হিজাব না থাকলে ন্যাড়া মাথাই ভালো?

ফারদিন ফেরদৌস:

হিজাব পরার স্বাধীনতা রাখতে চাইলে হিজাব না পরার স্বাধীনতাও থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তিগত নির্দেশনায় তো নয়ই, এমনকি রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করেও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পোশাক বাধ্যতামূলক করা উচিত নয়। শিশুদের বেলায় তো আরও নয়। তাদের কোমলমতি মনে জোরজবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া মানে শুভবোধের সাথে সরাসরি যুদ্ধ শুরু করে দেয়ার শামিল। পোশাকের মাধ্যমে শিশুকে যদি ধর্মীয় পরিচয়ে বিভাজিত করবার প্রেরণা দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে শিশুদের সর্বজনীন মনুষ্যত্ব বিকাশে বিরাট ঘাটতি থেকে যেতে পারে।

যে কারণে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমেও ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে ধর্মাচারী বা নৈধার্মিকতার খানা সংরক্ষণ করা হয়েছে। কেউ যদি নিজের দায়িত্বে বলতে চায় সে কোনো ধর্মের অনুসারী হবে না; তবে সেই অধিকারটিও সসম্মানে তার জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

সম্প্রতি ফ্রান্স সরকার লিখিত ফরমান জারি করে বলে দিয়েছে, শিক্ষায়তনে ধর্মীয় চিহ্নের ব্যবহার করা যাবে না। শ্রেণিকক্ষে পোশাক দেখে কারো ধর্মবিশ্বাস বুঝতে পারা উচিত নয়। কারণ ধর্মীয় পোশাক বা চিহ্ন শিশুদের মনে মারাত্মক বিভেদ সৃষ্টি করে।

অপরদিকে প্রভাবশালী মুসলিম দেশ মিশরের স্কুলে নিকাব (Face Veil) পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে (নিকাব হলো -বোরখার যে অংশটি নারীদের চেহারা ঢেকে রাখে)। গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকেই কার্যকর হয়েছে ওই নিষেধাজ্ঞা। মিশরের শিক্ষামন্ত্রী রেদা হেগাজি ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে নিকাব নিষিদ্ধ করার ঘোষণা করেন।

শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, নিকাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও হিজাব (Head Coverings) পরে ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারবেন। অর্থাৎ, রীতি অনুযায়ী, ছাত্রীদের চুল ঢেকে রাখার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। তবে কোনও ছাত্রী হিজাব পরবে কি পরবে না, তা যেন তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হয়। বাবা-মায়ের সেই সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবগত থাকা উচিত। ছাত্রীকে কোনও কিছু করতে যেন বাধ্য না করা হয়।’

তাহলে এটি পরিস্কার হলো যে, হিজাব পরতে কোনো মানা নেই। না পরাটাও কারো জন্য কোনো সমস্যা নয়। এটা যে কেউ পরতেই পারে। কিন্তু যে পরবে সেটা তাকেই চাইতে হবে।

সভ্য সমাজের এমন বাস্তবতায়, বাংলাদেশে হিজাব না পরায় স্কুল ছাত্রীদের চুল কেটে নিয়েছেন এক নারী শিক্ষক।

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, হিজাব না পরায় মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার সৈয়দপুর আব্দুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীদের সুন্দর কেশে কাঁচি চালিয়েছেন খোদ ক্লাস টিচার।

বুধবার মাইসা আক্তারসহ আরও ৭ জনের চুল কেটে নেন বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ের শিক্ষিকা রুমিয়া সরকার।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মাইসা জাহান, তানজিলা আক্তার, আনীল আক্তার, তাসফিয়া, মাহাদিয়া, সুমাইয়া ও ইফা হিজাব পরে না আসার কারণে তাদের চুল কেটে নেওয়া হয় বলে জানায় তারা। ওই শিক্ষার্থীরা গভীর দুঃখবোধ নিয়ে জানাচ্ছে, ‘ম্যাডাম আমাদের চুল কেটে দিল। তাই আমরা আর স্কুলে যামু না।’

মাইসা জাহানের পিতা কহিনুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার মেয়ে অন্যায় করেছে বললেই হতো, আমরা শাসন করতাম। তাকে চুল কেটে ন্যাড়া বানিয়ে দিল। তাই আমার মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। ও আর স্কুলে যেতে চাচ্ছে না।’

এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিষয়ে সিরাজদিখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা ঘটনা জেনেছি। ইতিমধ্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। অভিযুক্ত শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখব। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বোঝাই যায়, সমস্যা আসলে শেকড়ে। পত্রিকাগুলো জানাচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানে নতুন সভাপতি আসার পর হিজাব পরিধানে এমন কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। কাজেই বিষয়টিতে কেবলমাত্র ওই শিক্ষিকার দায় খুঁজলেই হবে না। হাত দিতে হবে গোড়ায়।

শিক্ষককদেরকে কাউন্সেলিং এর আওতায় এনে শেখাতে হবে সাম্যবাদ, নৈতিকতা ও বৈশ্বিক জ্ঞান। মিশর যদি বলতে পারে হিজাব পরতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না, সেখানে আমরা কেন অমনটা বলতে পারব না?

যারা ভাবছেন হিজাব না থাকলে ন্যাড়া মাথাই ভালো, তাদের বিরুদ্ধে বরখাস্তের শাস্তি দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে না। শাস্তি দিয়ে মনুষ্যত্ব বোধ শেখানো যায়ও না। এতে বরং উগ্র ধার্মিক হয়ে ওঠবার শঙ্কা বাড়ে। নীতিশাস্ত্র শেখাতে হলে বিধিবদ্ধ তরিকা‌ দরকার। আমরা কেন আমাদের অতীত ভুলে বাড়াবাড়ি রকমের অতিরিক্ত ধার্মিক হতে চাইছি। কেন আমরা অগণন মিথ্যাচার, অসাধুতা, চুরিচামারি, অসদুপায়ে অর্থগৃধ্নু হয়ে ওঠতে চেয়েও মহাধার্মিক পরিচয় দিতে চাই। কেন আমরা এমন হিপোক্রিসি কিংবা দ্বিচারিতায় গা ভাসাই; সেটি তলিয়ে দেখতে হবে। কেন আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে কেবলমাত্র ধর্মীয় লেবাসকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি; সেটি ভাববার সময় সমাগত হয়েছে।

ওই নারী শিক্ষক ও তাঁর সভাপতিকে বুঝিয়ে দিতে হবে কোমলপ্রাণ ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত পোশাক চাপাতে গিয়ে ভড়কে দেয়ার অধিকার রাষ্ট্র তাদের দেয়নি। মাথায় একটুকরো কাপড়ের চেয়ে বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও শারীরিক সক্ষমতায় একজন শিশুর প্রকৃত ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ হয়ে ওঠবার সাধনাটা খুব জরুরি; সেই প্রতীতি আমাদের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে।

তা নাহলে মানুষ হিসেবে আমাদের মুক্তি সুদূর পরাহত। আশা করি একদিন আমরাও মিশরের মতো করে বলতে শিখবো, কোনও ছাত্রী হিজাব পরবে কী পরবে না, তা যেন তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হয়; বাবা মা, শিক্ষক, ধর্মগুরু বা পাড়া প্রতিবেশীর প্ররোচনায় নয়।

লেখক: সাংবাদিক
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শেয়ার করুন: