ধর্ষণকে ন্যায্যতা দিতে আমাদের যত বাহানা!

জাহিদ হোসাইন:

আমাদের সমাজের সাধারণ বিশ্বাস এমন যে, কেবল নারী কালো বস্তায় গা-গতর ঢেকে কিম্ভূতকিমাকার সেজে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, অতি সন্তর্পণে, চলাফেরা করলেই সমাজ থেকে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন চিরবিদায় নেবে। এই ধারণা যে প্রমাণিত ভ্রান্তি, তা আর নসিহত করার প্রয়োজন নাই। কেননা কয়েক বছর আগে কুমিল্লায় খোদ সেনানিবাসে সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। রেখে ঢেকে চলাচল করা সত্ত্বেও কেন সে এমন বর্বরতার শিকার হলো? তনুর সেই অপমৃত্যুর কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে প্রচলিত বিশ্বাসের ভিত্তিতে উপদেশমূলক লেখালেখি ফেবুতে অনেক দেখেছি। যা ছিলো কেবল এ সমাজের বিশ্বাসভিত্তিক প্রতিবাদ! কিন্তু এহেন সামাজিক প্রতিবাদ কি তনুর মতো অন্যান্য মেয়েদের ধর্ষণ থেকে শঙ্কামুক্ত করতে পেরেছে?

ডা. আব্দুন নুর তুষার বেশ জনপ্রিয় মুখ এদেশে। তার ফেবু স্টাটাসে দেখেছিলাম যে, তনু হিজাব পরতো এবং তথাকথিত ‘শালীনতা’ নিয়েই চলাফেরা করতো। তারপরও সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে!

আরেকজন লিখেছেন, ধর্ষণের ভাবনা একদল কুরুচিপূর্ণ কুলাঙ্গারের মনে গ্রোথিত থাকে। এরা জন্মগতভাবেই এইরূপ মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এখানে বিষয়টা শুধু মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বলে মূল অপরাধের দায়সারা বিচার হয়েছে। কিন্তু বলা হলো না যে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি হিসাবে গণ্য করা হলে তা ন্যায়বিচারের পথ অবরুদ্ধ করতে পারে— মানে মানসিক রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অপকর্ম করতেই পারে!

অনুরূপ পুলিশ জনৈক মোল্লাকে শিশু ধর্ষণ এবং হত্যার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়, “ঐ সময় আমার ওপর শয়তান ভর করেছিলো”! এসব যুক্তি মূলত অপরাধীকে নির্দোষ প্রমাণের পক্ষে কূট-কৌশল মাত্র। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণার দোহাই দিয়ে অপকর্মকারীর দোষ লঘু করার চক্রান্ত ব্যতীত আর কিছু না!

ধর্ষণ প্রসঙ্গে কয়েকজন বস্তুনিষ্ট যুক্তি দাঁড় করেছেন। তাঁদের মতে, নারী তথাকথিত শালীনতা বজায় রেখে চললেই সমাজ থেকে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে, একথা সর্বব্যাপী অসত্য— “কম্বলমুড়ি দিলে যমে ধরে না” যুক্তিসদৃশ। আসল কথা হলো, শালীন পোশাকের নামে হেত্বাভাস তোলা হয় নারীকে অন্তরীণ করার জন্য এবং নারী-স্বাধীনতার ধারণার বিপক্ষে সামাজিক পরিবেশ তৈরি করার উগ্র বাসনা থেকে। শুধু মেয়েদের সাধু হওয়ার পরামর্শগুলো অলঙ্ঘনীয় (Taboo) হিসাবে প্রচলিত থাকা সমাজে নারী কখনও স্বাধীন হয় না। এর মূল উদ্দেশ্য হলো নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ (মাইয়া মানুষ) বানিয়ে রাখা।

বলা হয় মেয়েমানুষ যৌনতার নিধান স্বরূপ, তাদের উপলক্ষ্য করেই শয়তান পুরুষদের দুষ্ট মন্ত্রণা দেয়। তাই গ্রন্থে জনসম্মুখে গা-গতর ঢেকে চলা নারীর জন্য অবশ্যিক বিধান রাখা হয়েছে— দুধে মাছি বসে, তাই দুধের হাড়ি ঢাকো, মাছি আসবে না! এই পদ্ধতি দ্বারা নাকি নারীকে সম্মানের উচ্চ শিখরে আরোহন করা হয়েছে! অথচ গ্রন্থে মানুষকে স্বাধীন বলা হয় এবং গ্রন্থিকগণ এসব প্রচার করে দুনিয়াবি আয়-উন্নতি স্ফীত করে। তাইলে নারী কি মানবকুলের অংশ নয় যে শুধু তাকেই সদা অন্তরালে থাকতে হবে? উল্লেখ্য শালীন পোশাকের নামে অবগুণ্ঠনে আবৃত হওয়া নিশ্চয়ই স্বাধীনতা নয়।

যদি বলা হয় নারী তুমি দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ, তাই ‘শালীনতা’ নিয়ে অবগুণ্ঠিত জীবনযাপন করো। অতঃপর নারী এই প্রথা মেনে চলা সত্ত্বেও নির্যাতিত হলো। কিন্তু যে এহেন অপরাধ করলো সে প্রথম শ্রেণির মানুষ পুরুষ, তাই সে নির্দোষ। “ধর্ষণকারীর মস্তিষ্কবিকৃতি আছে অথবা তাকে শয়তান অসওয়াসা দিয়েছে বলে সে ধর্ষণ করেছে” এমন কুযুক্তি দেওয়া হলো। তাইলে কি কখনও নারীনির্যাতন বন্ধ হবে? মূলত সমাজে গৃহীত এরকম নৈতিক মানদণ্ডে ধর্ষণের দায়ে অপরাধীর কোনও শক্ত বিচার হয় না। এসমাজের নৈতিক বিচারের ধারণা এমনই। তাই ধর্ষণ বাড়ছে বৈ কমছে না!

বস্তুত এসব যুক্তি সামাজের কালানুক্রমিক প্রথা। যার মোহে পড়ে ধর্ষণসহ অন্যান্য নারী নির্যাতনের জন্য স্বয়ং ভিকটিমকেই দায়ী করা হয়! বলা হয়, নিজে সামলে চলতে না-পারলে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যুক্তির কী বিরাট প্রমাদ! এই বিশ্বাস আসলে সামাজিক অচলায়তন; যা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ বৈধতার পর্যায় নিয়ে যায়! উপমহাদেশের আনাচে-কানাচে ধর্ষণ অপকর্মের বোনাস পয়েন্ট হিসাবে চলে! ভারতজুড়ে তাই ধর্ষণ নিবারণের উপায় নাই।

ভারতীয় সাধারণ নারীসমাজ এগ্রহে সবচেয়ে বেশি নিগৃহিত ও পরাধীন। সেখানে স্বামী হলো দেবতাতুল্য এবং তার পায়ের নিচেই স্ত্রীর স্বর্গ! বাংলাদেশের সামাজিক সমস্ত রীতিনীতি অন্ধভাবে ভারতীয় প্রথা অনুসরণ করে! সুতরাং নারীর মর্যাদা দানে এদেশ ভিন্নপথে কেন হাঁটবে? ভারত হলো ধর্ষণে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আর বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে কেন? অন্তত রানার আপ তো হতেই হবে!

ধর্ষণ বাংলাদেশে অহরহ ঘটছে। কিন্তু আসামীরা ধরা পড়ছে না।তারপরও তনুর খুন হওয়ার ঘটনা আলোড়ন তোলে, দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়; সামাজিক যোগাযোগ এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো এর বিরুদ্ধে সরগরম হয়। কয়েক সপ্তাহব্যাপী অন্যান্য খবর ধর্ষণের নিচে চাপা পড়ে থাকে। একদিন  সমস্ত কোলাহল বন্ধ হয়! কিছুদিন পর স্থানবিশেষে ধর্ষকরা সমাজ এবং প্রশাসনের প্রশ্রয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে! যে দেশে শিশু হত্যার বিচার হয় অতি ধীরে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে সামাজিক আনুকূল্য লাভ করে মন্ত্রী পর্যন্ত হওয়া যায়, সে দেশে ধর্ষণ কোনও অপরাধই না! উৎকোচ পদ্ধতি এবং রাজনৈতিক আনুকূল্য সব সমস্যার সমধান দিতে পারে। এই বিষয়গত গোপন কৌশলগুলো কেউ এদেশে শিখে ফেললে জগতের এহেন কোনও অপকর্ম নাই, সে পারবে না। তাই ধর্ষণের ব্যাপারে দুঃখ ছাড়া আর কিছু করার নাই এদেশে— তনুরা তো জন্মেছে ধর্ষণের শিকার হয়ে মরার জন্যে!

“মানুষ মরণশীল, তনুও মানুষ, তাকে মরতে হবে” এই বিশ্বাসের বিরোধিতা চলে না। তনুর মতো সবাই মারা যাবে; এটাই স্বাভাবিক। তাই তনুর মৃত্যুর ব্যাপারে বলতে হয়, “আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’’! তাই এনিয়ে কথা না বাড়িয়ে, ধর্ষণ অপরাধ নয় বরং মেয়েদের ভাগ্যলিখন বললে সমস্যা থাকে না; পুণ্য হয়। বস্তুত এসব হচ্ছে এ সমাজের মানসিক প্রকৃতি এবং বিশ্বাসের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাই নাগরিকদের মধ্যে সর্বদা নিজে অন্যায় করা, অন্যায় দেখে উল্টো বিচার করার প্রবণতা সর্বদাই লক্ষ্য করা যায়।

আর আসলেই যদি এই সমস্যা দূর করতে হয়, তবে সবকিছুর আগে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আর এজন্য সামাজিক অন্যায় ও বিচারহীনতার উৎস আসলে কী, সেই মূল্যবোধ মনে জাগ্রত করতে হবে আগে। তবেই এধরনের অপকর্ম কেন ঘটে, তা বুঝতে সমস্যা হবে না। আর নারী কী কারণে হেনস্তার শিকার হয়, সবার সে কথাও মাথায় রাখতে হবে। বেপর্দা মেয়ে কোনও ছিলা কলার মতো অচেতনবস্তু না— এরকম মানসিক উদারতা ও মানবিকতা সমাজে জাগ্রত করতে হবে। খোসা কখনোই একটি পাকাকলাকে কাকের শক্ত ঠোঁটের ঠোকর থেকে নিরাপদ রাখতে পারে না— এই চিন্তা সমাজের লোকদের বোধগম্য হতে হবে।

প্রগতিকে শালীনতাবিরোধী ধরে নিয়ে পূর্বজ্ঞাত বিশ্বাসের পক্ষে সাপেক্ষানুমান দাঁড় করিয়ে মানসিক তৃপ্তি লাভ করা যায় বটে; কিন্তু ধর্ষণের মতো অপরাধ বন্ধ করা যায় না। অবশ্য এই পদ্ধতিতে নারীকে দুর্বল বানিয়ে ক্রমশ ঘরমুখো করার আফগান তরিকা তৈরি করা যায় মাত্র। “দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার” তো পৃথিবীর ইতিহাস— যে আদিমে আমরা আছি!

শেয়ার করুন: