তানিয়া নাসরীন তৃপ্তি:
সম্প্রতি একটি ফেসবুক গ্রুপে এনোনিমাস হেল্প পোস্ট দেখে আমি সেখানে কমেন্ট করি। এরপর ভুক্তভোগী মেয়েটি আমাকে ইনবক্সে নক করে৷ আমি ইনবক্সে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সমস্যার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পরদিন অফিস শেষে দেখা করতে যাই।
মেয়েটিও নাম ‘নওরিন’ (ছদ্মনাম)। ২০২১-২০২২ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ভালো একটি বিষয়ে বিবিএতে ভর্তি হয়েছে সে। ফেসবুকে ভালো করে ওর চেহারা দেখিনি, তাই ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম দেখলে চিনতে পারবো কিনা। কিন্তু চিনতে একটুও কষ্ট হলো না যখন দেখলাম নিষ্পাপ চেহারার; ক্লান্ত, হতাশ ও শূন্য দৃষ্টির একজন সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণী এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। আর ভীত হয়ে উঠলাম এটা ভেবে যে, যার মানবেতর নির্মম জীবনের গল্প মেসেঞ্জারে শুনতে শুনতেই থামিয়ে দিয়েছিলাম; তার কথা মুখোমুখি কীভাবে শুনবো!
নওরিন এসে আমার পাশে বসতেই চোখ পড়লো ওর শরীরের দৃশ্যমান বিভিন্ন স্থানের জমে থাকা কালশিটে রক্ত আর দুই হাতভর্তি কাটা দাগগুলোর উপর। যে দাগগুলো সে নিজের শরীরে বিভিন্ন সময়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে করেছে বা সুইসাইডাল এটেম্পট নিতে গিয়ে। আর কালশিটে দাগগুলো সম্প্রতি করা বাবা মায়ের নির্যাতনের ফল।
মূল গল্পে আসি এবার।
নওরিনের বাবা মা দুজনেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। মা সরকারি চাকুরী করেন আর বাবা ব্যবসায়ী। মায়ের কর্মসূত্রে পাওয়া বাসস্থানেই থাকে তারা। তার বাবা-মায়ের দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়ে। আর ওরা দুই বোন। আপাতদৃষ্টিতে সুখী পরিবার বোধ হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তব চিত্র খুবই বর্বরোচিত।
নওরিনের মা যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন আল্ট্রাসনোগ্রাফির পর ডাক্তার নাকি তার বাবা-মাকে জানায় তাদের ছেলে হবে। কিন্তু বিধিবাম! আর দশটা বাঙালি বাবা-মায়ের মতো ছেলে সন্তানের স্বপ্নে বিভোর থাকা নওরিনের বাবা মায়ের ঘরে এলো কন্যা সন্তান। আর এই নারী জন্মই নওরিনের জন্য কাল হয়ে উঠলো। শৈশব থেকেই মেয়ে হওয়ার অপরাধে নওরিনের উপর চলতে থাকে অমানষিক নির্যাতন। মারতে মারতে হাত পা ভেঙে ফেলা (তিন বার), গলায় পা দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলা, মাথার চুল টেনে উপড়িয়ে ফেলা ইত্যাদি পৈশাচিক উপায়ের সব নির্যাতন তার জীবনের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব নির্যাতনের অধিকাংশই করেন তার বাবা, আর মা হচ্ছেন বাবার একনিষ্ঠ সহায়তাকারী। ক্লাস ফাইভ পর্যন্তও নাকি অনেক নির্যাতনের পর রক্তাক্ত অবস্থায় আনড্রেস করে বাসার বাইরে বের করে দেওয়া হতো তাকে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে বাবা-মা কেন এমন করবেন কোন কারণ ছাড়া! তবে এটাও ভেবে দেখা উচিত একটা শিশু কী এমন অপরাধ করলে উপরে বর্ণিত কোন ধরনের শাস্তি তাকে দেয়া যায়। আর নওরিনের অপরাধ ছিলো অনেক। যেমন – সে কেন ছেলে না হয়ে মেয়ে হলো, সে কেন কালো, সে কেন মোটা ইত্যাদি অনেক অপরাধ।
এমন নিপীড়িত হয়ে শৈশব কাটানো কত ভয়ংকর তা কল্পনা করলেও শরীর শিউরে উঠে। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হলো নওরিনের মায়ের দ্বিতীয় সন্তানও একটি হতভাগ্য কন্যা শিশু। পুত্র সন্তান না পাওয়ার ক্রোধে দুই কন্যা শিশুর উপর তাদের বাবা-মায়ের অত্যাচার দিনকে দিন বাড়তেই থাকলো।
নওরিনের মা নিজের পরিবারের অমতে অসম বিয়ে করায় তার নানাবাড়ির কেউ তাদের বিষয়ে আগ্রহী না এখনও পর্যন্ত। দাদার বাড়ির কেউও ওর বাবার ভয়ে এই নিষ্পাপ শিশুদের রক্ষা করতে আসেনি কখনও। কারণ তার বাবা নাকি নিজের বাবাকেও (নওরিনের দাদা) ধরে মারতো। কোয়ার্টারের প্রতিবেশীরা কখনও কিছু বলতে এলে বা বাচ্চাগুলোর মার ঠেকাতে গেলে তাদেরকেও অপমান করতো ওর বাবা; এমনকি মারতেও উদ্যত হতো। সব মিলিয়ে এই বাচ্চা মেয়ে দুটির আকুতি শুনে এগিয়ে আসার কেউই ছিলো না। এখনও কেউ নেই।
এভাবেই বড় হতে থাকা নওরিন স্কুলে গেলো। স্কুলের শিক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে নওরিনের শরীরের জখম দেখে তার বাবা-মাকে ডেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা সে পরামর্শ গ্রহণ দূরে থাক, উল্টো টিচারকে জানানোর অপরাধে বাড়ি ফিরে আরও নির্যাতন করেছে মেয়েটির উপর। এতোকিছুর পরও নওরিন ভালো রেজাল্ট করে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে।
মাধ্যমিকে উঠে শুরু হয়েছে আরও নতুন অত্যাচার। দশম শ্রেণি থেকে পড়াশোনাসহ সবধরনের খরচ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তারপর থেকে টিউশনি করে, স্কলারশিপ পেয়ে নিজেই নিজের টাকায় পড়াশোনা চালিয়েছে নওরিন। আবার আয়ের টাকার ভাগও দিতে হয়েছে বাবা-মাকে। তারপরও এতো এতো নির্যাতন আর ট্রমা নিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় লক্ষ লক্ষ প্রতিযোগীর মধ্যে সে ভালোভাবে টিকে থেকেছে। তার মেধা আর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।
নওরিন যুদ্ধ করে টিকে আছে, বেঁচে আছে; তবে এই বেঁচে থাকাটা সুখকর নয়; অসুস্থ বেঁচে থাকা। এতো অত্যাচার, এতো ভয়, এতো ট্রমা ওকে মেরে ফেলেছে। হতাশা আর হীনমন্যতা গ্রাস করে নিয়েছে ওর সবটুকু। ও আর দশটা শিশুর মতো আদর-ভালোবাসা পায়নি, ভালো কথা শুনেনি, বন্ধুদের সাথে খেলেনি-মেশেনি, মিশতে দেওয়া হয়নি, ও জানে না শৈশব কত মিষ্টি-মধুর, ও কৈশোরে অন্য মেয়েদের মতো অকারণে খিলখিলিয়ে হাসেনি বা হুটহাট প্রেমে পড়েনি। তারুণ্য শুরু হওয়ার আগেই এই মেয়েটি হাতের রগ কেটে, ফাঁস নিয়ে, স্লিপিং পিল খেয়ে ইত্যাদি নানা উপায়ে নয়বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। জীবনের প্রতি কত কত বিতৃষ্ণা এলে ছোট্ট একটা মেয়ে এভাবে নিজেকে শেষ করতে যায় বার বার! ওর সারা শরীর ও মনে জখম আর ক্ষত। ওর সারা স্মৃতিতে গালিগালাজ, মারপিট।
ওর চুলগুলো সুন্দর বলেছিলাম তখন বলেছিলো “আপু আমার মনে হয় মাথার চুলগুলো ন্যাড়া করে ফেলি। চুল ধরে এতো জোরে টানে যে গোড়া দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়।” ক্লাস ফোরে থাকতে নাকি তার বাবা ডান পাশের চিপের চুল টেনে চামড়াসহ উঠিয়ে ফেলেছিলো। ওর মাধ্যমিকে পড়া বোনটিকেও ওর বাবা-মা একইভাবে নির্যাতন করে। বোনকে রক্ষা করতে গিয়ে নওরিন আরও ডাবল মার খায় এখন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, সে কেন আরও টাকা আয় করে দিচ্ছে না তার বাবা-মাকে! সারাদিন রাত ভর্ৎসনা, গালিগালাজ, কালো কেন, মোটা কেন, টাকা দেয় না কেন ইত্যাদিসহ নানান নোংরা কথা। নোংরা কথাগুলো মা বেশি বলে আর বাবা পিটানোর কাজে দক্ষ। এরপরও তারা আশা করে তাদের সন্তান তাদেরকে আয় করে টাকা দেয়াসহ মশারি টাঙানো টাইপ সবধরনের সেবা দিতে বাধ্য। কারণ তারা জন্মদাতা-দাত্রী এবং তারা সেবাগুলো যেভাবেই হোক আদায় করেই নেয় নওরিনের কাছ থেকে।
ওকে প্রশ্ন করতে বা ওর গল্প শুনতে আমি ভীত থেকে আরও ভীত বোধ করছিলাম সেদিন। কী শৈশব, কী কৈশোর, কী তারুণ্যের প্রারম্ভ; কোন পাপে বা কর্মফলে এমন নির্মম মানব জন্ম! তারপর থেকে এই শিশু নির্যাতন, এই বর্বরতার মূল খুঁজছি। জানতে পারলাম নওরিনের মাকেও তার বাবা নির্মমভাবে পেটায়। কিছুদিন আগেও নাকি হাত ভেঙে দিয়েছিলো এবং পরদিনই তার মা ভাঙা হাত নিয়ে স্বামীকে বিরিয়ানি রান্না করে খাইয়েছেন। নওরিনদের সংসার তার মায়ের আয় দিয়েই চলে। আর নওরিনের মায়ের পরিবার ও তার চাকরি ও অন্যান্য যোগ্যতা সবদিক দিয়েই আর্থ-সামাজিক মাপকাঠিতে ওর বাবার তুলনায় এগিয়ে। কিন্তু তারপরও কেন নিজের ও নিজের সন্তানদের প্রতি হওয়া এতো অত্যাচার উনি মেনে নেন? শুধু মানেন বললে ভুল হবে উনি পরিচর্যা করেন স্বামীর পাশবিকতাকে। নিজে সব ধরনের অত্যাচার সহ্য করেন ভালোবাসা ভেবে আর স্বামীর সহোযোগী হয়ে নিজের সন্তানদের অত্যাচার করেন। উনি স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ। ওর বাবার নামে কেউ কিছু বললেই নাকি ওর মা ক্ষেপে যায়। উনার নিজ পরিবারের সাথেও সম্পর্ক নেই একারণে। নওরিনরা দুই বোন কখনও ওর বাবার বিরুদ্ধে কিছু বললেই নাকি ওর মা ওদের পেটানো শুরু করে।
এই যে স্বেচ্ছা দাসীবৃত্তির স্বভাব, এটা একধরনের অসুস্থতা যেটি Battered woman syndrome (BWS)
নামে পরিচিত। এই অসুস্থতাটি সাধারণত মেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। দীর্ঘদিন যাবৎ পুরুষ সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ফলে এই উপসর্গ দেখা দেয়। এটি Post-traumatic stress disorder (PTSD) এর একটি উপশ্রেণী। এর অন্যতম উপসর্গ পুরুষসঙ্গীর দোষ গোপন করা, জাস্টিফাই করা, নির্যাতনের কারণ হিসেবে নিজেকেই দোষী ভাবা ইত্যাদি। আমাদের সমাজের অনেক নারীই এই রোগে আক্রান্ত। আমি বলবো আমাদের সমাজ এই রোগ বিস্তারের সূতিকাগার। এই সমাজই নওরিনের মায়ের মতো সব মেয়েকে শিখিয়েছে পুরুষ তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, স্বামীর পায়ের নিচে বেহেশত, স্বামীর প্রহার হালাল, স্বামী সেবা পরম পূণ্য, স্বামী না থাকলে কোন গতি নেই ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। এ সকল শিক্ষার কুফল নওরিনের মা তার জীবন জুড়ে ভোগ করে শেষ হলেও এক কথা ছিলো; তার সাথে কুফল বয়ে বেড়াচ্ছে তারই দুটি কন্যা শিশু। যারা তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াবে এসব দুর্বিষহ স্মৃতি, ট্রমা আর অসুস্থতা। অথবা হয়তো এদের জীবনের ব্যাপ্তি কমে যাবে আত্মহত্যার মাধ্যমে।
নওরিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ড্রাগ নেয় কিনা। বললো, আপু, টাকা কই পাবো? টাকা থাকলে হয়তো নিতাম। ও এডিক্টেড হলেও আমি অবাক হতাম না; ওর সুইসাইডাল টেন্ডেন্সিতেও অবাক হইনি। বরং অবাক হয়েছি ওর আশ্চর্য জীবনীশক্তি দেখে; ওর লড়াই করে টিকে থাকার ক্ষমতা দেখে। আমার মনে মায়া মমতার সাথে শ্রদ্ধাও জন্মেছে ওর প্রতি।
বাবা মায়ের দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকা এই শিশুদের পাশে কেউ না দাঁড়ানোর মূল কারণও আমাদের সমাজেই নিহিত। আমাদের সমাজ ও ধর্মে বাবা মায়ের ভূমিকাকে সর্বদা অতিমাত্রায় গ্লোরিফাই করা হয়। বাবা মায়ের কোন ভুলই হতেপারে না, কোন ব্যতিক্রমও হতে পারে না, তাদের মত নিঃশর্তভাবে কেউ ভালোবাসতে পারে না, তারাই সর্বোচ্চ মঙ্গল সাধন করেন ইত্যাদি নানান মাহাত্ম্য গাথা। যেই সমাজের চোখে বাবা মায়ের ইমেজ এমন সেখানে নওরিনের অবস্থায় বা এর ধারেকাছের কোন ঘটনা হলেও সামাজিক জীবগণ এসে আগে সন্তানটির ত্রুটি খুঁজতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর বিচার সালিশ শেষে বাবা মা যা করেছেন সন্তানের ভালোর জন্যই করেছেন এমন কিছু প্রমাণ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে শান্তি পান।
মেনে নিলাম নওরিনের বাবা মায়ের মতো বাবা মায়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কিন্তু আমাদের দেশের অন্যান্য বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তো বাবা মা আসলেই কি সন্তানের সর্বোচ্চ মঙ্গল করেন, নিঃশর্ত ভাবে ভালোবাসেন, তারা কি সবসময়ই সঠিক কিনা। মঙ্গলের কথা যদি বলি আমাদের বাবা মা মঙ্গল চেয়ে সন্তানকে ডাক্তারি বা উকালতি পড়ান বা পড়তে বাধ্য করেন, কারণ তাদের স্বপ্ন ছেলে বা মেয়ে ডাক্তার/উকিল হবেন। অথচ সন্তানের ইচ্ছে ছিলো হয়তো সে খেলোয়াড় হবে বা অন্য কিছুর প্রতি আগ্রহ ছিলো। সেটা সবসময় উহ্য থেকে যায়। আমাদের দেশে ৯৯% সন্তানের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার হয় বাবা মায়ের ইচ্ছেয় বা স্বপ্নপূরণের জন্য। এরা নিজের পছন্দমতো বিষয়ে পড়তে পারে না, নিজের ইচ্ছেমতো জব করতে পারে না এমনকি লাইফ পার্টনারও সিলেক্ট করতে পারে না। কারো হয়তো আর্ট শেখার খুব ইচ্ছে, কিন্তু তার মায়ের ছোটবেলায় গান শেখার ইচ্ছে ছিলো পারেনি, তাই এখন বাচ্চাকে দিয়ে সেই খায়েশ পূরণ করতে অবশ্যই গানই শিখতে হবে বাচ্চাটিকে বা কেউ কিছু শিখতেই চায় না তাকেও ক্যারাটে থেকে নাচ গান সব শিখতে হবে কারণ তার বাবা মায়ের ইচ্ছে/স্বপ্ন। আমাদের বাবা মায়ের আশা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা সব পূরণের মেশিন হয়ে জীবন পার করার নামই বাবামায়ের চাওয়া সর্বোচ্চ মঙ্গল। অনেক সারাজীবন ধরে এই চাপিয়ে দেয়া মঙ্গলের হতাশা বয়ে বেড়ান।
আর নিঃশর্ত ভালোবাসার বিষয়টি আরও অলীক। আমাদের দেশের অধিকাংশ বাবা মা-ই সন্তান জন্ম দেন উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি না জেনে। যেমন সন্তানরা বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখভাল করবেন। ছেলে সন্তান কামনার মূল ভিত্তিই তো এটা। যেহেতু আগে মেয়েদের আয়ের উৎস ছিলো না বা আয় করার মত যোগ্য করা হতো না বরং যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে খরচ হতো। আর এখন আয় করতে পারলেও পুরুষতান্ত্রিক নিয়মে শ্বশুরবাড়ি চলে যায় মেয়ে ও মেয়ের আয়। তাই অর্থনৈতিক সুবিধা সহ বৃদ্ধ বয়সের সকল ধরনের সুবিধার উৎস হিসেবে ছেলে সন্তানই লাভজনক।
বাবা মা যেহেতু মানব গোত্রের, সেহেতু তাদের ভুলও অবশ্যই হয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাবা মায়েরাই সঠিক প্যারেন্টিং জানেন না বা জানার চেষ্টাও করেন না। কারণ তারা জন্ম দিয়েছেন সেই ঋণ শোধ করেই কূল পায় না সন্তানেরা তার উপর তাদের প্যারেন্টিং এর ভুল ধরতে আসবে; কার ঘাড়ে কয়টা মাথা। সন্তান যে আলাদা একজন স্বত্ত্বা, আলাদা একজন মানুষ এটা স্বীকার করতেই নারাজ আমাদের বাবা মায়েরা। এরা সন্তানকে নিজের সম্পত্তি মনে করে। তারা এই মানতে নারাজ যে তারই জন্ম দেয়া সন্তান তার চেয়ে বেশি জানে কিছু। বাবামায়ের আদেশে বিয়ে থেকে শুরু করে জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকেরই ভুল হয়, হচ্ছে। কারণ কেউই নির্ভুল হতে পারে না।
বরং বাবা মায়ের প্রধান দায়িত্ব একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের লালন পালন করা। কারণ সন্তান আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়েনি তাদের কোলে; বাবা মায়ের ইচ্ছেতেই পৃথিবীতে এসেছে তারা। স্বাভাবিক একটা দায়িত্বকে এত গ্লোরিফাই করার ফলেই সন্তান সম্পত্তির মত ব্যবহৃত হচ্ছে; কেউ কেউ নওরিনদের মত নির্যাতিত হচ্ছে। আমাদের দেশের শিশু নির্যাতন দমন আইনে বাবা মা কতৃক শিশু নির্যাতনের বিধিবিধান খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরিচিত কয়েকজন লইয়ারকে জিজ্ঞেস করে এখনও কোন স্পেসিফিক উত্তর বা ধারার রেফারেন্স পাইনি। হয়তো সেভাবে আলাদা কোন আইন নেই বা থাকলেও প্রয়োগ হয়নি দেখেই সহজে কেউ বলতে পারছে না। তবে আমি এখনও খুঁজছি।
ট্রিপল নাইনে কল দিলে হয়তো পুলিশ আসবে। কিন্তু নির্যাতিত ও আহত বাচ্চা মেয়েদের কি আর ট্রিপল নাইনে ফোন করার কথা মাথায় আসবে? আর এলেও বাংলাদেশে বড় হওয়া পুলিশ সদস্যরাও হয়তো সন্তানের দোষই খুঁজে পাবেন শেষে। তাছাড়া পুলিশ আসার পর কী হবে? মেয়েটি কোথায় যাবে? সরকারি কোনো ব্যবস্থা তো নেই! অনেক এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা বা এ ধরনের সংস্থা হয়তো হেল্প করতে পারে, কিন্তু তাও অনিশ্চিত। আর তার খবর নওরিনদের মত ট্রমাটাইজড শিশু-কিশোরদের নাগালে থাকার কথা না। উন্নত দেশের মত কল করার সাথে সাথে পুলিশ এসে সেইফ হোমে নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের দায়িত্ব নেয়ার ঘটনা আমাদের মুভি সিরিজে দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আমার সাথে নওরিনের প্রথম সাক্ষাৎ হয় সোমবারে। বৃহস্পতিবার ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে উঠার ভাইভা। যেখানে ওর একজন লোকাল গার্ডিয়ান উপস্থিত থাকতে হবে। যেহেতু তার বাবা-মা জানলে হলে উঠতে দিবে না, আর আত্মীয় স্বজন কেউ হেল্প করবে না লোকাল গার্ডিয়ান হিসেবে ভাইভাতে এসে; তাই সে ডিপার্টমেন্টের এক বড় আপুর মাধ্যমে গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলো হেল্প চেয়ে। যদি হলে উঠে সাময়িক মুক্তি মেলে সেই আশায়।
অফিসে ম্যানেজ করে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভাইভাতে উপস্থিত হতে গিয়ে শুনলাম লিগ্যাল গার্ডিয়ানকেও নাকি আবশ্যিকভাবে উপস্থিত হতে হবে ভাইভাতে, যা নওরিনের জন্য অসম্ভব। দেখলাম একে একে অনেক মেয়েকেই ভাইভা না নিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে । আমি একটু বোঝানোর চেষ্টা করলাম দায়িত্বরত নারীকে, কিন্তু তাতে একবিন্দুও কাজ হলো না। এখানেও মেয়ে হওয়ার পাপে এমন হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হবার সুবাদে নিজেই দেখেছি ছেলেদের হলে এসব নিয়মকানুনের কোন বালাই নেই। এমনকি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কাটিয়ে চাকরি পাওয়া পর্যন্ত তারা হলে থাকে, কিন্তু তাদের অনাবাসিক ছাত্র কার্ড থাকে। ফলে হলের মাসিক ফি’টাও দেয়া লাগে না। আর মেয়েদের হলে আমাদের সময় লোকাল গার্ডিয়ান লাগতো এখন আবার লিগ্যাল এড হয়েছে।
