সুপ্রীতি ধর:
ভালোই হলো রে মা, চলে গেছিস, একদম ঠিক কাজটি করছিস। এই অসভ্য, বর্বর সমাজে তোর মতোন মেয়েদের বাঁচার কোন অধিকার নেই, ছিলও না কোনকালেই। শরীরীভাবে বেঁচে থাকলে এই সমাজ, এই রাষ্ট্র তোকে মানসিকভাবে বাঁচতে দিত না, তোর পরিবারও উঠতে-বসতে তোকে বলতো, ‘পোড়ারমুখী, মরলি না ক্যান!’ তোর মা-ই তোকে বলতো এই কথা যখন পাড়া প্রতিবেশির কথার খোঁচায় অতিষ্ট হয়ে উঠতো!
তুই যখন কৈশোর পার হতি, তোর শরীর নারী হয়ে উঠতে থাকতো, তখনও সবাই খাবলে নিতে চাইতো তোকে! ভাবতো, আহা, ওর আবার মানসম্মান কী! ধর্ষণের শিকার মেয়েদের মানসম্মানও থাকে না তো, তুই এটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছিলি, নইলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলি কেন? ছোটবেলার এই ক্ষত তোর বুড়ো হলেও যেতো না। তুই বড় হয়ে উঠতি মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে। তোকে আপাদমস্তক বাড়তি কাপড়ে মুড়ে দিত তোর মা, যাতে তোর মুখ বা শরীর কেউ না দেখে, যাতে কেউ তোর দিকে আঙ্গুল তুলে না বলে, ওই যায় অমুকের ‘কুলহারা’ মেয়ে! আমি বলে দিচ্ছি একের পর এক কীভাবে তোকে প্রতিনিয়ত ব্যবচ্ছেদ করতো যদি তুই বেঁচে উঠতি!
কোনরকমে বেঁচে থাকার চাইতে এই ভালো হলো তুই বীরের বেশে প্রস্থান করলি! আমরা তোকে নিয়ে শোক করবো, কবিতা লিখবো, গান রচনা করবো বেশ কিছুদিন। তারপর একদিন সব থেমে যাবে। দরিদ্র, দুখী মায়ের নাভিমূলে কিছুদিন ব্যথা করবে, তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই শোনা যাবে না। আর সেই বোনটি, যার কাছে তোকে পাঠানো হয়েছিল সে ভয় পায় বলে, সেই বোনটি কিছুদিন তোর জন্য নিজেকে অভিশম্পাত করবে ঠিকই, কিন্তু কাটিয়ে উঠবে সেও। জীবন বাস্তবতা এমনই যে তুই আর কোথাও থাকবি না। এই সমাজ ধর্ষণের শিকার মেয়েদের ঠাঁই দেয় না, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে শুনলে ছি ছি করে, তার চেয়ে এই ঢের ভালো হলো রে মা।
পূজার দিকে তাকিয়ে দেখ, কী অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মেয়েটি আছে এই সমাজে! আমার নিশ্চিত ধারণা, ওর মা-বাবাও প্রতিনিয়ত ওর মৃত্যু কামনা করে। পূজা এখন কিশোরী, ঠিকমতোন হাঁটতে পারে না, ওর যোনিও ব্লেড দিয়ে কেটে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল, ওর সেই কষ্ট দেখে, প্রতিবেশির খোঁচা শুনে তারা প্রতিটা মুহূর্তে এই আশাই করে। পূজা নিজের শরীরকে কতোটা ঘৃণা করে, জানিস তো? শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার কারণেই ওর জীবনটা এমন তছনছ করে দেয়া হলো! এখন সেই ধর্ষক জামিনে বেরিয়ে এসে ওদের বাড়ির সামনেই ঘোরাফিরা করছে, আর পূজা ঘরের ভিতরে আশ্রয় নিচ্ছে ভয়ে-আতংকে-লজ্জায়-কষ্টে। পূজার মা-বাবাও কোণঠাসা হয়ে আছে। ধর্ষক বাইরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে আর তাদের মেয়ের জীবন কাটছে ঘরের অন্ধকারে।
তুই বেঁচে থাকলে তোর জন্যও এমনটাই অপেক্ষা করতো! তোর ওই বোন জামাই, বোনের শ্বশুর, দেবর সবাই বেরিয়ে আসতো জেল থেকে, আর তুই আর তোর বোন মনে মনে বিষ গিলতি প্রতিটা মুহূর্তে। এখন জানি না তোর বোনের কী হবে? তবে আমি খুশি তোর সিদ্ধান্তে।
মরে গিয়ে বেঁচে গেলি, আমাদেরও বাঁচিয়ে দিয়ে গেলি।