আর কতবার মাফ চাইলে ক্ষমা করা যায় ভিসিকে?

ফারদিন ফেরদৌস:

ডেটলাইন জানুয়ারি ২০২২।
স্থান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। ডাইনিং-এ খাবারের মান যেন ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট আর হলের অবস্থা মানবেতর বস্তি। এর প্রতিকার ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চেয়ে আন্দোলনে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের চান্দি গরম হয়ে গেলে পুলিশ ডাকা হলো। হুকুম পেলে পুলিশ‌ যা করে তাই করল। রক্তাক্ত হলো বেশকিছু ছাত্রের বিপ্লবী দেহ। এবার উপাচার্যের বিরুদ্ধে লাগাতার অনশন। দাবি একটাই গোয়ার ভিসির পদত্যাগ। টনক তো নড়ে না ভিসির। ভিসির বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিল শিক্ষার্থীরা। আঁধারের মানুষ তোমাকে অন্ধকারেই মানায়।

শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সিলেটে সাধারণ ছাত্রীদের যৌক্তিক আন্দোলন ছিল, তারা হলে ভালো খাবার পাচ্ছেন না। বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে প্রশাসনের খুশি হওয়া উচিত ছিল যে, শিক্ষার্থীরা এসব বিষয় তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রশাসন তাদের পুলিশ দ্বারা নির্যাতন করেছে।

অতঃপর ১৯ জানুয়ারি থেকে ২৪ শিক্ষার্থীর আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরুর পর ২৬ জানুয়ারি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হকের মধ্যস্থতায় সরকারের আশ্বাসে কর্মসূচি শেষ হয়। এমনকি ভিসির ঘাড়ের ত্যাড়া রগ সোজা করতে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনিকে সিলেট ছুটে যেতে হয়। পুলিশের গুলি ও লাঠিপেটার ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে ২৮ দিন পর দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি দেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।

চলমান আন্দোলনের মাঝেই উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

সেখানে ভিসিকে বলতে শোনা যায়, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সহজে কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না।’

চরম নারীবিদ্বেষী ও মানবতাবিরোধী এ মন্তব্যের প্রতিবাদে ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কুশপুত্তলিকা দাহ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ পৃথক বিবৃতিতে ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে প্রতীকী অনশন এবং মধ্যরাতে মশালমিছিল করে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রীরা।

ঠেলায় পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের কাছে মোবাইল ফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন শাবি উপাচার্য। যদিও জাহাঙ্গীরনগরিয়ান সবার দাবি ছিল ভদ্রলোককে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।

এতক্ষণ যার কথা বললাম ঠিক ওই ব্যক্তিই আবার নিজেকে মিডিয়ার শিরোনামে নিয়ে আসতে পেরেছেন। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এবার বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারটাই ছিল অনেকটা ওপেন। এখানকার শিক্ষার্থীরা যা খুশি তাই করতে পারতো। বয়সের কারণে (১৮ বছর) তাদের মধ্যে কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু আমি বলেছি, সাড়ে ১০টার মধ্যে হলে ঢুকতে হবে। শিক্ষার্থীরা আমার এই নির্দেশের নাম দিয়েছে তা’লেবানি কালচার। তাদের নাম দেওয়া তা’লেবানি কালচার নিয়ে আমি খুবই গৌরবান্বিত, এটা নিয়ে থাকতে চাই। আমি ওপেন কালচার চাই না।’

ক্যাম্পাসে আয়োজিত তথ্য অধিকার বিষয়ক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

এই উপাচার্য ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, নৈতিকতাবিরোধী এবং দেশের সংবিধানের মূলনীতিকে অমান্যকারীদের অগ্রগণ্য। গতবছর ছাত্র আন্দোলনের পর থেকেই ক্যাম্পাসে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছেন। ভয়ের বাতাবরণে আটকে‌ রেখে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তাকে দমন করে চলেছেন। এইসময়ের শিক্ষার্থীরাই গণমাধ্যমকে জানাচ্ছেন, আন্দোলনের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসে একটি ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে। আন্দোলনে ও অনশনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে হয়রানি করা হচ্ছে।

গত বছর ছাত্র আন্দোলনের পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে ক্যাম্পাসে ফুল বিক্রির উদ্যোগ নেয়। বিক্রি হওয়া ফুলের টাকা ১৬ জানুয়ারি পুলিশের হামলায় আহত শিক্ষার্থীর চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়।

যে ভিসির মানবীয় বিপ্লব ও অধিকারবোধ ভালো লাগে না। যে ভিসি বিষোদগারের লক্ষ্য করে নারীদেরকে। ভালো লাগে না দেশজ সংস্কৃতি। সেই ভিসির শিকড়টা কোথায় প্রোথিত -ভালোভাবেই অনুধাবন করা যায়। এমন মানুষ তা’লেবানি কালচার নিয়ে গৌরবান্বিত হবেন -এটাই তো স্বাভাবিক।

তা’লেবান সংস্কৃতিটা কী? ধর্মীয় রাজনীতির নামে জনজীবন থেকে নারীদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে এবং লেখাপড়া ও চাকরির সামান্য সুযোগও কেড়ে নেয়া হয়েছে। আরো দুঃখজনক হলো কাম্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীদের চাকরি দিয়ে দিতে হচ্ছে পরিবারের অযোগ্য পুরুষদের।

বিশ্বসমাজের স্বীকৃতি না পাওয়া ‘ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান’-এর গ্রামীণ জনপদে দুর্ভিক্ষ লেগে আছে। নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না হিরোইনের আদি উৎস পপি চাষ! মানবীয় সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং সৃজনশীলতা বলে কিছুই রাখা হয়নি। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হাজারো‌ স্কুল। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারী ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) ড. মুহাম্মদ ওসমান বাবুরিকে বরখাস্ত করে বিএ ডিগ্রিধারী এক নেতাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হলে এর প্রতিবাদে অন্তত ৭০ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেন; যাদের মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপকও ছিলেন।

এমন এক কালচার যদি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বাস্তবায়ন করতে চান, তাঁর পক্ষেও ইনিয়ে বিনিয়ে আসলে‌ কথা বলা যায়? আমরা এতটাই নিচে নেমে যেতে পেরেছি?

আমরা প্রতিবাদ জানাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি যে মন্তব্যটি করেছিলেন, সভ্য দেশ হলে, শিক্ষকতা দূরের কথা; মানসিক বিকারগ্রস্ত তাঁকে এতদিন‌ অ্যাসাইলামেই থাকতে হতো। কিন্তু এখানে তা হয়নি। ছাগলের পরগণায় ছাগলদেরই বীর বলে বন্দনা করা হয়।

-লেখক: সাংবাদিক

শেয়ার করুন: