শরীফ বনাম শরীফা: ভাবনার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

এ্যানি হামিদ:

পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো- এতো রগরগে বিষয় নিয়ে লিখতে যেও না। ঠিক এ কথাটাই যেন গলার কাছে কাঁটার মত বিঁধলো। মনে প্রশ্ন এলো- রগরগে কেন? অত:পর বুঝলাম, এর সাথে সম্পর্কিত সেক্সুয়াল কোর্স বিষয়টি। একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সহজ অর্থে বুঝি- এ জগত সেক্স আইডেনটিটির চেয়ে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে বেশি চিন্তিত। প্রাকৃতিক হলেও সৃষ্টির শুরু থেকেই তো এ নিয়ে মানুষের (?!) কৌতুহলের শেষ নেই। আরও বেশি গোলমেলে হয়ে যায় যখন সেক্স আর জেন্ডার বুঝতে হিমশিম খায়।

আমি লেখার পথে পা বাড়ালাম। কে যেন আবার বলে উঠলো- চিলে কান নিয়ে গেছে। এই সেরেছে! কবে, কখন, কার? একদল লোক দৌড়াচ্ছে, ভীড়ের মধ্যে একজন বলে উঠলো- তা তো জানা নেই। আরেকজন অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, ওই যে নতুন কারিকুলাম। একে একে আমাকে পিছনে ফেলে সবাই এগিয়ে গেলো। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম- দু’জন মানুষ পাশে হাঁটছে। আসলে একজন। আমি নাম জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরে বললো- শরীফ। ঠিক তখনই তার শরীরের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো, উহু, আমি শরীফা।

আমি তাদের সঙ্গে গল্প করছি।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের নিজের গল্প আছে, আমার যেমন আছে, তেমনি আপনারও আছে। ‘হিজড়া কিংবা সমকামীদের অভিশপ্ত জীবন’ বলে আখ্যায়িত দেবার আমি, আপনি কে বলুন তো? তাদের পরিচয় প্রকাশের সংকট আছে, আছে জৈবিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি সকলের কাছে সহজ গ্রহণযোগ্য করা কিন্তু নিজেকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? আপনি কি পারেন আপনার যাবতীয় সুখ, দুঃখ আড়াল করে রাখতে?
চিলে কান নেয়ার মতো আপনারাও না জেনে দৌড়াচ্ছেন না তো? জেন্ডার একটা ব্যাপক বিষয়। এর মনস্তত্ত্ব আবিষ্কার অনেক গভীর। আপনার শেখা কতটুকু হলে আপনি বুঝবেন মানবাধিকার কাকে বলে? একজন মানুষ যা শিখে তা কি শুধু পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত? অবাধ ইন্টারনেট, তার আশপাশ পরিবেশ, অবাধ তথ্য ভাণ্ডার।

বিশ্বাস করুন তথ্য জানাটা অপরাধ নয়। একবার ভেবে দেখুন তো, আপনার সন্তানকে আপনি মনে করছেন তার এসব জানার দরকার নেই, আপনি কি খবর রাখেন আপনার সন্তান আপনার অজান্তে আরও কত কিছু জানে, কত কিছুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে যায়? আবার যা সে জানে তা ঠিক জানে তো? একজন হিজড়া বা সমকামী তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে সে যদি তাকে ঘেন্না করতে শিখে তাহলে সে কেমন করে বুঝবে মানুষ হওয়া কাকে বলে? যে প্রতিবাদের প্লাটফর্মে আপনারা হ্যাশট্যাগ দিচ্ছেন ভাবছেন কি একবারও যদি আপনার ঘরেই জন্ম নেয় নতুন কোনো হিজড়া বা সমকামি? তবে কি তাকে গলা টিপে হত্যা করবেন? নাকি নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন?

কে কোন জেন্ডার, থার্ড জেন্ডার, ট্রান্সজেন্ডার কিংবা এলজিবিটিকিউ; এগুলো নিয়ে পড়তে হবে সবাইকে। মন্তব্য করার আগে এসব নিয়ে পড়ুন, মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করুন। পাঠ্যবইয়ে সংশোধন প্রসঙ্গে আলোচনার সুযোগ হলে সেই বিষয়ে কথা বলুন। ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানুষের বিপক্ষে কোনো ধর্ম নয়। কোনো ধর্মকে পুঁজি করেই কোনো কিছু নয়, এই বোধটা ধারণ করা জরুরি। তথ্য, জ্ঞান, শিক্ষা, মূল্যবোধ এর মিশেল থেকে ব্যক্তিমানুষই বেছে নেবে তার অবহিত পছন্দ। সৃষ্টির রহস্য এত সহজ নয়।

অনেকেই ‘প্রমোট’ শব্দটা বলছেন। কই বছর তো কম গড়ালো না। এই যে এত এত প্রচার- চুরি করা মহাপাপ, দূর্নীতি বন্ধ করি, সদা সত্য কথা বলবো, কারো কোনো ক্ষতি করবো না, ঘুষ খাবো না, নারী ও শিশু নির্যাতন করবো না, বলাৎকার হবে না একটি ছেলে শিশু, ধর্ষণ প্রতিরোধ করি, বাল্যবিয়ে বন্ধ করি, অন্যায় প্রশ্রয় দেবো না, মানুষকে শ্রদ্ধা করি, ইত্যাদি ইত্যাদি — এসব কেন পুরোপুরি প্রমোট হয় না? ছোটোবেলা থেকে এইসব আপ্তবাক্য তো কম শিখলাম না!

এক পাঠ্যপুস্তকের শরীফ-শরীফা গল্প সমকামীদের প্রমোট করবে- এই বিষয়ে এত ভয় আপনাদের? পর্নোগ্রাফি বন্ধ করতে পেরেছেন? কিংবা কিশোর গ্যাং অথবা বৃক্ষ নিধন? জঙ্গিবাদ অথবা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ? এক পরিবেশ রক্ষায় কিংবা মানুষ হিসেবে নিজেদের দায়িত্বগুলোই তো কেউ প্রমোট করি না, গা সওয়া কত অনিয়ম! তাহলে এক শরীফা নিয়ে এতো তোলপাড় কীসের!

কে যেন আবার বলে উঠলো- সব রসাতলে গেলো! গেলোই বই’কি! বই এর পাতা ছিঁড়ে ফেলা কোন শিক্ষার মধ্যে পড়ে আমার জানা নেই, বরং বইকে তো মানুষ বুকে আগলে রাখে বলেই জেনেছি। আসলে বই এর পাতা ছেঁড়া হয়নি, ছেঁড়া হয়েছে মানবিক ভাবনার কন্ঠনালী। অন্যের পাপের বাটখারা টা রাখুন দয়া করে। আসুন সংবেদনশীল মানুষ হওয়াটা প্রমোট করি। মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার চর্চা প্রমোট করি। শিক্ষা ক্রমের উপর ঝড় না তুলে একটু শান্ত হই, বেশ কয়েকবছর আগে মাসিক নিয়ে সম্মুখে কথা বলা যেতো না, সেক্স এডুকেশন নিয়ে কথা বলা যেতো না; অথচ মানুষ দেয়াল ভাঙবেই। এটাই চিরন্তন সত্য। তাই শরীফ বা শরীফা আমাদের ভাবনার খোরাক না হোক, এইটুকু যেন বুঝি–সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।

লেখার শেষ প্রান্তে এসে বুকের ভেতর কে জানি বলে উঠলো- জাত গেলো জাত গেলো বলে, সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তা না না না..!
শরীফ কিংবা শরীফার সাথে আমার গল্প এখনো শেষ হয়নি। আমরা হাঁটছি। পেছন থেকে বেশ কয়েকজন আমাকে ছি! ছি! করে উঠলো। আমি হেসে বললাম- তোমরা দেখো নারী-পুরুষ, আমি তো দেখি শুধুই মানুষ।।

লেখক
উন্নয়নকর্মী

শেয়ার করুন: