মাসকাওয়াথ আহসান:
আপা ফজরের নামাজ পড়ার পর একটু কোরান শরিফ নিয়ে বসেন। সুর করে দোয়া ইউনুস তেলাওয়াত করেন। এটেনডেন্ট রোদেলা সিং একটু পোরেজ আর চা রেখে যায়। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, দুপুরে কী খাবেন ম্যাম?
আপা হাতের ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বলেন। চুমু দিয়ে কোরান শরীফটা রাখেন। এরপর বলেন, আজ একটু পেঁয়াজ ছাড়া চিকেন কোরো। মূলা দিয়ে রান্না করবে চিকেন; তাতে ঝাঁঝ এসে যাবে। বিকেলে মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি খাবো, রাতে কাঁঠালের একটা চপ ভেজে বার্গার করে দিও।
এমন সময় ফোন বেজে ওঠে।
–হ্যালো আপা, আমি কেরানিগঞ্জের বাবুল এখন আম্রিকায় থাকি আপা। পেন্টাগনের ক্যাফেটেরিয়ার শেফ আপা। আপনি কইলে দেশে ফিইরা গিয়া আওয়ামী লীগের হাল ধরবো।
–বাবুল আমি তো ধারে কাছেই আছি; তুমি কেরানিগঞ্জে গিয়ে মিসকল দিও, চট করে এসে পড়বো।
–বাংলাদেশটা তো আম্রিকা হয়ে গেলো আপা!
–আমি আগেই বলছিলাম, ডোনাল্ড লু’ হাওয়া যেইদিক দিয়ে বয়ে যায়, ঐখানে ক্যু’কাজ হয়।
এমন সময় হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে ঢোকে টাবু। আপা ফোন রেখে দেন। টাবু আপার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের একটা ছবি তুলে, তারপর আপার সামনে ক্যামেরার স্ক্রিনে একটা ছবি বের করে দেখায়।
–দিল্লীতে নিজামউদ্দীনের মাজারে মাথা ফেটে ব্যান্ডেজ লাগানো এই লোকটার ছবি তুলেছি; একটু দেখবেন ম্যাম চেনেন কিনা!
–কই দেখি! বোকা একটা। দরবেশ ক্লিন শেভ করেছে। ও একটু দাড়ি রাখলেই পারতো।
–এই লোক আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এলাকায় ঘোরাঘুরি করে। তাই একটু জিজ্ঞেস করে নিলাম।
–অপদার্থ একটা, খালি খেলা হবে খেলা হবে করে; কিন্তু খেলতে পারে না।
এমন সময় একটা ফোন আসে। টাবু অনুরোধ করে, ফোনটা একটু লাউড স্পিকারে রাখুন ম্যাডাম।
–হ্যালো আপা, আমি চট্টগ্রামের শৈবাল চক্কোত্তী। বাংলাদেশ তো আফঘানিস্তান হয়ে গেলো আপা। নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীর প্রেস কনফারেন্স করছে, খেলাফত চায়।
–আমি তো আগেই বলছিলাম। তবে দাড়ি-টুপিওয়ালাদের টাকা পয়সা খাসজমি দিলে ওরা রাজপথে এসে কিছু কাজ করে। আর তোমরা এতো অপদার্থ, সারাক্ষণ জুম মিটিং-এ কবিতা আবৃত্তি করো। রাস্তায় নামার সাহস নাই।
হিজবুত তাহরীর শুনে টাবু মণিপুরে ফোন করে, হ্যালো আলফা ওয়ান, গামা থ্রি হিয়ার। প্লিজ সার্চ ফর হিজবুত তাহরীর।
টাবু বিদায় নিতেই বীণা সিক্রি আসেন একটু গাজরের হালুয়া নিয়ে। ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে দেন গ্রিন টি। এরপর খ্যাসখেসে গলায় বলেন, এতো বড় সাহস, ঢাকা প্রেসক্লাবে জিন্নাহ’র মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে কিছু মোহামেডান। দেশটা পাকিস্তান হয়ে গেলো যে!
–আমি আগেই বলেছিলাম। আসলে আমাদের ইতিহাসবিদগুলো কোন কাজের না। এতো ইতিহাসের বই লিখালাম, তবু কিছু গ্রহ নক্ষত্র মুছে দিতে পারলো না। দোষ ভারতের বুদ্ধিজীবীদেরও আছে। এসব জিন্না ফিন্না নিয়ে বই পুস্তক তো এখানেই বেশি লেখা হয়।
–ওরা আসলে আরবান নক্সালাইট, মাওবাদী। এরা দেশটাকে চীন বানাতে চায়। মোদীজী না থাকলে এতোদিনে টেবিল টেনিস জাতীয় খেলা হয়ে যেতো, জাতীয় খাদ্য হতো নুডলস।
এমন সময় আবার ফোন বাজে, হ্যালো আপা, আমি কুমিল্লার সেবায়েত উল্লাহ আপা। দেশটা একেবারে শ্রীলংকা হয়ে গেছে। শুধু লোড শেডিং আর লোড শেডিং।
লোড শেডিং কথাটা বলতেই হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির হয় আদানি। কাঁদো কাঁদো চেহারা করে বলে, ম্যাম বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ আমার বকেয়াগুলো দিচ্ছে না। আপনার তো অনেক অলিগার্ক আছে, তাদের কাছ থেকে নিয়ে আমায় যদি কিছু টাকা দেন। খুব পেরেশান আছি।
বীণা সিক্রি বিব্রত হয়ে বেরিয়ে যান। রোদেলা সিং আদানিকে একটা গ্রিন টি দিয়ে যায়।
এমন সময় আবার ফোন বাজে, হ্যালো আপা, আমি সিলেটের হাওরে পদ্ম মোকসেদ। ওহাবীরা সিলেটে সক্রিয়। মাজারে আক্রমণ করেছে, দেশটা সৌদি আরব হয়ে গেলো।
–ওমা সৌদি আরবেই তো ওহাবিরা আর নাই। সিলেটে আসলো কী করে! পরে ফোন করো মোকসেদ, একটু পাওনাদারের ঝামেলায় আছি।
এরপর আদানির দিকে তাকিয়ে আপা বলেন, আমাকে কটা দিন সময় দিন। সামিট গ্রুপের সঙ্গে কথা বলে দেখি। কী ব্যাপার মোদীজী কি আপনাকে আর বিজনেস প্রোজেক্ট দিচ্ছে না নাকি!
–ইলেকশনে টাকা লাগিয়ে অনেক লস খেয়েছি। রাম মন্দির নির্মাণে এতো টাকা দিয়েছিলাম। অযোধ্যার আসনে প্রার্থীর পেছনে অনেক ইনভেস্ট করেছি; কিন্তু সে গো হারা হেরেছে ম্যাম। খবর কোনদিকেই ভালো না। যাকগে ভালো থাকুন ম্যাম। নমস্তে।
এমন সময় আবার একটা ফোন আসে, আপা আমি শাহবাগ থেকে সংস্কৃতিকর্মী অসংখ্য মুস্তাফিজ বলছি। আমি মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করতে গিয়ে এক চাইনিজের মার খেয়ে আহত হয়েছি। বাংলাদেশটা চীন হয়ে গেছে।
–চাইনিজ আসবে কোথা থেকে! হয়তো ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র!
–না আপা, এরা চাইনিজ। এরা খালি নুডলস খায় আপা। হয় তো টেবিল টেনিসও খেলে!
মাসকাওয়াথ আহসান: রম্যলেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট