মা-ছেলের বন্ধুত্ব

জান্নাতুল নাঈম পিয়াল:

শেফালির আজ বড় আনন্দের দিন। আজ ভোরেই তার ছেলে সুজন বাড়ি এসেছে। নাইট কোচে রাত নয়টার সময় ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিল। পৌঁছেছে ফজরের আজানের একটু আগে। এসেই কোনো রকমে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। শেফালি গালে তুলে খানিকটা ভাত খাইয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু ঘুম চোখে কি আর কোনো স্বাদ পেয়েছে!

এখন বেলা সাড়ে বারোটা বাজে। অঘোরে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই জাগবে। আর জেগেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলবে চিৎকার করবে, মা খিদে লেগেছে, খেতে দাও। শেফালি যদি বলে, আগে গোসলটা করে আয় না, তবু শুনবে না। বলবে, না আগে খাবো, তারপর অন্য যা করার করবো। শেফালি অবশ্য এরপর আর বেশি জোর করবে না। ঢাকায় হলে থাকে ছেলেটা, কী না কী খায় আল্লাহই জানে। বাড়ি এসে মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার জন্য তো পাগল হবেই।

শেফালি তাই সেই সাত-সকালে উঠেই ছেলের পছন্দের পদ্গুলো রান্না করে রেখেছে। খুব বেশি কিছু অবশ্য না। লাউশাক ভাজি, আলু ভাজি, বড় বড় পিসের মুরগি, আর ঘন ডাল। এ দিয়েই চেটেপুটে কয়েক প্লেট সাবাড় করে দেবে ছেলেটা। বাড়ি আসার পর প্রথম কদিন যেন বাঘের খিদে থাকে পেটে।

যথারীতি সুজন ঘুম থেকে উঠেই খেতে দেয়ার জন্য হাঁকডাক শুরু করে দিল, আর শেফালিও সব সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিল। ছেলেটা যখন খাচ্ছে, শেফালি তখন একটা বার্বিডল হাতে করে এনে ছেলের সামনে বসলো। বললো, চিনতে পারছিস এটা?

সুজন খাওয়া থেকে মুখ তুলে এক পলক চোখ তুলে তাকিয়ে বললো, উ… না তো!

শেফালি তখন প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগলো, তোর তৃতীয় জন্মদিনের দিন তোর ছোট মামা এটা দিয়েছিল তোকে। এতো খুশি হয়েছিলি তুই যে কখনো এটাকে কাছছাড়া করতে চাইতিস না। এমনকি গোসল করার সময়ও এটাকে সাথে নিয়ে বাথরুমে ঢুকতি। প্যান্ট পাল্টাবার সময় অবশ্য এটার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতি। আমরা আর কেউ তোকে নেংটু দেখলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু বার্বি দেখে ফেললেই যেন তোর মান-সম্মান সব ধূলোয় গড়াগড়ি খাবে।

এবার যেন সুজন কিছুটা অস্বস্তিতেই পড়ে গেল। কিছুটা শঙ্কিতও হলো এই ভেবে যে মা বুঝি এবার বার্বিটার ছবি তুলে ফেসবুকে পুরো কাহিনী ক্যাপশন আকারে দিয়ে দেবে। আর তারপর মায়ের সাথে ফেসবুকে অ্যাড থাকা ওর কোনো ক্লাসমেটের চোখে পোস্টটা পড়লেই হয়েছে। ব্যাচের গ্রুপ চ্যাটে স্ক্রিনশট দিয়ে দেবে। আর শুরু হয়ে যাবে ওকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা। খুব হিউমারসম্পন্ন কেউ হয়তো বলেও বসবে, কী সর্বনাশ, সুজন দেখি ছোটবেলায় মেয়েদের মতো বার্বিডল নিয়ে খেলতো। তারপর ওর নিকনেম চেঞ্জ করে দেবে ‘সুজি’।

এইসব আশঙ্কা থেকে সুজন আমতা আমতা করে বললো, উফ মা, এখন কি আর আমি তিন বছরের বাচ্চা আছি নাকি! কতদিন আগের কথা এগুলো। এখন আবার এটা বের করেছো কেন?

শেফালি বেশ ভালোই বুঝতে পারলো ছেলের অস্বস্তি। তবু মুখে হাসি ধরে রেখে বললো, তোর যেমন বয়স তিন থেকে বেড়ে বাইশ হয়েছে, তেমনি বার্বিটারও তো এতোদিনে বয়স বেড়েছে। সময়মতো তোকে বিয়ে দিয়ে দিলে তো তোর এমন একটা সত্যিকারের বার্বিডলও থাকতো।

এই একই কৌতুক সুজনের ক্লাসের কোনো মেয়ে যদি করতো, ওর কাছে ভীষণ কিউট মনে হতো। ভাবতো, ইশ, কী নিষ্পাপ রসিকতাই না করেছে মেয়েটা। কিন্তু মায়ের মুখে কথাগুলো শুনে কেন যেন ভালো লাগলো না ওর। সম্ভবত অবধারণগত অসঙ্গতির কারণে। মায়ের বয়স এখন কম করে হলেও পঁয়তাল্লিশ। মধ্যবয়স্কা না বলে বৃদ্ধাও বলা যায় চাইলে। তার মুখে এমন খুকিদের মতো নিষ্পাপ রসিকতা মানাবে কেন!

সুজন তাই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো, সারাদিন বসে বসে আর কোনো কাজ পাও না, নাকি? তাই এইসব আদ্যিকালের জিনিস বের করো খালি। এসব জঞ্জাল এবার বিদেয় করতে পারো তো। শুধু শুধু ঘরের জায়গা দখল করছে।

ছেলে হয়তো কথাগুলো খুব বুঝেশুনে বলেনি। তবু কেন যেন সূঁচের মতো বিঁধলো শেফালির বুকে। এক কথাতেই কতো দিক থেকে যে আক্রমণ করে বসলো ছেলেটা!

ঘরে বসে বসে কাজ না পাওয়ার কথাই যদি আসে, এমন জীবন তো সে তার ছেলের জন্যই বেছে নিয়েছিল। সে-ও তো নেহাত মন্দ কোনো চাকরি করতো না। যে কোয়ালিফিকেশন ও স্কিল তার ছিল তাতে অল্প সময়েই অনেক উন্নতিও করে ফেলেছিল। পরবর্তীতে আরো করতো। তবু ছেলের জন্মের পর ওকে দেখাশোনার কেউ ছিল না বলে নিজের চাকরিটা বিসর্জন দিয়েছিল সে। এরপর থেকে ছেলে কলেজে ওঠা পর্যন্ত ছেলের পেছনেই ব্যয় করেছে দিনের অধিকাংশ সময়। এখন না হয় ছেলে ভার্সিটিতে উঠে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে বলে স্বামীর দেখভাল করা আর হেঁসেল ঠেলার পরও দিনের অনেকটা সময় তার হাতে রয়ে যায়। সেই অবসর সময়ে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া কী-ই বা করার আছে তার। এই মফস্বল শহরের মধ্যবয়স্কা নারীদের জীবনে যে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার পর ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে।

আর এই যে আদ্যিকালের জিনিস বের করার কথা বললো! ছেলেটা বোধহয় কোনোদিন খেয়াল করেও দেখেনি, ওর মা হুট করে এসব পুরনো জিনিস টেনে টেনে বের করে না। গত বাইশ বছর ধরেই ছেলের সব স্মৃতি অতি যত্নে সংগ্রহ করে রেখেছে সে। হয়তো একদিন ছেলে দূরে চলে যাবে বুঝতে পেরেই। এখন যেহেতু সত্যি সত্যি দূরে চলে গেছে, তাই সঞ্চিত স্মৃতিগুলোকে সে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে, বুকে আগলে রেখেছে। এই একেকটা ছোট ছোট স্মৃতির মূল্যই যে তার কাছে শত-সহস্র মণিমাণিক্যের সমান, তা হয়তো ছেলেটা কোনোদিনই বুঝবে না।

তবু ছেলের উপর বেশিক্ষণ অভিমান করে থাকতে পারে না শেফালি। সে খেয়াল করে দেখেছে, ছেলেটা দিন দিন কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তা বলে খুবই কম। প্রয়োজন ছাড়া একদমই না। বিশেষ করে মায়ের সাথে যেন ওর আলাদা করে কোনো কথাই নেই। শুধু বাবার কাছে কোনো চাহিদা থাকলে, তখন প্রয়োজন পড়ে মাকে। কেননা মাকেই যে দূত হিসেবে ব্যবহার করতে হবে!

ছেলের এই হঠাৎ গম্ভীর, অন্তর্মুখী হয়ে যাওয়া শেফালিকে খুব ভাবায়। ফেসবুকে আজকাল সে প্রায়ই দেখে, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই নাকি বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত। তাদের এই অবস্থার একটা গালভরা ইংরেজি নামও আছে, ডিপ্রেশন। এমন অবস্থা সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যাও করে বসে। বিভিন্ন কারণে নাকি ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা ডিপ্রেশনে পড়ে যায়। পছন্দসই বিষয়ে পড়ার সুযোগ না পাওয়া, খারাপ ফল, ভবিষ্যতের চিন্তা, টাকাপয়সার টানাটানি, ভার্সিটির প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে না পারা ইত্যাদি। এছাড়া আরেকটি কারণে নাকি ডিপ্রেশন সবচেয়ে বেশি আসে। সেটি হলো প্রেমে ব্যর্থতা।

শেফালি ইদানিং প্রায়ই ভাবে, তার ছেলেটা কি কোনো মেয়ের কাছ থেকে বড় ধরনের কষ্ট পেয়েছে? কে জানে, পেতেও পারে। তার ছেলেটা যে সহজ-সরল আর বোকাসোকা, নির্ঘাত কোনো পাজি মেয়ে ওর মাথাটা চিবিয়ে খেয়ে এখন কেটে পড়েছে! কিংবা সে-সব কিছুই হয়তো না, সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো কারণে ছেলেটার হঠাৎ করে এমন দশা হয়েছে। কিন্তু কী সেই কারণ? এসব ভেবে ভেবে কত রাত শেফালি নির্ঘুমও কাটিয়ে দেয়।

ছেলের ব্যাপারে শেফালির চিন্তার পরিমাণ যেন একটু বেশিই লাগামছাড়া। এক্ষেত্রে ফেসবুকেরও একটা বড় প্রভাব রয়েছে। কিছুদিন আগে আরেকটা লেখাও বেশ ভাইরাল হয়েছিল ফেসবুকে। বিশ্বব্যাপী নারীদের চেয়ে পুরুষদের আত্মহত্যার হার কেন বেশি, তা নিয়ে। লেখাটা পড়তে পড়তে এক পর্যায়ে আঁতকে উঠেছিল শেফালি। কারণ সেখানে লেখা ছিল, আত্মহত্যার প্রবণতার পেছনে মূল কারণ একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা। আর এই পুরুষরা বেশি একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ অনুভব করে যেসব কারণে, তার মধ্যে প্রধানতম কারণ মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়া।

শেফালি খেয়াল করে দেখেছে, কথা তো খুব একটা মিথ্যে নয়। তার নিজের মায়ের সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মায়ের সাথে মনের অনেক কথাই সে ভাগ করে নিতে পারতো। কারণ একটা বয়সের পর মা-মেয়ে একদম বন্ধুর মতো হয়ে যায়। অনেক পর্দাই সরে যায়। কিন্তু মা-ছেলের ক্ষেত্রে কি বন্ধু হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা খাটে? খাটে না তো। মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা ছেলের প্রতিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশি থাকে, কিন্তু তারপরও তাদের সম্পর্কের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল ঠিকই গড়ে ওঠে, যে কারণে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ছেলেরা মায়ের কাছে সব কথা বলে না। অনেক কথাই গোপন করে যায়। মেয়েরাও হয়তো গোপন করে, কিন্তু ছেলেদের গোপন করার প্রবণতা একটু বেশিই থাকে।

শেফালি মনে মনে ভাবে, ছেলের ব্যাপারে সে কতটুকু জানে। একদিন বয়স থেকে শুরু করে স্কুল পর্যন্ত হয়তো ছেলের জীবনের নব্বই শতাংশ ব্যাপারই সে জানতো। কিন্তু তারপর ক্রমশ তার জানার পরিমাণ কমতে শুরু করলো। এবং এখন হয়তো দশ শতাংশও সে জানে না। ছেলের বন্ধুবান্ধব কারা, পরীক্ষায় সিজিপিএ কত, কোনো প্রেমিকা আছে কি না, ক্যাম্পাসে পড়াশোনা ছাড়া আর কী করে সময় কাটায়, সিগারেট খায় কি না, পড়াশোনা শেষ করে কী করার ইচ্ছা, এর কোনোকিছুই সে জানে না। জানার আগ্রহ তার আছে ঠিকই ষোলো আনা। কিন্তু ছেলে বলতে না চাইলে কীভাবে জানবে!

এবার তাই সুজন বাড়ি আসার আগেই শেফালি ঠিক করে রেখেছে, ছেলের সাথে আর বেশি মা মা আচরণ করবে না সে। চেষ্টা করবে ছেলের বন্ধুর মতো হয়ে যাওয়ার। কারণ তার মতে, মায়েদেরই তো হওয়া উচিৎ ছেলেদের শ্রেষ্ঠতম বন্ধু।

কাজটা খুব একটা সহজ যে হবে না শেফালি তা খুব ভালো করেই জানে। প্রথম প্রথম ছেলের দিক থেকে অনেক বাধা, অনেক অসহযোগিতা আসবে। কিন্তু সে বদ্ধপরিকর, ছেলের বন্ধু তাকে হতেই হবে।

ছেলেকে ডিপ্রেশন কিংবা একাকিত্ব থেকে উদ্ধার করা ছাড়াও এর পেছনে মনে মনে তার আরেকটা ক্ষীণ আশাও অবশ্য রয়েছে। সে যদি ছেলের মনের খবর জানতে পারে, ছেলের সত্যিকারের বন্ধু হয়ে ওঠে, তাহলে এক পর্যায়ে ছেলেও হয়তো তার কষ্টগুলো বোঝার চেষ্টা করবে, সবসময় তার সাথে এমন রূঢ় আচরণ করবে না। এবং তার ধারণা, স্বামীর কাছ থেকে যে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা সে কোনোদিনই পায়নি এবং পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই, তা যদি ছেলের কাছ থেকে সে পায়, তাহলে হয়তো এই মফস্বল শহরে বাস করেও, এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও, আবার নতুন উদ্যমে কিছু একটা সে শুরু করতে পারবে। জীবনের বাকি দিনগুলোকে নিজের মতো করে সাজাতে পারবে।

বিকেলবেলা তাই শেফালি ছেলের কাছে গিয়ে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ রে সুজন, প্রেম-ট্রেম করিস নাকি? কী নাম মেয়েটার? গ্রামের বাড়ি কই?

এভাবেই শুরু হলো মা-ছেলের এক নতুন বন্ধুত্ব।

 

সম্পূরক তথ্যসূত্র:

* মানসিক চাপে ভুগছেন? ফোনে মায়ের সাথে কথা বলুন! – https://roar.media/bangla/main/health/stress-talking-to-mother/

* কেন নারীদের তুলনায় পুরুষরা আত্মহত্যা করে বেশি? – https://roar.media/bangla/main/health/why-are-men-likely-to-take-their-lives-more/

* মায়ের জন্য আমরা কিছু করছি কি? – https://egiyecholo.com/article/mothers-day-2

* হেমন্তের পাখি: এক মধ্য-চল্লিশ নারীর আত্মানুসন্ধানের আখ্যান – https://roar.media/bangla/main/book-movie/hemanter-pakhi-review/

 

লেখক:
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন: