীবনে এতদাঞ্চলে তখনকার দিনে যে ধর্মটি ছিল, এখনও ঠিক একই ধর্ম আছে। প্রকৃত ধর্ম দর্শন বরাবর অপরিবর্তনীয়। কিন্তু ধর্মে যখন রাজনীতির ভেজাল মিশিয়ে দেয় গোঁড়া ও আত্মস্বার্থনিমগ্ন কিছু মানুষ, তখন তারা সর্বাগ্রে মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির টুটি চেপে ধরতে চায়। এর এক নাম্বার বলি হয় নারীরা।
এদের যত ভয় নারী প্রগতি ও অর্জনে। নারীকে বাইরে দেখলেই কূপমণ্ডুক এই গোষ্ঠিটির ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি উল্লেখিত দুটি দেশের মতো বাংলাদেশেও আজকাল দেশজ সংস্কৃতি ও নারী প্রগতি বিরোধী উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। আপোসকামী রাজনীতি তাদের শিকড়ে জল ঢেলে যাচ্ছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এর ভয়াল মূল্য চুকাতে হবে!

প্রকৃতিগতভাবে পুরুষের শারীরিক শক্তি বেশি। পিতৃতন্ত্রের ভয়াল জুজুও তার একার। যা দিয়ে খুব সহজেই নারীকে কোণঠাসা করে রাখা যায়, কাবু করা যায়। এবং যে অঞ্চলের নাম মেনশান করা গেল সেখানটাতে হচ্ছেও তাই।

একটু খেয়াল করলেই অনুধাবন করা যায় আগে আমরা কেমন ছিলাম, আর এখন কোন অন্ধকার পথে ধাবমান!
নারীও মানুষ। অথচ তার চুল দেখানো পাপ! মুখ দেখানো গুণাহ্। কিন্তু নারীর সামনে পৌরুষত্ব দেখানোয় কোনো পঙ্কিলতা নেই! সামান্যতম নিষেধাজ্ঞাও নেই। পুরুষ নিজের ওপর নিজে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে না!

ধর্মাচার ভীতিকর কিছু নয়, তারপর ধর্মের ডর দেখিয়ে নারীকে অন্তপুরে ঠেলে দিয়ে অবরোধবাসিনী করবার পায়তারা করছে একশ্রেণীর ধর্মগুরু। নারীরা যে এটা স্বেচ্ছায় মেনে নেয় না এর জলজ্ব্যান্ত প্রমাণ এইসময়ের ইরান।

মাথায় স্কার্ফ পরা সঠিক হয়নি অভিযোগে গ্রেফতার মাশা আমিনির হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের নারীরা তাদের আগের জীবন ফেরৎ চাইছে। দাবিতে অটল তারা পুলিশের গুলির মুখে বুক চিতিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের আরোপিত খোলস খুলে ফেলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। চুলের পাপ কেটে ফেলে দিচ্ছে। শরীরের শিল্প চোখের সামনে এনে পুরুষের অযাচিত যৌনবাসনাকে ধুয়ে ক্লিন করে দিচ্ছে।

বিবিসি জানাচ্ছে, এক ইরানি মা তাঁর ছেলের কবরের পাশে বিলাপ করছেন।
:’শান্তিতে ঘুমাও আমার জান। তুমি একজন শহীদ। আমার চোখের মণি’।
১৬ বছরের জাকারিয়া নারী অধিকারের দাবিতে চলমান বিক্ষোভে যোগ দিলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। সে একা নয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গেল সপ্তাহে বহু মানুষ এভাবে নিহত হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ মৃতের সংখ্যা কমিয়ে বলছে। ব্যাপক দমনপীড়ন সত্ত্বেও এই বিক্ষোভ ৮০টির বেশি শহর এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ইরাকেও ছড়িয়ে পড়েছে।

যেই সুবর্ণ দেশ ফেরদৌসী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদি, আল বিরুনি প্রমুখ উদারপন্থি মুসলিম মরমী কবি ও মনীষীর জন্মস্থান সেই দেশটিতে নারীদেরকে আত্মমর্যাদার জন্য লড়তে হচ্ছে, এর চেয়ে আফসোসের আর কী হতে পারে!

বাধ্যতামূলক বোরকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। সাথে রয়েছে তাদের পুরুষ সতীর্থরাও। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেই’র ছবি সরিয়ে ফেলছে। বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে এবং পরিবর্তনের দাবি তুলছে।
তাঁরা বলছে…
: আমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র চাই না!
: স্বৈরশাসকের মৃত্যু চাই!
: মোল্লাতন্ত্রকে সরে যেতেই হবে!

এই আধুনিক যুগে এসেও পুরুষের পরাধীন নারীকে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও অধিকারের জন্য মরণপণ সংগ্রামে নামতে হয়েছে। রাষ্ট্র তার শক্তিমত্তা দেখাতে আরোও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর প্রাণ কেড়ে নেবে এতে সন্দেহ নেই।

অন্ধকারে ঢুকে যাওয়া মুসলিম কান্ট্রিগুলো আমাদের ধর্মীয় ফাদারল্যান্ড সৌদি আরবকে দেখেও শিখছে না। চরম রক্ষণশীল সে দেশ রীতিমতো ধর্মীয় রিফরমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নারীর অধিকার রক্ষায় রেভ্যুলুশনারি ফরমান জারি করে যাচ্ছে। মিউজিক, মুভি, চিত্রকলা, ড্রামা, থিয়েটার, ড্যান্স, কনসার্ট, স্পোর্টসসহ সাংস্কৃতিক মুক্তি নিয়ে আসা হচ্ছে। সৌদি শাসককূল অনুধাবন করছে পরিবর্তিত আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে পোশাকি ধর্মের চেয়ে গবেষণা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সাথে সাথে নারীর সমানাধিকার নিয়েও কাজ করে দেখাতে হবে। এবং তারা সেটাই করছে।

আর আমরা?
সোশ্যাল মিডিয়ায় অবিরল নারীর প্রতি বিষোদগার ও দেশজ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডাকে ধর্মাচারের আওতাভুক্ত করছি। মুখ ঢেকে দেয়া নারীর কৃষ্ণকায় অবগুণ্ঠন এবং ছেলেদের টাকনু বের করা পায়জামা – এই আড়ষ্টতার মধ্যেই আমাদের ধর্মবুদ্ধি সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

অগণন লুটেরা, ঘুষখোর, নষ্ট পলিটিশান, মগজ বিকৃত পেশাজীবী, বাণিজ্যিক শিক্ষক, দলদাস সাংবাদিক, খাদ্য ও ওষুধে ভেজালকারী, চরম দুর্নীতিবাজ, ধর্ষক, বলাৎকারকারী ও মুনাফাখোর তীব্র ভোগবাদি মানুষে দেশটা ভরে ওঠেছে সেটা নিয়ে কোনো ওয়াজ ও আওয়াজ নেই। সব ধর্ম এখন আটকে আছে নারীর পোশাকে, কর্মে এবং অর্জনে!

একদিন রাষ্ট্রীয় ফরমানে যখন নারীর ওপর বাধ্যতামূলক ধর্মীয় পোশাক চাপিয়ে দেয়া হবে, তাদের চিরায়ত সাংস্কৃতিক শেকড় ছিন্ন করা হবে; সেদিন আমাদের উত্তরাধিকারেরও হয়ত তাদের আপনারে ফিরে পেতে প্রগতিশীলতার অন্তরায় ও মানবতাবিরোধী মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে জীবনপণ সংগ্রাম করতে হবে?
সেদিন কি বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাবে?

লেখক: সাংবাদিক
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.