হলে সিট নিয়ে ঢাকায় নতুন আসা ছাত্রছাত্রীরা এমনিতেই অনেক দুশ্চিন্তায় থাকে, তারপর এমন ঘটনায় বাচ্চা মেয়েটির মুখটা শুকিয়ে গেলো। আমিও চিন্তা করছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর বাড়িই ঢাকার বাইরে আর অর্থনৈতিক অবস্থাও অনেকেরই ভালো না। আবার অনেকের ঢাকায় আত্মীয়স্বজনও নেই। এখন ঢাকার বাইরে থেকে ছাত্রীর বাবা/মায়ের আসা যাওয়ার খরচ বা হোটেল ভাড়া করে থাকার খরচ আর সবকিছুর ধকল কি খুব জরুরি হলে থাকার শর্ত হিসেবে? মেয়েরা এমনিতেই নিয়মানুবর্তী, শৃঙ্খল, তার উপর ১৮+ একজন মেয়ের হলে উঠতে কেন এতো নিয়মের বেড়াজাল! ১০০ বছরেও কি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বুঝতে পারেনি কাদের নিয়ন্ত্রণ করা বেশি কঠিন ও জরুরি? ছেলেদের হলে যতবার মারামারি লাগে এক বছরে; মেয়েদের হলে ততোবার কথাকাটিও হয় না বোধহয়। মেয়েদের হলের এই নিয়মগুলো বরং ছেলেদের হলে দেয়া উচিত যেখানে অনিয়মে বহিরাগতের ঠ্যালায় আসল ছাত্ররা থাকতে পারে না। মেয়েরা প্রতিটি নিয়ম মেনে, প্রতিটি পয়সা পরিশোধ করে হলে থাকবে তারপরও এত আজাইড়া নিয়ম কেন!
নওরিনের হলে উঠার প্রক্রিয়া শিক্ষকদের সহায়তায় চেষ্টা চলমান রয়েছে। হলে উঠে হয়তো সাময়িক কিছুটা মুক্তি পাবে সে। কিন্তু ওর ছোটবোনকে হয়তো আরও কিছু বছর নির্যাতিত হতে হবে পাশবিক বাবা-মায়ের কাছে। যেহেতু উন্নত বিশ্বের মতো সেইফহোমে যাবার সুযোগ নেই। তবে নওরিনের জীবনীশক্তি, লড়াইয়ের দক্ষতা বলে দেয় ও হার মানবে না। মাথা উঁচু করে বাঁচবে, বোনকেও বাঁচাবে।
তুমি বেঁচে থাকো নওরিন; তোমার বেঁচে থাকা বড্ড প্রয়োজন। তুমি হীনমন্যতাকে ছুঁড়ে ফেলো; তুমি নগণ্য কেউ নও, সাধারণ কেউ নও; তুমি অন্যতম। এতো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তুমি একা যুদ্ধ করে এতোদূর এসেছো, এখন আর থমকে গেলে চলবে না। ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো, এমন যোগ্য করো যে তোমার ছদ্মনাম নয়, প্রকৃত নামেই তোমায় চিনুক দেশ, জাতি, বিশ্ব। নিজের জন্য বাঁচো, বোনকে বাঁচতে শেখাও, তোমার মায়ের মতো অসুস্থ নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ায়, তোমাদের মত নির্যাতিত শিশু-কিশোরদের সহায় হও; তোমার বাবার মত পাশবিক মানুষদের শাস্তি নিশ্চিত করো এই কামনা করি। তোমার এই পাপের জন্মকে তুমি গৌরবময় আর সাফল্যময় করো এমনভাবে যেন কোন মেয়ে নারী জন্মের জন্য দুঃখ না করে। তোমার জীবনের কোন অংশে আমি ছিলাম ভেবে সেদিন আমি গর্বিত হতে চাই। ভালোবাসা আর শুভাশিস তোমার জন্য।