ড্রিম গ্যাপ: কন্যা সন্তানকে সীমাহীন স্বপ্ন দেখতে সুযোগ করে দিন

নাহিদ আক্তার:

আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরতে চাই যা বিশ্বব্যাপী অগণিত অল্পবয়সী মেয়েদের আকাঙ্ক্ষা এবং ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করে – (দ্য ড্রিম গ্যাপ)- ড্রিম গ্যাপ বলতে মেয়েদের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা এবং সেই স্বপ্নপূরণের জন্য তাদের কাছে উপলব্ধ সুযোগগুলির মধ্যে বৈষম্য বোঝায়।

পরিবেশ পেলে খুব অল্প বয়স থেকেই মেয়েরা সীমাহীন কল্পনা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার অধিকারী হতে পারে। শিশুকালে মেয়ে শিশুরাও মহাকাশচারী, ডাক্তার, শিল্পী এবং নেতা হওয়ার স্বপ্নও দেখে। দু:খজনকভাবে বড় হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক বাধাগুলি তাদের এই আকাঙ্খাগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য করে। বৈষম্য, স্টেরিওটাইপ, সাপোর্ট সিস্টেমের অভাব এবং সম্পদের সীমিত অ্যাক্সেস প্রায়শই তাদের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ড্রিম গ্যাপের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দিকগুলির মধ্যে একটি হলো, গ্যাপটি জীবনের একদম প্রথমদিকেই শুরু হয়। গবেষণায় দেখা যায় যে ছয় বছর বয়স থেকেই মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় তাদের বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করে। পরিবার বা সমাজ তাদের শুধুমাত্র শরীরসর্বস্ব বা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে এবং একটা সময় কন্যা সন্তানটি নিজেও ভাবতে শুরু করে শুধুমাত্র একটি পুরুষকে খুশি করাই তাদের একমাত্র কাজ। তাদের জন্ম অন্যকে খুশি করার জন্য। পৃথিবীকে পপুলেট করার জন্য এবং মুখ বুঁজে সকল অনুশাসন মেনে নেয়ার জন্য। এখান থেকে জন্ম হয় ড্রিম গ্যাপ বা স্বপ্নের ঘাটতি। এই গ্যাপ আরও বেড়ে যায় যখন তারা তাদের আশেপাশে নারী রোল মডেল এবং পরামর্শদাতার তীব্র অনুপস্থিতি দেখতে পায়।
এমনকি যখন প্রভাবশালী নারীদের মেয়ে শিশুদের সামনে “খারাপ” নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন তারা আর নারীদের রোল মডেল হিসেবে আর দেখতে শেখে না।

যেমন ছোটবেলা থেকেই আমাদের বলা হতো নারীবাদ খারাপ আর তসলিমা নাসরিন একজন “দুষ্ট” নারী। সমাজ এবং পরিবার তাদের শেখায় যে রোলমডেল হওয়ার যোগ্য সবসময় একজন পুরুষ। এবং মেয়েরা ক্রমাগত পুরুষদের শৌর্য এবং ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হয়। পুরুষতন্ত্র মেয়ে শিশুটিকে এটাও বোঝায় যে নারীর ক্ষমতায়ন একটি ভুল ধারণা। ছোটবেলা থেকে আমাদের বোঝানো হয়েছে, যে দেশে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী সেই দেশে গজব নাজিল হয়। আর আমরাও বিশ্বাস করে সব মেনে নিয়েছি।

তদুপরি মেয়েদের প্রায়শই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (STEM) এর মতো পুরুষদের আধিপত্যের ক্ষেত্রগুলি থেকে নারীকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে এই জায়গাগুলোতে লিঙ্গ ব্যবধানকে স্থায়ী করে এবং মেয়েরা এই সব জায়গায় কন্ট্রিবিউট করতে পারে এমন দৃষ্টিভঙ্গি মেয়ে শিশুদের মনে তৈরি হয় না।

তবে আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, স্বপ্নের ব্যবধান শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য একটি জটিল সমস্যা নয়; এটা আমাদের সকলের জন্য তদুপরি পৃথিবীর কল্যাণের জন্য একটি বিশাল সমস্যা। যখন আমরা আমাদের অর্ধেক জনসংখ্যার স্বপ্ন এবং সম্ভাবনাকে সীমিত করি, তখন আমরা নিজেরাই দেশের অগ্রগতি এবং উদ্ভাবনকে বাধাগ্রস্ত করি। মেয়েরা এবং নারীরা সমাজ, অর্থনীতি এবং বৃহত্তর বিশ্বে যে ওপর সম্ভাবনা এবং অবদান রাখতে পারে তা থেকে আমরা নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত করি।

সুতরাং স্বপ্নের এই ঘাটতি পূরণ করতে আমরা কী করতে পারি?

প্রথম এবং সর্বাগ্রে আমাদের অবশ্যই স্টেরিওটাইপ এবং পক্ষপাতকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে যা সর্বদা মেয়েদের আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত করে রাখে। অবশ্যই তাদের সামনে ইতিবাচক রোলমডেল এবং পরামর্শদাতাদের  তুলে ধরতে হবে যাতে তারা বুঝতে শেখে যে তাদের স্বপ্নগুলি বৈধ এবং চাইলেই তা অর্জন করতে পারে। রাষ্ট্রকে, সমাজকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে মেয়েরা তাদের পছন্দসই যেকোনো ক্ষেত্র বা কর্মজীবনের পথ পছন্দ করার মতোন সক্ষমতা অর্জন করে।

উপরন্তু রাষ্ট্রকে অবশ্যই মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে এবং তাদের সম্পদ ও সুযোগের সমান সুযোগ দিতে হবে। এর অর্থ হলো STEM শিক্ষায় লিঙ্গ ব্যবধান বন্ধ করা, মেয়েদের মানসম্পন্ন স্কুলে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং মেয়েদের নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করে এমন উদ্যোগকে সমর্থন করা।

পরিশেষে ড্রিম গ্যাপ বন্ধ করার দায়িত্ব আমাদের সবাইকে নিতে হবে। আমরা পরিবার, পিতামাতা, শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক বা সম্প্রদায়ের সদস্য যাই হোক না কেন, মেয়েদের জন্য আরও ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব তৈরিতে আমাদের প্রত্যেকেরই ভূমিকা রয়েছে।

মূলত ড্রিম গ্যাপ হলো লিঙ্গ সমতা অর্জনের জন্য যা এখনই করা দরকার তা কঠোরভাবে মনে করিয়ে দেয়া। পাশাপাশি সব ধরনের বাধা ভেঙে ফেলা, নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এমন একটি বিশ্ব তৈরি করার আহ্বান, যেখানে প্রতিটি মেয়ে কোনরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই স্বপ্ন দেখতে পারে৷ আসুন একসাথে, স্বপ্নের এই ব্যবধান বন্ধ করা এবং সবার জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে কাজ করি।

শেয়ার করুন: