‘নট উইদাউট মাই ডটার’

উয্মা তাজ্বরিয়ান:

শাহরুখ খানের শক্তি সিনেমাটার কথা মনে আছে? ওয়েল, মূল চরিত্রে ছিলেন কারিশমা কাপুর, নানা পাটেকার। কিন্তু শাহরুখ খানের “শক্তি” মুভি বললে রিকল করতে সুবিধা হয় বলে বলা। সিনেমাটা দেখতে গিয়ে গুগল করে জানতে পেরেছিলাম, এটা তেলেগু মুভি আন্থাপুরাম-এর রিমেক! বলিউডের মুভি রিমেকই হবে- এ আর এমন কি! তবে চমকে দেয়ার মতো ব্যাপার হলো, তেলেগু মুভিটা ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়া হলিউডের একটা মুভি থেকে ইন্সপায়ার্ড- মুভিটার নাম হলো ‘নট উইদাউট মাই ডটার’। বেটি মেহমুদি নামের একজন নারী তার জীবনের সত্যি ঘটনার ওপর “নট উইদাউট মাই ডটার” নামে একটি বই লেখেন, এই বইয়ের কাহিনি অবলম্বনে সিনেমাটি বানানো হয়। এবার আমি একটু নড়েচড়ে বসি। আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি।

সিনেমার মূল কাহিনি হলো, বেটি মেহমুদি ইরানি নাগরিক-আমেরিকান ডাক্তার সায়েদ বোজরগ মুডি মেহমুদিকে বিয়ে করে সুখে ঘর-সংসার করছিলেন। তাদের একমাত্র মেয়ের নাম মাহতব মেহমুদি। সাল ১৯৮৪। সায়েদ মেহমুদি বেটি আর মাহতবকে নিয়ে দুই সপ্তাহের জন্য ইরানে বেড়াতে যেতে চান। অনেক ভয়, আশঙ্কা সত্ত্বেও বেটি এক পর্যায়ে রাজি হন। তারা তিনজন ইরানে সায়েদের বাড়িতে বেড়াতে যান। সায়েদের বাড়িতে তারা পা রাখার পরেই বাড়ির লোকজন বুঝতে পারে, ইসলামি প্রথা, তরিকা বা কালচার সম্পর্কে বেটি তেমন কিছু জানে না। শুরু হয় নানা রকম সমস্যা। এক পর্যায়ে সায়েদ স্বীকার করেন যে, তার আসলে আমেরিকা ফিরে যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য নাই। আমেরিকায় তার চাকরি চলে গেছিল। এই ঘটনা বেটির কাছে গোপন করে সে মা-মেয়েকে ইরানে নিয়ে এসেছে। বেটি বোঝানোর চেষ্টা করে যে, আমেরিকা ফিরে গিয়ে সায়েদের চাকরি ক্ষেত্রের সমস্যাগুলো তারা দুজন মিলে মেটানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু সায়েদ তাতে রাজি না।

এরপর ক্রমান্বয়ে বেটির জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। বাইরে যাওয়া মানা, ইভেন ফোনেও কারও সাথে কথা বলা মানা। বেটি আর তার বাচ্চাকে ইরানের শরীয়া আইন মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। কথা পছন্দ না হলেই সায়েদ তাকে ব্রুটালি মারধর করে। বেটি ভাবে, সায়েদের ফ্যামিলি অন্তত বেটির পক্ষ নেবে; কিন্তু সেরকম কিছু হয় না। বরং সায়েদের ফ্যামিলিও বেটিকে নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করে। একদিন আমেরিকা থেকে বেটির মা ফোন করলে অনেক কৌশল করে বেটি ফোন রিসিভ করে।

মা-কে নিজের আর সন্তানের অবস্থা জানায়। বেটির মা তাকে বলেন, ইরানের সুইস এম্ব্যাসির আমেরিকান ইন্টারেস্টস সেকশানে গিয়ে সাহায্য চাইতে। অনেক কলাকৌশল করে সে বাচ্চাসহ সুইস অ্যাম্বেসিতে সাহায্য চাইতে পৌঁছালে অ্যাম্বেসি তাকে জানায়, ইরানের জাতীয়তা আইন অনুযায়ী, সায়েদকে বিয়ে করার ফলে বেটি এখন ইরানি সিটিজেন। আর ইরানে তখন শরীয়া আইন কায়েম করা হয়েছে। শরীয়া আইন অনুযায়ী, স্বামীর অনুমতি ব্যতীত বেটি দেশ ত্যাগ করতে পারবে না; এমনকি নিজের সন্তানের বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, মাহতবের বয়স নয় বছর পূর্ণ হলে সায়েদ তাকে বিয়ে দেয়ার বা চাইল্ড সোলজার বানানোরও অধিকার রাখে!

এদিকে বেটিকে বাড়িতে না পেয়ে সায়েদ টের পায় যে, কিছু একটা হয়েছে। বেটি অ্যাম্বেসি থেকে ফিরে আসার পরে সায়েদ তাকে থ্রেট দেয় যে, এমনটা যদি আর কখনো হয়, তাহলে সায়েদ তাকে খু* ন করবে।
সায়েদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য বেটি সায়েদের কথামতো চলা শুরু করে। একদিন খবর আসে, বেটির বাবা খুব অসুস্থ; মৃত্যুশয্যায়। সায়েদ তাকে বলে, বেটি চাইলে আমেরিকায় বাবাকে দেখতে যেতে পারে, কিন্তু মেয়েকে ইরানে রেখে যেতে হবে। এরপর নানা কৌশলে, কিছু সহৃদয়বান ব্যক্তির সহায়তায় এবং কিছু হিউম্যানিটারিয়ান অর্গানাইজেশনের সহায়তায়, ইরানি স্মাগলারদের মাধ্যমে বেটি তার মেয়েকে নিয়ে ইরান থেকে পালিয়ে তুরস্কের আঙ্কারায় আমেরিকান অ্যাম্বেসির সামনে পৌঁছায়। দূর থেকে আমেরিকান অ্যাম্বেসির ফ্ল্যাগ দেখে বহু বহু দিন পরে বেটি আর মাহতবের যেন মানুষ হিসেবে পুনর্জন্ম হয়!! আমেরিকায় ফিরে বেটি তার এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখেন বিখ্যাত সেই বই- নট উইদাউট মাই ডটার।

এই সিনেমা নিয়ে সে সময় প্রচুর আলোচনা সমালোচনা হয়। অনেকে বলেন, ফিল্মে যেভাবে মুসলিমদের পোট্রে করা হয়েছে তা অত্যন্ত রেসিস্ট এপ্রোচ। মুসলিম বাদে অন্য কাউকে নিয়ে এরকম সিনেমা বানানো হলে, সেটাকে ওয়েস্টে হেট স্পিচের কাতারে ফেলা হতো।
ইভেন ২০০২ সালে সায়েদ মাহমুদির পার্স্পেক্টিভ দেখানোর জন্য “উইদাউট মাই ডটার” নামে একটা একটা ডকুমেন্টারি বানানো হয়, যেটা কিনা বেটির বর্ণনার সাথে পুরোই কন্ট্রাডিক্ট করে। শেষমেষ ২০১৫ সালে এসে বেটি আর সায়েদের মেয়ে মাহতব মাহমুদি এই ঘটনা নিয়ে তার পার্স্পেক্টিভ থেকে একটা বই লেখেন- “মাই নেম ইজ মাহতব”। মাহতব তার বইতে মায়ের বর্ণনা করা ঘটনাকে সত্যি বলে অভিহিত করেন।

গতকাল ৪ অক্টোবর, শুক্রবার ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস (ইসিজে) এক রায়ে বলেছে, আফগান নারীদের অ্যাসাইলাম দেয়ার ক্ষেত্রে কেবল লিঙ্গ ও জাতীয়তা পরিচয়ই যথেষ্ট। আফগানিস্তানে তাদের জীবন বিপন্ন কি না সে সংক্রান্ত প্রমাণাদির দরকার নেই। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই- ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে তারা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, কর্মক্ষেত্র এবং দৈনন্দিন জীবনে নারীদের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করাসহ নারীদের ওপর নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করেছে। আফগানিস্তানে শরীয়া আইন জারি করা হয়েছে।

বাংলাদেশে, তা যে পক্ষই ক্ষমতায় থাকুক- ঘরে-বাইরে, সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীরা নিপীড়নের শিকার হন। অনেক মেয়ে দাবি করছে, গত দুই মাসে জনপরিসরে মানে পাবলিক প্লেসে হ্যারাসমেন্টের ঘটনাগুলো বেড়ে গেছে। আবার অনেকে বলছেন, এগুলো বোগাস কথা। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করতে নারী বা সংখ্যালঘু কার্ড খেলা হচ্ছে। আবার অনেকে বলছেন, আর্মির হাতে ক্ষমতা দেয়ার জন্য দেশের ল এন্ড অর্ডারের দিনকে দিন অবনতি ঘটানো হচ্ছে।

এখানে প্রশ্নগুলো আসলে খুব সিম্পল-
• অন্যান্য মার্জিনালাইজড বর্গকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং ভূ-রাজনীতিতে যেভাবে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, নারী অধিকার ইস্যুকেও সেভাবে ব্যবহার করা হয় কিনা;
এর উত্তর হলো, হ্যাঁ, জোর সম্ভাবনা যে, করা হয়।
• বাংলাদেশের বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থায় নারী ইস্যুকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা;
উত্তর হলো, হ্যাঁ। এটারও খুবই ভালো সম্ভাবনা আছে।
কথা হলো আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতির হিসাব-কিতাব, বৈশ্বিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে অনেক কিছুই হতে পারে বা হয়তো ঘটছে। কিন্তু এগুলো সব হলো, সম্ভাবনা বা নানা ধরনের ক্যালকুলেশন।
এখানে, ফ্যাক্ট কী জানেন?
ফ্যাক্ট হলো, যে কারণেই হোক, নারীর ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। নারীকে ঊনমানুষে পরিণত করার জোর চেষ্টা চলে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনে নারী স্বাধীনতার নামে নারীকে সামনে এগিয়ে দেয়া হচ্ছে; এবং ক্ষমতার প্রসঙ্গ আসলে নারীর ন্যায্য হিস্যা অস্বীকার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে চরমপন্থার উত্থানের আশঙ্কা করছেন অনেকে। এই উত্থানের ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাতানো নাটক হতে পারে, পরাজিতদের ফিরে আসার চেষ্টা হতে পারে, আবার সিম্পলি এতদিন ধরে সমাজে লালন-পালন করা চরমপন্থা এখন ফুটে বের হতে শুরু করেছে তা-ও হতে পারে। কিন্তু ঘটনা যাই-ই হোক, যেকোনো আনস্ট্যাবিলিটি, যেকোনো যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা শরীয়া শাসন জারি- এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবার আগে বিপদে পড়ে নারী ও শিশুরা- এটা হলো ফ্যাক্ট।

বাংলাদেশে কি শরীয়া শাসন কায়েম করা সম্ভব? অনেকে মনে করেন, উদারপন্থী এই মাটিতে চরমপন্থা সুবিধা করতে পারবে না। আবার অনেকেই বাংলাদেশ সিরিয়া, ইরান, আফগানিস্তানে পরিণত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখেন।
এগুলোও সবই ভবিষ্যতের কথা, অর্থাৎ নানারকম সম্ভাবনা। কিন্তু ফ্যাক্ট কী জানেন?
ফ্যাক্ট হলো, আমাদের সামনে একটা লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে।
ফ্যাক্ট হলো আমাদের প্রতিটা নারীর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে পূর্বজ নারীদের শ্রম, ঘাম, আত্মত্যাগ;
রয়েছে আমাদের এনলাইটেন্ড পিতা, ভাই, বন্ধু, সহচরদের শ্রম- আমাদের দুর্গম পথ একটু সহজ করতে যারা কাঁধ এগিয়ে দিয়েছেন বারবার।

রাস্তায় যতবার আমরা আক্রমণের শিকার হবো, যতবার হ্যাসমেন্টের শিকার হবো, ততবার অপরিচিত পথচারী নারী এসে আমাদের সাহস জোগাবে, ততবার পাশের চা-ওয়ালা মামাটা আমাদের অভয় দেবে। ঘরে নিপীড়নের শিকার হলে বন্ধুরা আমাদের জন্য বুক পেতে দেবে, আশ্রয় দেবে।
আমাদের সাহস হলো আমাদের আত্মার স্বজনেরা, আমাদের শক্তি হলো আমাদের রেজিলিয়েন্স।
মধ্যযুগে ইউরোপে ডাইনি ট্যাগ দিয়ে হাজার হাজার নারী চিকিৎসককে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, তবুও শেষ পর্যন্ত নারীর শিক্ষা বন্ধ করা যায়নি।

মাহসা আমিনির মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ইরানের নারীরা। সরকার হাজার হাজার নারীকে কারাগারে আটকে রাখে। সেই কারাবন্দী নারীদের খাবারে বিষ মিশিয়ে তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে, তবুও তারা দমেনি। তারা ফুল হয়ে ফুটে থাকে মরুভূমির পথে-প্রান্তরে।

বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক- অন্ধকার মানুষগুলোর অস্ত্র যতবার আমাদের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইবে, যতবার আমাদের ধর্ষণ করবে, দাসি বানিয়ে বেচে দিবে, আমাদের হত্যা করবে- ততবার আমরা ব্যাটনটা দিয়ে যাবো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের হাতে- ঠিক যেভাবে আমাদের মায়েরা আমাদের হাতে দিয়েছিল।
Because we are the granddaughters of the witches you couldn’t burn.

শেয়ার করুন: