সুমিত রায়:
জুলিয়া ক্রিস্টেভার অ্যাবজেকশন থিওরি (abjection theory) অনুসারে যোনির গন্ধ পুরুষের কাছে একধরনের অ্যাবজেকশন বা বিতৃষ্ণার বস্তু হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ক্রিস্টেভার অ্যাবজেকশনকে ব্যাখ্যা করেন এমন এক অভিজ্ঞতা হিসেবে, যা কোনো বস্তুকে একইসঙ্গে ঘৃণিত ও আকর্ষণীয় করে তোলে। এটি আমাদের পরিচয়ের এবং বাইরের জগতের সীমারেখা মুছে দেয়, সমাজে যা ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘সুরক্ষিত’ বলে মনে করা হয়, সেই ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে।
যোনির স্বাভাবিক গন্ধ, যদিও একটি প্রাকৃতিক জৈবিক বৈশিষ্ট্য, সমাজে প্রায়ই এটিকে ঘৃণিত বা লজ্জাজনক হিসেবে দেখা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিচ্ছন্নতার ধারণা যোনির গন্ধকে একধরনের বিপদ বা আপত্তিজনক বিষয় বলে মনে করে।
ক্রিস্টেভার তত্ত্ব অনুযায়ী, যোনির স্বাভাবিক গন্ধ পুরুষের মানসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সীমাকে চ্যালেঞ্জ করে। যদিও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর শরীরকে উপভোগের বস্তু হিসেবে দেখা হয়, তার প্রাকৃতিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে সমাজের নিয়ম অনুযায়ী গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই গন্ধ পুরুষের জন্য এমন এক বাস্তবতাকে তুলে ধরে, যা তার সামাজিক প্রত্যাশা এবং যৌনতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। পুরুষদের মধ্যে এক ধরনের দ্বৈত অনুভূতি তৈরি হয়—একদিকে তারা এটিকে অপছন্দ করে, অন্যদিকে এটি তাদের যৌন আকর্ষণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে পুরুষদের মনে একধরনের দ্বিধা ও অস্বস্তি তৈরি হয়, যা তাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর প্রতি বিতৃষ্ণা এবং আকর্ষণের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু এর ফলে আসল সমস্যাটা হয় নারীর।
অ্যাবজেকশন নারীর উপর এক ধরনের সামাজিক চাপ তৈরি করে, যেখানে নারীদের সবসময় নিজেদের শরীর নিয়ে সচেতন থাকতে হয়। যোনির স্বাভাবিক গন্ধকে অশুভ বা অপমানজনক বলে চিহ্নিত করার কারণে নারীরা প্রায়ই নিজেদের শরীরের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অস্বস্তিবোধ করেন এবং সামাজিক প্রত্যাশার চাপে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করেন। ফলে নারীদের শারীরিক নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পায়, যা আত্মবিশ্বাসের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অ্যাবজেকশন পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোকে বজায় রাখতে সহায়তা করে। নারীর শরীরকে ঘৃণিত বা বিতৃষ্ণার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের একটি উপায়, যা নারীর প্রতি এক ধরনের সামাজিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। নারীর শরীরকে নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলিত করার মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর স্বাধীনতা এবং যৌনতার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এই অ্যাবজেকশন (abjection) ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে নারীর শরীর সম্পর্কে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে বাজারের জন্য সুযোগ তৈরি করে। বিশেষত বিভিন্ন হাইজিন প্রোডাক্ট কোম্পানিগুলো নারীর শরীরের ‘অসামান্যতা’কে তুলে ধরে, নারীদের মধ্যে শরীর নিয়ে অস্বস্তি সৃষ্টি করে তাদের পণ্য বিক্রির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। সমাজ নারীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন তা একটি ‘সমস্যা’ এবং তা ‘সমাধান’ করার জন্য প্রয়োজন নানা ধরনের হাইজিন পণ্য। ফলে নারীর শরীরের এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যবসার এক বিশাল ক্ষেত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। নারীর স্বাভাবিক শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে এভাবে সমাজের মানসিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।