সুমিত রায়:
পুরুষের তুলনায় নারীদেরকে তাদের পোশাক-আশাকের ভিত্তিতে বেশি স্টেরিওটাইপ করা হয়। যেমন নারীদের ক্ষেত্রে যেমন বড় টিপ, শাড়ির সাথে স্লিভলেস ব্লাউজ পরলে নারীবাদী, শাহবাগী হিসেবে স্টেরিওটাইপ করার প্রবণতা কাজ করে। এরকম আরও অনেকভাবে স্টেরিওটাইপ করা হয়। কিন্তু পুরুষদের ওভাবে করা হয় না। এর কারণটা কী?
আমার যেটা মনে হয়, নারীদেরকে তাদের পোশাক বা অন্যান্য বাহ্যিক বিষয় নিয়ে অধিকতর স্টেরিওটাইপ করার ব্যাপারটা আসে নারীর অবজেক্টিফিকেশন থেকেই। যখন একজন নারীকে অবজেক্টিফাই করা হয়, তখন তাকে কেবল একটি অবজেক্ট হিসেবে দেখা হয়, যার নিজস্ব কোন সাবজেক্টিভিটি থাকতে পারেনা, মানে তার ইচ্ছাশক্তি বা স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়। এদিকে পোশাক চয়ন করার স্বাধীনতা একজন ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটি (subjectivity) বা নিজস্ব ইচ্ছারই প্রকাশ। এই সাবজেক্টিভিটি সেই অবজেক্টিফিকেশনের প্রক্রিয়ায় অগ্রাহ্য হয়। নারী যখন তার পোশাকের মাধ্যমে নিজের সাবজেক্টিভিটি দেখায়, তখন পুরুষ বা সমাজের জন্য তা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যায়, কারণ এটি তাদের পূর্বের সেই অবজেক্টিফিকেশনের ধারণাটার বিরুদ্ধে যায়। কারণ যার সাবজেক্টিফিটি আছে তাকে অবজেক্ট ভাবা যেতে পারেনা, বা অবজেক্টিফাই করা যেতে পারে না। যদি নারী সাবজেক্টিভ চয়েস বা ইচ্ছাশক্তি প্রদর্শন করে, তবে সেই ধারণাটি ভেঙে যায় এবং পুরুষের মনের ভেতরে কগনিটিভ ডিজোন্যান্স (cognitive dissonance) তৈরি হয়।
কগনিটিভ ডিজোন্যান্স হলো সেই মানসিক অস্বস্তি, যা তখন ঘটে যখন দুই বিপরীত ধারণা বা বিশ্বাসের মধ্যে একটি অসঙ্গতি দেখা যায়। নারীর সাবজেক্টিভিটি (পোশাকের মাধ্যমে) এই অসঙ্গতি তৈরি করে, কারণ এটি নারীকে অবজেক্ট হিসেবে দেখার প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক। এই মানসিক অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পুরুষ বা সমাজ প্রায়শই একটি ডিফেন্স মেকানিজম ব্যবহার করে, যেখানে তারা নারীর পোশাককে তার সত্তার একটি এসেনশিয়াল (essential) অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ, তারা নারীর পোশাককে তার ব্যক্তিত্বের সাথে মিশিয়ে ফেলে, যেন পোশাকই তার আসল পরিচয় বা সত্তা হয়ে ওঠে। এর ফলে নারীর আসল সাবজেক্টিভিটি অগ্রাহ্য করা হয়, এবং পোশাক তার পরিচয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এই ডিফেন্স মেকানিজমটা র্যাশনালাইজেশন বা যুক্তিসিদ্ধকরণ জাতীয়, কেননা এখানে নারীর পোশাককে নারীর সত্তার সাথে সাথে এসেনশিয়াল করার মাধ্যমে অসঙ্গতিটি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এভাবে নারীর পোশাকের উপর স্টেরিওটাইপ তৈরি হয় এবং পোশাককে তার স্বতন্ত্র সত্তা বা পরিচয়ের সাথে এসেনশিয়ালাইজ করে ফেলা হয়। এর ফলে নারীর পোশাক চয়নের স্বাধীনতা বা ফ্রি-উইল কল্পনা করার কোনো জায়গা থাকে না, কারণ সমাজে তার পরিচয় শুধুমাত্র তার পোশাকের মাধ্যমেই সংজ্ঞায়িত করা হয়। পুরুষদের চোখে, নারীর ব্যক্তিত্ব বা সত্তা যে পোশাক তিনি পরেন তার সাথে অভিন্ন হয়ে ওঠে, এবং সেই পোশাকের বাইরে নারীর সাবজেক্টিভিটি বা ইচ্ছাশক্তি স্বীকৃত হয় না। এই জায়গাটাতেই নারী বড় টিপ পরলেই, চুল ছোট রাখলেই তাকে শাহবাগীতে স্টেরিওটাইপ করা হচ্ছে। এখানে ধরেই নেয়া হচ্ছে, বড় টিপ মরা মেয়ের মধ্যে ‘শাহবাগিত্ব’ ছাড়া অন্য কোন আদর্শ বা সংস্কৃতি ধারণ করার চয়েস থাকতে পারে না, আর যারা ‘শাহবাগিত্ব’ ধারণ করে. তাদের মধ্যে বড় টিপ পরা ছাড়া আর কোন অপশন থাকতে পারে না। তারা এগুলো গ্রহণ করতে বাধ্য, অন্য কিছু চুজ করা অসম্ভব, কারণ সেটার সাবজেক্টিভিটি বা স্বাধীন ইচ্ছাই থাকতে পারে না। কারণ তাদের অবজেক্ট মনে করা হচ্ছে।
এই যে বড় টিপ পরা মেয়ে শাহবাগী হতে বাধ্য, আর শাহবাগী বড় টিপ পরতে বাধ্য – এটাই এসেনশিয়ালিজম নির্দেশ করছে, কারণ এটা মানেই ওটা, সত্তার সাথে সম্পর্কিত। এটা ব্যাপারটা থেকে সমস্ত আনসারটেইন্টি দূর করছে, পূর্ণাঙ্গ প্রেডিক্টেবিলিটি দান করছে, যেটা ছেলেদের বেলায় কাজ করতো না। কারণ ছেলেদের সাবজেক্টিভিটি, চয়েস, ফ্রি উইল স্বীকার করা হয়, মেয়েদের বেলায় হয় না, মেয়েদের অবজেক্ট ভাবা হচ্ছে, তাই তাদের ক্ষেত্রে সবই প্রেডিক্টেবল।
প্রোজেক্টাইলের মতো কোন কোণে কত বেগে ছোড়া হবে জানলে কোথায় ড্রপ করবে প্রেডিক্ট করা যায়। কারণ নারী তাদের কাছে অবজেক্ট। এটাই তাদেরকে পোশাক-প্রসাধনী সহ বাহ্যিক বিষয়গুলোর ভিত্তিতে অধিকতর স্টেরিওটাইপ করে ফেলা যায়, এটা করলে ওটাই হবে, এরকম ধারণা করা যায়। আর এভাবেই অবজেক্টিফিকেশন থেকে এরকম স্টেরিওটাইপ তৈরি হয়।