ম্যাডাম মমতা শঙ্কর, আমরা লক্ষ্মী নই, ঊর্বশীও না

শতাব্দী দাশ:

ব্যক্তি-আক্রমণ কোনো সুস্থ সমালোচনার প্রণোদনা হওয়া কাম্য নয়, তা সেই ব্যক্তি সাধারণ হোন, বা অ-সাধারণ। বাকস্বাধীনতার ধুয়ো তুলে, ইন্টারনেটে সমালোচনার নামে, ব্যক্তিকে প্রায়শ হয়রানি করা হয়— এও সত্য। সত্য এও যে, ইন্টারনেটের এক প্রতারক, আপাত-সাম্যবাদী চরিত্র আছে: এখানে সাধারণ মানুষও আম্বানিকে তুলোধোনা করতে সক্ষম; এবং তা করতেও আগ্রহীও কারণ বাস্তবে তা করার ক্ষমতা তার নেই৷

কিন্তু কলিযুগের (‘কলিযুগ’ না পোষালে পোস্ট-ট্রুথের যুগ ভেবে নেওয়া যায়; এমনিতেও কলিযুগের বর্ণনায় বলা হয়েছিল, সে যুগে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ বোঝা যাবে না) ধরনই হলো এই যে— এখানে সত্য বহুস্তরী। তাই নেট-লব্ধ যে কোনো সমালোচনাকে ব্যক্তি-আক্রমণ, অক্ষমের আস্ফালন, বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার ইত্যাদি দাগিয়েও লাভ নেই। প্রেক্ষিত বিচার জরুরি।

গৌরচন্দ্রিকার পর সরাসরি প্রসঙ্গে আসা যাক। শ্রীযুক্তা মমতাশঙ্করের সাম্প্রতিক উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমানে ও অতীতে তাঁর বারংবার বলে চলা কথাগুলির পিছনে থাকা পিতৃতান্ত্রিক ও নারীবিদ্বেষী প্রবণতাগুলির সুস্থ সমালোচনা নিতান্তই জরুরি হয়ে পড়ছে, তা তিনি যত বড় শিল্পীই হোন না কেন৷ অবশ্য তার আগে দু হাত তুলে স্বীকার করে নেওয়া দরকার, আমি ‘নেচে দেখাতে’ পারবো না (ওঁর সমালোচকরা প্রায়শই বলেন ‘আগে তো ওঁর মতো নেচে দেখাও’)। প্রাক্তন অভিনেত্রী ও বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি দলের নেত্রী রূপা গাঙ্গুলি আবার বলেছেন, ওঁর নখের যুগ্যি হতে। তাই এও স্বীকার করি, বংশকৌলিন্যে ও শিল্পকৌলিন্যে আমরা ওঁর পায়ের নখের যুগ্যি নই। আগাম বলে রাখা ভালো যে, অভিনয়শিল্পীও নই (‘আগে অভিনয় করে দেখা…’ ধরনের প্রশ্নের আগাম উত্তর)৷ তবে ছবি-টবি দেখি৷ যেমন মমতা শঙ্কর অভিনীত একটি ছবি দেখেছিলুম, মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’। সে প্রসঙ্গে আসছি পরে৷

কিন্তু বিখ্যাত শিল্পী, বিখ্যাত পরিবারের উত্তিরাধিকারী বা আভিজাত্যের প্রতিভূদের নারীবিদ্বেষের সমালোচনা হবে না, নারীবিদ্বেষের সমালোচনা হবে শুধু গো-বলয়-জাতদের বা ‘সড়কছাপ’ ‘ইভটিজার’ -দের — এ বড় যুক্তিহীন আবদার। তিনি যদি নিতান্ত নরম মনের ভালমানুষ হন, তবু কখনও-সখনও তাঁর ভদ্র আচরণের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি যে, ‘ভদ্রতা’-র যে সামাজিক সংজ্ঞা তাঁকে শেখানো হয়েছিল (মানে, ভদ্রতার যে সংজ্ঞা সচরাচর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শেখানো হয়), তা হয়তো অসম্পূর্ণ। কারণ বহুলসংখ্যক মেয়ে বারবার তাঁর অভদ্রোচিত কথায় আহত।

‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিটি একটি মেয়ের রাতে বাড়ি না ফেরা ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল। না, মেয়েটির সঙ্গে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি । কিন্তু একটি মেয়ে রাতে বাড়ি না ফিরলে যে পরিবার ও প্রতিবেশীদের দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে যায় যথাক্রমে কলঙ্কভয় ও নিন্দা-প্রবণতা— এই নিয়েই ছিল সে ছবি। শেষ দৃশ্যে মেয়েটি ফিরে আসে। ততক্ষণে, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই, সকলের চোখে সে হয়ে গেছে ‘মন্দ মেয়ে’। মৃণাল সেনের দুঃসাহস এমনই যে, শেষ দৃশ্যেও তিনি দর্শককে বলে দেন না, মেয়েটি কোথায় গিয়েছিল? কোনো সাফাই দেন না। কারণ মেয়েটি কোথায় গিয়েছিল, তা জানা সকলের স্বাভাবিক অধিকার নয়। মেয়ের চলার ও বলার ধরন, বাইরে বেরোনোর ও বাড়ি ফেরার সময় — এই প্রতিটি খুঁটিনাটি জানার এক্তিয়ার সকলের নেই৷

মমতা শঙ্কর অ-সাধারণ অভিনয়শিল্পী বলেই চরিত্রটিতে বিশ্বাস না করেও তাতে অভিনয় করতে পেরেছেন। পরে ‘পিংক’ চলচ্চিত্রেও তিনি কাজ করেছিলেন৷ এই ছবি ভারতের প্রেক্ষিতে প্রথমবার ‘নো মিন্স নো’ স্লোগানকে জনপ্রিয় করতে চেষ্টা করেছিল। মদ্যপ অবস্থায় যৌন নিগ্রহের শিকার তিনজন মেয়ের উকিলের ভূমিকায় ছিলেন অমিতাভ বচ্চন আর তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীয়ের ভূমিকায় মমতাশঙ্কর। সেখানে মমতাশঙ্করের চরিত্রটি তিন নিগৃহীতাকে আশীর্বাদ করেন মৃত্যুর আগে। আবারও মমতা শঙ্কর একজন কুশলী শিল্পী বলেই নিখুঁত অভিনয় করতে পারলেন এমন চরিত্রে, যেমন তিনি নন। তাঁর জন্য টুপি খুলে শ্রদ্ধা তাঁর প্রাপ্য।

শিল্পী প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার পর, সহনাগরিক ও সহমানবীর সঙ্গে/ তাঁর প্রতি বাতচিত হয়তো চলতে পারে৷ মমতা শঙ্করের মধ্যে, আবারও প্রশংসনীয়ভাবে, কোনো ভান নেই। ‘পিংক’-এর অব্যবহিত পরেই তিনি সৎভাবে বলেছিলেন, ওই ছবির বক্তব্যে তিনি বিশ্বাস করেন না৷ সে আমাদের অনেক পূর্বজাই করেন না৷ বেশ কথা৷ কিন্তু মমতা শঙ্কর সেলেব্রিটি। তাই তাঁর মতামত চাওয়া হয় নানা বিষয়ে, সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হয়। অতএব ২০১৬ সালে আনন্দ প্লাস-এ তিনি বেশ এক হাত নিয়েছিলেন এখনকার মেয়েদের। ‘মেয়েরাই অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের কারণ’ এইরকম একটি চরম বক্তব্যে উপনীত হয়েছিলেন শ্রীমতী মমতা শঙ্কর। আরও বলেছিলেন, ‘আজকাল দেখি মেয়েরা ছোটো জামাকাপড় পরে মা-বাবার সাথেই রাস্তায় বেরোয়।’ অর্থাৎ বলতে চেয়েছিলেন, বাবা-মা কেন অনুমতি দেন? যেন মেয়ের বাবা-মায়ের কর্তব্য হবে শরীরের অধিকার নয়, শরীরের লজ্জা সম্পর্কে মেয়েকে অবহিত করা। বলা বাহুল্য, ছেলের বাবা-মায়েরা এ বিষয়ে কোনোকিছুই শেখানোর দায় নেই৷

সেবার পাঠক হিসেবে একটি চিঠি আমায় লিখতে হয়েছিল এবং আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তা ছেপেছিলেনও বটে। প্রাচীন লেখাপত্র হাঁটকে যা পাওয়া গেল, তাতে দেখছি, সেবার লিখেছিলুম,

“….গতকাল অর্থাৎ ৯/১১/২০১৬ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ প্লাস’ বিভাগে শ্রীমতী মমতা শঙ্করের সাক্ষাৎকারটির সাথে সুদূর আমেরিকার রাজনীতিতে নারীবিদ্বেষের জয়জয়কার আশ্চর্যভাবে সমাপতিত হল।

সেলিব্রিটির বক্তব্য ও মতামত তাঁর ব্যক্তিগত। কিন্তু সেলিব্রিটি বলেই প্রথম সারির সংবাদপত্রে যে কোনো বিষয়ে তাঁর মতামত ছাপা হয় এবং জনমানসে তার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
…সেই কারণেই তাঁর বক্তব্যকে আর ‘ব্যক্তিগত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, এক বিশাল শ্রেণির মানুষের প্রচলিত ধারণাকে তিনি ভাষায় প্রকাশ করছেন। সেলিব্রিটি হওয়ায়, তার সাথে যোগ হয়েছে ‘প্রিচিং’ এর মাত্রা। এই ‘প্রচলিত ধারণাগুলি’-র বিরূদ্ধেই জেন্ডার মুভমেন্টের এত লড়াই। এত স্লাটওয়াক। এত বিশ্লেষণ। ‘রেপ’ এর কারণ যে আসলে ক্ষমতা, ক্ষমতাপ্রদর্শন ও নিয়ন্ত্রণেচ্ছা—পোষাক বা এইরকম কোনো ‘ইন্ধন’ নয়, তা বহু আলোচিত।

এসব কিছুকে শ্রীমতী মমতা শঙ্কর আলগোছে নস্যাৎ করায় আমি স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ। সোজাসুজি ‘ধর্ষণ সংস্কৃতি’-র প্রতিনিধিত্ব শ্রীমতি মমতা শঙ্কর করছেন বলে মনে করি। ধর্ষণ যে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, নারীকে সমষ্টিগতভাবে ‘ভোগ্য এবং ভোগ্যমাত্র’ ভাবার কালচার থেকেই যে এই অপরাধের জন্ম, তা তাঁর কথার প্রতিটি লাইনে প্রকটভাবে বোঝা যায়।

(মেয়েরা কেন বাবা-মায়ের সঙ্গেই ছোট পোষাক পরে বেরোয় এই সংক্রান্ত) তাঁর বিস্ময়কে কাটাছেঁড়া করলে একটা সোজা বক্তব্য পাই আমরা, যা তিনি মুখে বলেন না, মন্দ শোনায় বলে। কিন্তু বক্তব্যটা জলবৎ তরল। তা হলো, এই বাবা-মায়েরা কেন মেয়েকে শেখালেন না যে নিজেকে ‘ভোগ্য’ হিসেবে ভাবতে হবে সর্বক্ষণ? প্রতি কন্যাকে মা কেন একথা বুঝিয়ে দেবেন না যে যে কোনো বয়সের পুরুষ তাকে ‘ভোগ্য’ হিসেবেই দেখবে? নিজেকে ঢেকে রাখার দায়িত্ব তারই। তাতে যে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, তেমন কোনো কথা নেই। তবে অন্তত নির্যাতিত যদি হতে হয়, তা হওয়ায় পর খানিক ‘আহা উহু’ নিশ্চিত করা যাবে। ছোট পোশাক যৌন নির্যাতন আবাহন করে -একথা কে না জানে! ছোট পোশাক তাই ছোট শিশুরও বর্জনীয়।
…. মমতাশঙ্কর যখন বললেন, ধূমপায়ী, খাটো পোষাকের মেয়েরা নিজেদের দোষেই ধর্ষিত হন, এই মেয়েদের কারণে মেয়ে হিসেবে তিনি লজ্জিত, তখন সে কথার পপুলার কালচারে গ্রহণযোগ্যতা থাকে বটে।’

আসলে প্রচলিত ‘সংস্কৃতি’, ‘সাংস্কৃতিক’, ‘সংস্কৃতিমান’ ইত্যাদির ভাষা ও ভাষ্য যখন আমাদের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাগুলিকে সার-জল দেয়, আমরা স্বস্তি বোধ করি। ‘আমি শুধু না, সেলিব্রিটিও অমন ভাবেন।’ আর এই মুহূর্তেই আমরা ভুলে যাই, এই পোশাক, আচার আচরণ, রাতে বেরোনোর সময়, ‘সামলে না চলা’র কথা বছরকয়েক আগে বলেছিল রাম সিং, নির্ভয়ার ধর্ষকদের মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত, আর তার আইনজীবীও। তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে। আরো কতজন ‘জ্যোতি সিং’ হয়ে গেছে। আমরা সেই ‘রেপ কালচার’এর পাঁকেই ‘সংস্কৃতি’ হাতড়ে চলেছি।…”

ইত্যাদি।

কিন্তু ২০১৬ সালে সে নিয়ে বিশেষ হট্টগোল হয়নি। এরপর জেন্ডার পলিটিক্স ও মমতা শঙ্করের বৈরী সম্পর্ক আমিও ভুলে গেছি। ২০২৪ সালে মমতা শঙ্কর অনুরূপ একটি বিস্ফোরণ ঘটালেন।

এবার মমতা শঙ্কর গিয়েছিলেন এক শাড়ি-উৎসবে। তথাকথিত আধুনিকাদের শাড়ি পরার ধরনটি, তিনি বলেছেন, অশ্রদ্ধার উদ্রেক করে। বস্তুত, তাঁর মতে, বক্ষযুগল থেকে আঁচল সরে যাওয়ার প্রবণতাটি অশালীন। প্রবণতাটি ‘রাস্তার মেয়েদের’ বা ‘ল্যাম্পপোস্টের তলার মেয়েদের’ ক্ষেত্রে মানা যায়, কারণ তাঁরা তা পেটের দায়ে করেন। আধুনিকারা কেন তা করবেন?

এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভাল যে, ওই মেয়েদের যৌনকর্মী বলাটা সমীচীন। ‘রাস্তার মেয়ে’ বা ‘ল্যাম্পপোস্টের তলার মেয়ে’ শব্দবন্ধে অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর অব্যক্ত ঘৃণার ইঙ্গিত থাকে৷ তার চেয়ে ‘যৌনকর্মী’ শব্দে খানিক হয়ত শ্রমের মর্যাদা থাকে, নিতান্তই মৌখিকভাবে, তবু থাকে।

তাঁর মূল আপত্তি অবশ্য, আগেই বলা হয়েছে, সেই মেয়েদের নিয়ে, যারা দেহোপজীবিনী নয়, তবু যাদের আঁচল ঠিক জায়গায় থাকে না। তিনি বলেন, ‘তুমি যদি ভাল মেয়েই হবে, তাহলে তোমার আঁচল কেন ঠিক থাকবে না?’ এইখানে তিনি, অতএব, আনলেন সেই অভিজ্ঞান, পশ্চিমে যাকে ‘অ্যাঞ্জেল/ হোর’ বাইনারি বলে। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই নারী’ কবিতা অনুযায়ী তাকে আমরা ‘লক্ষ্মী/ ঊর্বশী’ দ্বিত্ব নামেও ডাকতে পারি। ‘ভালো’ মেয়ের ভালত্বের এককগুলি হলো পোষাকের মাপজোক, বাইরে বেরোনো বা না বেরোনো, বেরোলে বেরোনোর সময়, গৃহকর্মনিপুণতা, সহনশীলতা ইত্যাদি। এ ভালত্বের সংজ্ঞা শুধু নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পুরুষের ভালত্ব আলাদা রকম।

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাবুরা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের পত্র-পত্রিকায়, অনেক সময় কাল্পনিক দুই নারীর কথোপকথনের মাধ্যমে, এমন নানা নীতিশিক্ষামালা প্রকাশ করতেন, যাকে বলা যায় ‘লক্ষ্মী মেয়েদের কনডাক্ট বুক।’ তারা গৃহের শোভা, অবগুণ্ঠনাবৃতা, তারা বেশি পড়াশোনা করলে স্বামী মারা যায়, আর পরপুরুষে আসক্ত হলে সাদাস্রাব বাড়ে — এমন অনেক অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব সেখানে থাকত। সর্বোপরি, এই মেয়েরা প্রায় অযৌন, কিন্তু স্বামীর যৌন সেবাদাসী। সে আব্রু রক্ষা করবে, সেই আব্রু ভেদ করার অধিকার একমাত্র পুরুষের। তার আবরণ উন্মোচন করে পুরুষ যা দেখবেন, তাকে পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী, স্তোকনম্রাস্তনাভ্যাং, শ্রোণীভারাদলসগমনা ইত্যাদি বলে বর্ণনা করবেন। কিন্তু নারী যেচে নিজেকে উন্মোচিত করবেন না। মমতাশঙ্কর সে ধারা বিলকুল বজায় রাখেন।

যাই হোক, মমতা শঙ্কর আরও বলেন, ‘এরপর ছেলেরা কিছু বললে আমাদের রাগ হবে’ বা ‘তাদের মধ্যে এমন কিছু থাকতে হবে যাতে ছেলেরা তাদের শ্রদ্ধা করে।’ অর্থাৎ ছেলেদের মেয়েদের বিষয়ে ডিফল্ট ভাবটি হবে অশ্রদ্ধার। মেয়েদেরই নিজেদের পোষাক ও আচরণ এমনভাবে ‘কাস্টমাইজ’ করতে হবে, যাতে জোর করে শ্রদ্ধা-টদ্ধা আনা যায়। পরিভাষায় একে একদিকে বলে ‘স্লাট শেমিং’, অন্যদিকে বলে ‘ভিক্টিম ব্লেমিং।’ এ প্রসঙ্গে তো সেই ‘পিংক’ বিতর্কের সময় চিঠিতেই লিখেছিলাম। আজও মমতাশঙ্কর নিজের মতামতে অনড় আছেন।

প্রশ্ন হলো, জাপটে বুকে আঁচল না জড়িয়ে যারা আলগোছে আঁচল ফেলে রাখে, তারা এরকম কেন করে? উত্তরটি সহজ। তা স্পষ্টভাবে বলা দরকার সোচ্চারে। অনবধানে আঁচল যদি সরে গিয়ে না থাকে, তাহলে তিনি তা করেন নিজেকে যৌনভাবে আকর্ষণীয় দেখানোর জন্য।

বিজ্ঞাপনে নারীর যৌনায়ন ঘটায় পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদবিরোধী নারীবাদীরা অবশ্যই তার প্রতিবাদ করেন ও করবেন। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রসারের অনেক আগে থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণী সম্ভাব্য যৌনসঙ্গীকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। একইভাবে মানুষের যৌনতার সময় এবং তার যৌন ভাবনার সময়, নিজেকে যৌনতার কারক ও যৌনবস্তু উভয় হিসেবে দেখে, সম্ভবত। নারীদের দাবিটা তাহলে তার শরীরের পণ্যায়ণ এবং ‘কেবলমাত্র যৌনায়নের’ বিরুদ্ধে। তার অবশ্যই দেহ আছে, তেমনই আছে মনন ও বুদ্ধিও। নিজ দেহের মতো নিজ যৌনতাতেও তারই প্রথম অধিকার। তার পোশাক যদি নিজেকে আকর্ষক করে তোলার প্রচেষ্টাও হয়, সচেতনে বা অবচেতনে, তবু সে শ্রদ্ধার পাত্রী হতে পারে। কারণ তার যৌন ইচ্ছা তার একটি মাত্র পরিচয়, একমাত্র পরিচয় না। হয়তো সে বিশেষ বা স্বনির্বাচিত কারও বা কারও কারও জন্য সেজেছে। সকলের জন্য নয়। যে কোনো পুরুষের প্রতি আহ্বান না লেখা থাকতে পারে তার পোশাকে।

স্লাট-শেমিং-কে প্রশ্রয় দেন যাঁরা, স্লাট-শেমিং দেখলে নীরব থাকেন যাঁরা, তাঁরা নারীর আপন শরীরের সেই অধিকার খর্ব করতেই সাহায্য করেন। তাঁদের সহানুভূতি নিয়েই পরবর্তী ধর্ষক বলে ‘শি ওয়াজ আস্কিং ফর ইট’৷ আস্কিং ফর ইট? এই সূত্রে মনে পড়লো, একটি প্রদর্শনী আয়োজন করেছিল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যেখানে প্রদর্শিত হয়েছিল ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের পোশাক। সেখানে ছিল স্বল্পবাস, হ্রস্ববাস, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ঘাঘরা-চোলি, ট্রাউজার, স্কার্ট— প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে যা যা নারীপোশাক হওয়া সম্ভব, সবই৷ আর ছিল স্কুল ড্রেসও। অপ্রাপ্তবয়স্কার, বালিকার স্কুল ড্রেস। আস্কিং ফর ইট!!

মমতা শঙ্কর তাঁর ধারণায় অটল থাকলেও, প্রাণে পুলক লাগল দেখে যে, যুগ একচুল হলেও বদলেছে। এবার প্রতিবাদকারী দু-এক জন মোটেও নয়। এখনও তারা তুলনামূলক সংখ্যালঘু, তবু সংখ্যায় অনেক।

ক্রমশ একে একে এসে পড়ল মমতা শঙ্করের আরও নানা উক্তি। এক জায়গায় তিনি বলছেন, মেয়েদের ঋতুস্রাব ব্যাপারটি নিয়ে পুরুষদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন নেই! অথচ, তাহলে পুরুষরা চিরকালই এই স্বাভাবিক অথচ কষ্টকর শারীরিক বিষয়টি নিয়ে, তার চেয়েও বড় কথা তার নিজের জন্মের নিতান্তই জৈবিক কারণটি নিয়ে, অন্ধকারে থাকবে, অসংবেদী হবে। হেডমাস্টার মশায় জানবেন না কেন মেয়েরা স্কুলে উপযুক্ত নারী শৌচাগার না থাকলে এগারো থেকে তেরোর মধ্যে স্কুলছুট হয়। পুরুষ ঊর্ধ্বতন জানবেন না লেডিজ টয়লেটে বিন রাখা কেন জরুরি। উঠতি বয়সের ছেলেরা জানবে না, কেন জামায় ‘দাগ’ লাগলে টিটকিরি মারতে নেই। এই গোপনীয়তার দাবি পরিচিত ও চিরাচরিত; কিন্তু ভয়াবহ। প্রসঙ্গত শাড়ি ও ঋতুস্রাব— দুই বিষয় সংক্রান্ত সাক্ষাৎকারই নিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন।

একইভাবে এক রূপান্তরিত নারী জানালেন, মমতা শঙ্কর একদা জানিয়েছিলেন যে তিনি ‘খোদার উপর খোদগারি’ পছন্দ করেন না। তিনি ‘অবমানব’ পত্রিকার জন্য লেখা চাইতে গেছিলেন। আরেকজন জানালেন, মেয়েরা বাহির সামলে বাড়ির কাজও নিপুণভাবে করবে, এক আধদিন বর সাহায্য করলে সেটা মহানুভবতা— এও নাকি তাঁর মত হিসেবে কোথাও ব্যক্ত হয়েছে। শ্রীমতি মমতাশঙ্কর জেনে অবাক হবেন, ‘এখনকার মেয়েরা’ আদৌ তা ভাবে না। সংসার ও বাইরের কাজের পর, কড়ায়-গণ্ডায় নিজের ভাগের বিশ্রাম ও শখপূরণের সময় আদায় করে নিতে তারা সঙ্গী পুরুষকেও সংসারকর্মে ভাগ নিতে শেখায় বা বাধ্য করে। বিষমকামী নারীরা (মমতাশঙ্কর কি সমকামী নারীর অস্তিত্বকে মেনে নিতে পারেন? তারাও আছে।) নিজেরা শুধু কর্মঠ হওয়ায় বিশ্বাস করে না, তারা কর্মঠ পুরুষও প্রত্যাশা করে। আর ঘরে ও বাইরে উভয়ের সমান দায়িত্বেই তাদের আস্থা।

আসলে এ লেখা খানিক মমতা শঙ্করের বক্তব্যকেন্দ্রিক। কিন্তু এ লেখা কখনই মমতা শঙ্করের মুখে ঝামা ঘষার জন্য নয়। আমাদের কাছে তিনি সামগ্রিক পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধি মাত্র, একজন ঘটনাচক্রে বিখ্যাত প্রতিনিধি। আমাদের ক্ষোভ তাঁর প্রতি ততটা নয়, যতটা সেই তন্ত্রের প্রতি৷ আসলে ম্যাডাম মমতাশঙ্করকে আমরা পিতৃতন্ত্রের দ্বারা মস্তিষ্কপ্রক্ষালিত মনে করি ও তাঁর জন্য বেদনাই বোধ করি।

বেদনা আমরা এ কথা ভেবেও বোধ করি যে, কেন তাঁর স্থির মতামত জেনেও মিডিয়া বারবার উক্ত সকল বিষয়ে তাঁরই মতামত যায়? তারা কি তাঁর মূল্যে বিতর্ক উস্কে খানিক বেশি টিআরপি চায়? তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতার কারণে এটা অনুমেয় যে, মিডিয়া জানে কী উত্তর আসতে চলেছে। তারা এও জানে যে এতে তিনিই বিপদে পড়তে পারেন৷ তাহলে বারবার কেন?

বেদনা এ কারণেও যে, তাঁর বন্ধু ও গুণমুগ্ধরা কেবল দলভারি করলেন; অথচ প্রশ্নহীন আনুগত্য নিতান্তই স্তাবকতার লক্ষণ। প্রকৃত শুভানুধ্যায়ীদের কাজ সুস্থ আলোচনা ও প্রয়োজনে সমালোচনা করা। সে কাজ করার মতো কি তাঁর পরিসরে কেউ নেই?

ম্যাডাম মমতা শঙ্কর, আমরা লক্ষ্মী নই৷ ঊর্বশীও না। আমরা, নিরানব্বই শতাংশ মেয়ে আসলে আছি এই দুই অন্তিম বিন্দুর মাঝামাঝি৷ আমাদের ছোট দুটি খোপে আঁটার চেষ্টা আমরা মানছি না, কারণ আমরা জেনেছি দুটি খোপেরই আছে নিজস্ব সীমাবদ্ধতা। জীবন আসলে দ্বিত্ব-বিহীন। তাই জীবন সুন্দর। দ্বিত্বহীন জীবনের চেয়ে শালীন আর নান্দনিক কিছু নেই৷

শেয়ার করুন: