হিজাব, নেকাব … এবং

Hijabi Nari 2

উম্মে ফারহানা: ইদানিং আমাদের দেশে বোরখা এবং হিজাব পরার বেশ চল হয়েছে। আমি যখন ছোট ছিলাম ( ১৯৮৭ সালে আমি নার্সারিতে পড়তাম, ওই বছর থেকে ধরলে সেই স্মৃতিকে মোটামুটি আমার শৈশবস্মৃতির প্রথম অংশ বলে ধরা যাবে) শুধু নানি/ দাদি টাইপ মহিলারা বোরখা পরতেন, সেগুলোও ভারতীয় বা পাকিস্তানি বোরখা, হিন্দি ছবিতে নায়িকা কারো চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে চাইলে যেমন পরে অনেকটা তেমন। সেগুলো হতো অবধারিতভাবে কাল রঙের, একই ধরনের কাপড় দিয়ে বানানো। আর্থিক সঙ্গতি ভেদে কাপড়ের মানের তারতম্য হত, কদাচিৎ চোখে পড়ত সাদা বোরখা, কিন্তু ডিজাইনে খুব একটা হেরফের হতনা।

ইদানিং যে বোরখা নানিদের বদলে নাতনিরা পরছেন সেগুলো বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ডিজাইনের এবং সেগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্যও আদি ও অকৃত্রিম ‘পর্দা’ নয়। পর্দা করবার উদ্দেশ্য নিজেকে আড়াল করা। যেহেতু ইসলাম ধর্ম প্রয়োজনে নারীকে গৃহের বাইরে চলাচলের অধিকার দিয়েছে, তাই পুরুষের জগতে পা রাখবার সময় পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি হতে নিজেকে বাঁচাবার উপায় হল বোরখা বা পর্দা।

ইসলাম ধর্মের অনুসারি নন এমন নারীরাও সমাজভেদে এমন বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেন নিজেকে রক্ষা করবার জন্য। আরও একটি ব্যখ্যা মডারেটেড মুসলিমরা দিয়ে থাকেন তা হল, আইয়ামে জাহেলিয়াতের সমাজে যে বেলেল্লাপনা চলতো তাতে নারী ও পুরুষরা সমানভাবে অংশ নিতেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী নারী নিজেকে ‘মুসলিম’ বোঝানোর জন্য এবং মুসলিম নারী কোন অনাচারে অংশ নেবে না সেটা জানান দেবার জন্য বোরখা পরতে শুরু করেন।

দ্বিতীয় ব্যখ্যাটি যারা দিয়ে থাকেন তাঁরা মনে করেন যে জাহেলিয়াতের যুগ চলে গেছে বলে এবং সমাজে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে  বলে বোরখার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কারণ নারীকে যেমন বলা হয়েছে রূপ সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখতে, তেমনিভাবে পুরুষকেও বলা হয়েছে নিজের দৃষ্টি সংযত করতে। অনাচার প্রতিরোধের দায়ভার একা নারীর কাঁধে বর্তাবে কেন?

যে ব্যখ্যাই গ্রহণ করা হোক না কেন, মুসলিম নারীর আত্মপরিচয়ের সঙ্গে বোরখা বা হিজাব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কোন শাড়ি পরা বাঙালি নারী যতই আব্রু রক্ষা করে চলুক না কেন, তাঁর মস্তক উদোম থাকলে তাঁর ইসলাম পূর্ণ হয়না, তাঁর ধর্ম কি তা প্রথম দর্শনেই বলে দেওয়া যায় না। কিন্তু স্টিলেটো বুট পরা মিশরীয় নারী যখন তাঁর দেহবল্লরীর সকল সৌন্দর্য আঁটসাঁট পোশাকের মাধ্যমে অকাতরে প্রকাশ করবার সময় মাথার কাপড়টুকু ঠিক রাখেন, তাঁর ইসলাম অটুট থাকে, তাঁর ধর্ম কি কেউ সে প্রশ্ন করে না।

হিজাব নিজেই ইসলাম ধর্মের পতাকা, ইউনিফরমও বলা চলে। আমাদের দেশেও ইদানিং এই মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত ইসলামের ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। অনেক মেয়েকে দেখা যায় পদযুগল জিন্স দিয়ে ঢাকা কিন্তু মাথায় বেশ একটি আবরণী আছে। বাংলাদেশে জিন্স শুধু শহুরে আধুনিকারাই পরেন, মফস্বলেও জিন্স বা স্কার্টের মতন পাশ্চাত্য পোশাকগুলোকে নিন্দার চোখে দেখা হয়। ওই পোশাকে শরীর আবৃত থাকলেও তা সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই একজন ওয়েস্টার্নাইজড নারীর এহেন ইসলামচর্চা খটকার জন্ম দেয় বই কি।

ইসলাম ধর্ম নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই নিষেধ করেছে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সংস্কৃতি, তাদের চালচলন, পোশাক বা খাদ্যভ্যাস রপ্ত করবার বিষয়ে। জিন্স একটি ইউরোপীয় পোশাক, এটি শালীন কি অশালীন তা বিচারের আগেই এটি পরিত্যাজ্য হবার কথা। কিন্তু এঁদের কাছে এটি আধুনিকতার পরিচায়ক, ধর্ম তো রক্ষা হচ্ছে হিজাব দিয়েই! অনেক বোরখা পরা (হিজাব এবং নেকাব) নারীকে আমি দেখেছি নেইলপলিশ ব্যবহার করতে।

আমরা জানি অজু করবার শর্ত পূরণে নেইলপলিশ একটি বাধা, তাই নামাজ পড়তে হলে এটি ব্যবহার করা চলে না। যে নারী নেইলপলিশ পরেন তিনি অবশ্যই অজু করতে পারেন না। কিন্তু তাতে কি? বোরখা বা হিজাব বলে দিচ্ছে তিনি মুসলিম। তিনি ইসলামি।

অনেক হিজাবে বিভিন্ন রঙ, চুমকি, লেইস আর পুঁতির ব্যবহারও দেখতে পাচ্ছি। যদি আড়াল করাই উদ্দেশ্য হয়, তবে এহেন বাহুল্য কেন? আরও বেশি চোখে পরবে এমন উজ্জল রঙের ব্যবহার কেন? কথা বলে দেখেছি বিভিন্ন নারীর সঙ্গে। এঁদের হিজাবের রঙের মতন উদ্দেশ্যও বিভিন্নমুখী এবং চমকপ্রদ।

চুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এন্টি ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পুতে কাজ হচ্ছেনা, ডাক্তার বলেছেন মাথা ঢেকে রাখতে, যাতে ধুলো জমে স্কাল্প ময়লা না হয়। পরলাম হিজাব।

বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তায় বখাটেদের উৎপাত, পরলাম নেকাব, বাসে উঠেই খুলে ফেললাম। স্বামীর বাড়ির সবাই হাজী, পরলাম বোরখা, শ্বশুরঘর থেকে ফিরেই খুলে ফেললাম। সংসারে শান্তি বজায় থাকল। ইসলামের সঙ্গে হিজাবের সম্পর্ক একেবারেই নেই এসব ক্ষেত্রে।

দু’তিনটি ঘটনার উল্লেখ করে হিজাব ও নেকাবের বিষয়ে আমার শ্লেষ মিশ্রিত বিরক্তির ব্যখ্যা দিতে চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম একটা কাজে, অনেক কিছুর সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের আচার ব্যাবহার, চাল চলন, পোশাক আশাক। বহু হিজাবধারিণী আধুনিকাদের দেখলাম জিন্স আর ব্যলেরিনা শুজ পরে মাথায় ইসলাম রক্ষা করে চলেছেন। জানলাম এঁরা আমার নিজের বিভাগের ছাত্রী। বাসে আবার দেখা হল ছোট দলটির সঙ্গে, তাঁদের উচ্চকিত আলোচনায় যে কোন সহযাত্রী বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবে কে বা কারা এত চেঁচামেচি করছে। এবং মজার ব্যপার হল এই নব্য ইসলামি দলের আধুনিকাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বিদ্যা বালানের নতুন ছবি ‘মাই ডার্টি পিকচার’।

এভাবে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে করতে রাস্তায় চলে, পুরুষদের আগ্রহ উদ্রেককারী বিষয়ে উঁচু গলায় কথা বলতে বলতে বাসে যাতায়াত করে ইসলাম ধর্ম কি করে রক্ষিত হতে পারে আমি জানি না। হিজাব পরার প্রধান শর্ত ইসলাম রক্ষা নয়, ইসলাম ধর্মের বিধি মোতাবেক আব্রু রক্ষা করা। অন্তত সাধারণ সংজ্ঞায় তাই হবার কথা। এখানে হচ্ছে উল্টোটা। ইসলামের নাম রাখছে হিজাব কিন্তু মান রাখতে পারছেন না ব্যবহারকারিনীরা ।

আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই সেখানে অনেক হিজাব এবং নেকাব ব্যবহারকারিনি ছাত্রী আছেন। হিজাব বিষয়ে আপত্তির কিছু নেই, কিন্তু পরীক্ষার সময় নেকাব খুলতে না চাইলে সেটাতে আপত্তি করার যথেষ্ট কারণ আছে বই কি! ভর্তি পরীক্ষায় আমরা নেকাব খুলিয়ে প্রবেশপত্রের সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেখে নেই। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় সেটি করা হয় না।

আমার এক পুরুষ সহকর্মী, যিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আমাকে একদিন অনুরোধ করলেন তাঁর হয়ে এ কাজটি করে দিতে। একে তিনি পুরুষ,তায় হিন্দু, তিনি কারো নেকাব খুলিয়ে চেহারা দেখতে চাইলে তা নিয়ে বেশ ঝামেলা তৈরি হতে পারে। আমি আমার সহকর্মীর অসহায়ত্বে আহত হলাম। খাতায় সাক্ষর করবার আগে প্রথম বর্ষের দুই ছাত্রীকে বললাম নেকাব খুলতে। একজন খুললেন, আরেকজন খুললেন না।

শুধু এটুকুই বললাম যে হজ্বব্রত পালন করতে চাইলে তাঁকে সৌদি আরব যেতে হবে এবং পাসপোর্টের ছবিতে নেকাব থাকলে সেটি চলবেনা। আমি জানিনা সেই ছাত্রী আমার শ্লেষাত্মক বাক্যবাণকে ইসলামবিরোধী আচরণ হিসেবে ধরে নিয়েছেন কি না। সামান্য বুদ্ধি যদি তার ঘটে থেকে থাকে তাহলে তাঁর বোঝা উচিৎ হজ্বের কথা আমি কেন বলেছি।

যে কেউ যত ধার্মিক হোক, শিক্ষকের আদেশ অমান্য করা তাঁর জন্য ভুল, ইসলাম ধর্ম এটা শেখায় না, শিক্ষকের মর্যাদা পিতামাতার পরই। একজন নারী শিক্ষককে চেহারা দেখালে এমন কোন আহামরি গুনাহ হয়ে যাবে না।  চেহারা একজন মানুষের আইডেন্টিটি। কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাজ ব্যক্তির পরিচয় লুকিয়ে রেখে চালান যেতে পারেনা।

তৃতীয় এবং সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাটি এমনঃ

ময়মনসিংহের স্টেশন রোড মোড়ে গিয়েছি তোশক বানাতে, একটা চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি। উজ্জ্বল ফিরোজা রঙের নেকাবওয়ালা বোরখা পরা এক ছিপছিপে তরুণীকে দেখে চমকে গেলাম। একই ধরনের একই রঙের বোরখা আমার এক খালাতো বোন ব্যবহার করে, শহরতলীতে যে এলাকায় ওরা থাকে সেখানে যাবার ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যায় স্টেশনরোডে। কিন্তু মেয়েটি আমার খালাতো বোন হতে পারে না কারণ সে ঢুকল একটি হোটেলে, হোটেল রূপমহল, নামেই বলে দিচ্ছে ওটা কি ধরনের জায়গা, কি উদ্দেশ্যে একটি মেয়ে দিনের বেলা ওই হোটেলে ঢুকতে পারে। আমি না হয় মনের শান্তির খাতিরে ধরে নিলাম মেয়েটি আমার আত্মীয়া নয়। কিন্তু যদি আমার বোনও নেকাব ব্যবহার করে, ওর পরিচিত সব মানুষ নিশ্চয়ই ওর বোরখা খুব সাধু উদ্দেশ্যে পরা হয়েছে বলে ধরে নেবে না। আমি পরবর্তী সাক্ষাতে তাকে বললাম যেন বোরখা পরলেও নেকাব সে ব্যবহার না করে।

আমার কথা সে মানছে কি না জানিনা, কিন্তু এখন আমার আকাশি , নীল বা পেস্তা রঙের বোরখা দেখলেই অস্বস্তি হয়, বিরক্তি আসে এবং শেষকালে বেদম রাগ ওঠে।

শেয়ার করুন: