জিরো ডিসট্যান্স ও অবকাশের আনন্দ!

ফারদিন ফেরদৌস:

ড. নাদির জুনাইদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক। সৌম্যকান্তি চেহারা। মাথার কেশরাজিও খুব সিল্কি। কান বেয়ে ঘাড়ের ওপর পড়ে থাকে। এলোমেলো বাতাসে দোল খায়। ঠোঁটের ওপর গোঁফেরা আরো সুন্দর। দেখলেই বিপরীত লিঙ্গের বসন্ত জাগবার কথা। এমন এক স্যারের প্রেমে পড়বার জন্য মুখিয়ে থাকে একশ্রেণীর শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই প্লেটোনিক লাভ ওই শিক্ষকের পোষায় না। তাঁর লাগে কন্যাসম ছাত্রীদের ওপর আরোপিত জবরদস্তির ‘জিরো ডিসট্যান্স’!

বালকবেলায় মুখোশধারী ভদ্রলোকটি যখন শুরুর ক্লাসে পড়তেন, ঠিক সেই বেলা পিতৃ অথবা মাতৃপ্রতিম শিক্ষকের কাছ থেকে নীতিমূলক প্রবাদটি ঠিকই শুনেছেন: ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!’ সত্য কখনো গোপন থাকে না। অন্যায় করে কেউ সাময়িকভাবে সত্যকে ধামাচাপা দিলেও, একটা সময় সত্য তার আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ই। মিস্টার জুনাইদ বাল্যকালে শোনা কথাগুলো এক কান দিয়ে প্রবেশ করিয়ে অপর কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। আর এখন তো কানে কথাই যায় না। কী ভালো, কী মন্দ! কথারা চাপা পড়ে যায় মাথার লম্বা চুলে। এখানে ‘চুল’ শব্দটিকে নিজ দায়িত্বে হিন্দিকরণ করে পাঠ করা যেতে পারে। ধান বানতে শিবের গীত গাওয়ার পর, এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে ঘটনা কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও দীর্ঘদিন ধরে মানসিক নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ করেছেন এক শিক্ষার্থী।

প্রক্টর মো. মাকসুদুর রহমানের কাছে দাখিল করা অভিযোগে প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে তার ওপর নজরদারি করা, সময়ে অসময়ে ফোন করা, যৌন ইঙ্গিত দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আনেন ওই ছাত্রী।

অভিযোগে ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘তিনি আমার শারীরিক গঠন নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করতেন এবং যৌন উত্তেজনা প্রকাশ করতেন। একইসঙ্গে তিনি আমাকে যৌন প্রকৃতির ফোনালাপে অংশ নিতে প্ররোচিত করতেন।’

লিখিত অভিযোগে শিক্ষার্থী বলেন, ওই শিক্ষক বারবার বলেন, আমি ‘স্বাভাবিক’ নই এবং আমার চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া উচিত। তার চাপ ক্রমাগত বাড়ছিল। তিনি আমার অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বারবার জিজ্ঞাসা করেন কেন আমি তার রোমান্টিক আলাপে সাড়া দিই না। এটি মৌখিক নির্যাতনে পরিণত হয়েছিল। তিনি আমাকে ‘নির্বোধ’ বলে তিরস্কার করেছিলেন এবং আমাকে ‘অনুভূতিহীন’ বলতে থাকেন।

ওই ছাত্রী বলেন, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি লাগাতার যৌন হয়রানি সহ্য করেছি, তার কর্তৃত্বের অবস্থানের কারণে নিজেকে দুর্বল মনে করেছি।

এ বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। এটিকে আমি কেবল ব্যক্তিগত আগ্রাসন হিসেবে বর্ণনা করতে পারি।’

ওই অধ্যাপক অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আলাপচারিতায় অন্যান্য নারী শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করতেন এবং তাদের শারীরিক গঠন সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য করতেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

তিনি লেখেন, ‘আমি বহুবার জেনেছি যে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে তিনি এমন প্রস্তাব দিয়েছেন।’

লিখিত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান ওই শিক্ষার্থী।

বাস্তবতা হলো ২০০০ সালে শিক্ষকতা পেশা শুরু করা এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনেকেই এখন যৌনহয়রানির অভিযোগ আনছেন। ছাত্রীদেরকে ‘জিরো ডিসট্যান্সে’ পাওয়াটা ওই শিক্ষকের বিরাট ফ্যাসিস্ট অভিলাষ।
যৌক্তিক কারণেই বিভাগের শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের অপসারণসহ কঠোর শাস্তির দাবি করছেন। আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন ন্যায্য আন্দোলনে আমরাও অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একশ্রেণীর শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। কিন্তু এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিচার হওয়ার নজির খুবই কম। রাজনৈতিক মোড়ক দিয়ে ধর্ষকামী শিক্ষকদের ছাড় দেয়ার এন্তার অভিযোগ আছে। অথচ বিশ্বের সভ্য রাষ্ট্রগুলো যেখানে আইনের শাসন বলবৎ আছে, সেখানে কারো বিরুদ্ধে এমনতরো অভিযোগ ওঠার সাথে সাথেই অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদত্যাগ করেন এবং নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ তদন্তকারীকে বিচারিক কাজে সহায়তা করেন। শিক্ষক তো বটেই নৈতিক স্খলনের দায় মাথায় নিয়ে কোনো পেশাজীবীই তার স্বপদে বহাল থাকতে পারেন না।

নাদির জুনাইদের বেলায় কী ঘটলো দেখুন। প্রথমত তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গণমাধ্যমে অস্বীকার করেছেন তিনি। আর তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে তিন মাসের ছুটি তথা অবকাশের আনন্দ উপহার দিয়েছেন। কী উপভোগ্যময় জীবন!

যে অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে ওই শিক্ষকের সাময়িক বহিষ্কার হওয়ার কথা সেখানে তিনি পেলেন ৯০ দিনের ছুটি। কী আনন্দ! কী আনন্দ!

নাদির জুনাইদ ছুটিতে নিশ্চয়ই থাইল্যান্ডের পাতায়া অথবা ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গিয়ে অবকাশ যাপন করবেন। সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সতীর্থ আধিকারিকদেরও নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে শিখে আসবেন নারী কেবল ভোগ্যবস্তু মাত্র নয়। নারী ও পুরুষের জন্য উদার পৃথিবীটা সমান ও সমান্তরাল। যেখানে কোনপক্ষেরই জোর-জবরদস্তির ন্যূনতম সুযোগ রাখা হয়নি।

আমরা জানি, নাদির জুনাইদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্যাটানিক লালসার কুকর্মকে ভুলিয়ে দেয়া হবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে ফল বিপর্যয়ের ভয় দেখাবে মিস্টার জুনাইদের অনুবর্তী সঙ্গীরা। অতঃপর বীরদর্পে বিভাগীয় স্বপদে ফিরে এসে নাদির জুনাইদ অন্য আরও নারীর সর্বনাশে মন মাতাবে।

আমরা বলবো, ওই শিক্ষককে প্রশ্রয় দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টোটাল প্রশাসনকেই চিরস্থায়ী অবকাশে পাঠানো উচিত। ছাত্র পড়াবার নৈতিক ভিত্তি তাদের নেই। আমাদের সন্তানেরাই বা কোন ভরসায় ওখানে পাঠগ্রহণ করতে যাবে। ওখানে অনেক নাদির জুনাইদকেই লালন পালন ও ভরণপোষণ করা হয়। বাজে বাসনার অভয়ারণ্যে আর যাই হোক শিক্ষাদান চলে না। যৌন নিপীড়ন, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও সকল প্রকার অসাধুতার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র এবং মননশীল শিক্ষকদের সোচ্চার হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গন নাদির জুনাইদদের জন্য নয়।

লেখক: সাংবাদিক
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শেয়ার করুন: