আমারে চিনোস!

মাসকাওয়াথ আহসান:

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যারা রক্ত-ত্যাগ-ঘামে দুর্মর লড়াই করে পূর্ববঙ্গকে বৃটিশ মুক্ত করলো; তারা স্বাধীনতা অর্জনের পর নিজ নিজ কাজে ফিরে গেলো। এই আন্দোলনে কে জিতবে কে হারবে কে জানে এসব চিন্তা করে যারা চুপটি করে বসে ছিলো তারা ১৪ অগাস্ট মাথায় পাকিস্তানের পতাকা বেঁধে বিজয় মিছিলে যোগ দিলো। আর আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কোন হিন্দু ভারত চলে গেলো; তার বাড়িটিতে চক দিয়ে দাগ দিয়ে রাখলো দখল করার জন্য।

কোন হিন্দু ভারত চলে যাওয়ায় কোথায় কোন পদ শূন্য হলো, সেইখানে গিয়ে “আমারে চিনোস!” বলে চেয়ারে বসে পড়লো ফোরটিনথ ডিভিশনের স্বদেশী সংগ্রামী। রেডিও পাকিস্তানে গিয়ে বৃটিশ সমর্থক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীর কালো তালিকা করলো ঐ ডিভিশনের কালা মিয়া। প্রতিভাবান শিল্পীদের বের করে দিয়ে তারস্বরে গান গাইতে চেষ্টা করলো, আমারে চিনোস; আমি কেডা; আমি হইলাম লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের হ্যাডা!

পাকিস্তানবিরোধী সংগ্রামে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে রক্ত-শ্রম-ঘাম-ত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন সংগ্রামে ফিরে গেলো। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষ পোড়ো বাড়ি রিক্ত মাঠের গ্রাউন্ড জিরোতে দাঁড়িয়ে দেশ পুনর্গঠন শুরু করলো। আর ঐ যে ১৬ ডিসেম্বর মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে লুট হওয়া ভাঙ্গা রাইফেল হাতে নিয়ে বিজয় মিছিলে এগিয়ে গেলো সিক্সটিন্থ ডিভিশন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো কোন অবাঙ্গালি কোন বাড়িটা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছে; কে ছেড়েছে কোন পদ। “আমারে চিনোস” বলে সাজানো বাংলোয় নতুন বুর্জোয়া সেজে পাইপ টানতে শুরু করলো শুক্কুর আলী। তখন শাকের ভাই নামে সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিঘর হয়ে পড়লো। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ঢুকে “পাকিস্তান সমর্থক” শিল্পীদের কালো তালিকা করলেন কালাবুজি, তারস্বরে চেঁচিয়ে গাইলেন, আমারে চিনোস; আমি কেডা; আমি হইলাম জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুর হ্যাডম। মুক্তিযুদ্ধে সোমত্ত শরীরে মামার বাড়িতে নিরাপদে বসে থাকা আমারে চিনোস তাসির লিখতে শুরু করলো মুক্তিযুদ্ধের ফ্যান্টাসি। এঁকে দিলো দ্য গ্রেটেস্ট থিওরি অন আর্থ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাকশালের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল সমাজতন্ত্রীরা ফাঁসিতে ঝুললো, দেশছাড়া হলো; আর মাথায় টুপি পরে ওয়াজ মেহেফিল করে মখলেছ মিয়া বললো, আমারে চিনোস আমি কেডা? অনেক হইছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; এইবার চলো ইসলামি চেতনা নিয়ে খেলি।

সিপাহী-জনতার বিপ্লব শেষে জনতা ঘরে ফিরে গেলো। আর বিপ্লবের সময় জিকিরে ফিকিরে যে জিতবো তার লগে আছি মালেরা খুঁজতে শুরু করলো, মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়ে কে কোথায় নতুন দালান তুলেছে; তা দখল করতে হবে। বাংলাদেশ বেতার টেলিভিশনে ঢুকে কালাউল্লাহ হুংকার দিলো, আমারে চিনোস আমি ক্যাডা; আমি হইলাম জিন্দাবাদের হ্যাডা। চলো কালো তালিকা করি, কারা শেখ মুজিবের সাপুটার ছিলো।

১৯৯০ সালে রহমান এন্ড রহমান ডাইন্যাস্টি কোম্পানির দুই কিচেন মেইডের গদিনশীন হবার কল্পনাকে পরিকল্পনায় রুপান্তর করতে জয় বাংলার বাচ্চু-কাচ্চু ও জিন্দাবাদের লালু-কালু ঢাকা কেন্দ্রিক অভ্যুত্থান ঘটালো। দুই চারদিন শহীদ ডাক্তার মিলন ও শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে শুরু হলো, চলো ফইন্নি, এলিট হই আন্দোলন। এসে পড়লো পলিটিক্যাল থিওরি, লেখাপড়া করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে; টেকাটুকা করে যে দেশ চালাতে পারে সে। রাজনীতিতে দলে দলে লেন্দুপ দর্জি ও মিয়া খলিফা যোগ দিলো। বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ড করে তুললেন দুই গ্লোরিয়াস কিচেন মেইড। কাচ্চু-বাচ্চু গিয়ে কান কথা বলে আওয়ামী লীগের শিক্ষিত সৎ নেতাদের দলচ্যুত করতে শুরু করলো; লালু-কালু গিয়ে বিএনপির সৎ ও শিক্ষিত নেতাদের দলচ্যুত করতে শুরু করলো। এই আমারে চিনোস, আমি কেডা, আমি গণ অভ্যুত্থানের হ্যাডা – এই ডায়ালগ দিয়ে ছেঁড়া শার্ট পরা লোকেরা শো রুম থেকে শার্ট তুলে নিয়ে কাফলিং দিয়ে পরলো; গাড়ি তুলে নিয়ে কারখানার গেট দিয়ে ঢুকে শিল্পপতি হলো। পদ-পদবী-পদক দখলে তখন শুধু ‘আমারে চিনোস’ বললেই চলে! আর বেচারা বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; কলিমুল্লাদের কালো তালিকাদের চাপে পড়ে বাঁশী সংগীত হারা।

২০০৯ সালের পর নৌকায় চড়ে বিরানব্বুই সালে ছাত্রদল করা ছেলেরা আমারে চিনোস বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিক্ষক হিসেবে আবির্ভুত হলো; ছাত্রশিবির প্রকৃত ছাত্রলীগ হয়ে পড়লো; আর ছাত্রলীগ পাপিয়ার আসরে প্রমোদে ঢালিয়া দিলো মন। এইবার আমারে চিনোস বলে, চেতনার কথা বলে, ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খেতে শুরু করলো গলির ধারের ছেলেরা। আমারে চিনোস বলে তখন বিসিএস অফিসারও হওয়া যায়। আর কালাচন্দ্রের প্রগতিশীলতার চাপে তখন জয় শ্রীরাম শ্লোগান বাঙ্গালির হাজার বছরের সংস্কৃতি পরিচয় হলো। সে বলে উঠলো, আমারে চিনোস আমি ক্যাডা, আমি জয় শ্রীরাম, ভারতের হ্যাডা! ওদিকে মদিনা সনদের লিপ সার্ভিসে আলুথালু হয়ে আল-কালা শোকরানা মেহেফিলে মরুভূমি ও খেজুর গাছ ছাড়াই গেয়েই উঠলো, এ কোন মধুর শরাব দিলে আল-আরাবি সাকি!

ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের আমারে চিনোস চোখ রাঙ্গানিতে শিক্ষিত সমাজ ‘চুপ চুপ চুপ অনামিকা চুপ’ বলে দিকে দিকে উপদেশ ছড়াতে লাগলো, ও মানুষ, তোমার দুইটা চোখ দেখবা দুইটা কান শুনবা আর একটা মুখতো; কথা কম কবা।

আমারে চিনোস বলে গুম-ক্রস ফায়ার-আয়নাঘরের মানবতাবিরোধী অপরাধ করে; আর বাংলাদেশ ডাকাতি করে; দেশটাকে সেকেন্ড হোমে স্থানান্তর করে মাদার অফ কিচেন মেইডের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করলো উন্নয়নের পালোয়ানেরা। যদি তুমি পূজা করো তবে তুমি সেকু, যদি তুমি নামাজ পড়ো তবে তুমি ফান্ডু; এই শ্লোগানের চাপে শোকরানার মেহেফিলের আল কালার জিদ বাড়লো; সে বাকশালের খাসজমিতে বসে খেলাফতের স্বপ্নে কুঁ কুঁ করতে থাকলো।

মাদার অফ কিচেন মেইডের ফ্যাসিজমের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকা জনপদে হঠাত আলোর ঝলকানির মতো আবু সাঈদ, মুগ্ধ, রুদ্র এসে প্রাণ দিয়ে দেশটাকে রাক্ষসমুক্ত করলো। হাজারো প্রাণ গেলো, হাজার হাজার মানুষ আহত ও অন্ধ হলো। ফ্যাসিস্ট কিচেন মেইড অর্ধেক রান্না করা পেয়াজ ছাড়া তরকারি ফেলে পালিয়ে গেলো।

জুলাই বিপ্লব শেষে সাধারণ মানুষ কাজে ফিরে গেলো। কিন্তু ঐ যে, সাড়ে পনেরো বছর ধরে জ্বী হুজুর করে, জুলাইয়ের ১৫ থেকে শ্যাম রাখি না, না কূল রাখি করে যারা ৫ অগাস্ট বিকেলে মাথায় পতাকা বেঁধে বিজয় মিছিল করলো; তারা এবার আমারে চিনোস বলে ভিক্ষুকের কুটির থেকে রাজপ্রাসাদে উঠবে। ফইন্নি থেকে এলিট হতে শুরু করেছে তারা। আর ঐ যে রেডিও ও টেলিভিশন; আশি বছর ধরে কালো তালিকা করতে করতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে আছে কতগুলো ওস্তাদ আমারে চিনোস নিয়ে। আমারে চিনোস যায় আমারে চিনোস আসে; বাংলাদেশ পড়ে থাকে নিতান্ত অবহেলায়।

বীর শহীদেরা কবরে শুয়ে থাকে; আর অনন্তকাল ধরে ক্ষমতার ‘আমারে চিনোস’ ধমক দিয়ে রাজত্ব করে দুধের মাছি ও বসন্তের কোকিলেরা।

 

মাসকাওয়াথ আহসান: রম্য লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: