মুমিন আনসারি:
লিঙ্গ বৈষম্য। পরিভাষাটির যতরূপ বিভাজন ও অনুমেয় শাখা প্রশাখা আছে তার প্রত্যেকটিকে জোড়া দিলেও বৈষম্যের প্রকৃত চিত্ররূপ ফুটে ওঠে না। দৈনন্দিন সমাজ-চিত্রের প্রতিটি চিত্র যদি স্থির ফ্রেমে আবদ্ধ করা হয় তাহলে প্রতি স্থির-চিত্রেই কোনো না কোনো নারীকে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার অবস্থায় পাওয়া যাবে। চলার পথে, বাস-ট্রেনে, রিকশায়, ফুটপাতে কিংবা একেবারে সাধারণ টংয়ের দোকানেও যদি কোনো নারীর অস্তিত্ব থাকে, তবে সাথে সাথে উপস্থিত পুরুষের আচরণে উদ্ভট ধরনের পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, নারীটা এইসব এলাকায় অনেকটা অবাঞ্ছিত। তাদের জন্য স্রেফ চারটা দেয়ালে ঘেরা কুঠুরি ছাড়া যেন আমরা এখনও কোনো নিশ্চিন্ত পৃথিবীর সন্ধান দিতে পারিনি। এ প্লাস, গোল্ডেন থেকে শুরু করে স্ট্যান্ড করা বা নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোভাবও এখনও পরিবর্তিত হয়নি।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন – “একজন পুরুষকে শিক্ষিত করা মানে একজন মানুষকে শিক্ষিত করা, কিন্তু একজন নারীকে শিক্ষিত করা মানে গোটা সমাজকে শিক্ষিত করা।” এই শিক্ষার ক্ষেত্র কি এখনও নারীদের জন্য স্বাস্থ্যকর করতে পেরেছি? পরিবেশটাতে সাম্যবাদের ধ্বনি আওড়াতে পেরেছি? নারীকে স্রেফ মানুষ হিসেবে বিচার করাতে পেরেছি?
নাহ। আমরা পারিনি। আমরা এখনও ব্যর্থ। আমাদের পৃথিবী ও চারিপাশ নারীদের জন্য এখনও মুক্ত-স্বাধীন হয়নি। নারীদের ব্যাপারে ‘কিছু মাংসপিণ্ড’-এই অস্তিত্ব, পুরুষ-মস্তিষ্ক থেকে এই ধারণা এখনও দূর হয়নি। এখনও নারীদের জন্য সুস্থ-স্বাধীন সমাজ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। পুরো দেশ নাহয় বাদ দেই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেখানে সর্বোচ্চ শিক্ষার এতো আয়োজন, সেখানে এখনও একদল হায়েনার ছড়াছড়ি। যাদের জিহ্বায় শুধু নারী শব্দটাই যথেষ্ট কামনার রস নির্গত করে। এরা মানসিকভাবে অসুস্থতাকে ছাড়িয়ে গেছে।
একটা সাম্প্রতিক ঘটনার আবর্তন না করলেই নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সংবাদকর্মী নিয়ে ঘটনাটি ঘটেছে। নাম মারজান আকতার। সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে শহীদ মিনার এলাকায় ১০/১২ জন ‘পুরুষ’ (রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য নয়) তাকে ঘিরে ধরে। বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দেয়। এটুকু পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। সাংবাদিকতা একটা সাহসী পেশা। এখানে হুমকি ধমকি, মারধর বা মামলা -হামলা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একটা ভিডিওতে দেখলাম মেয়েটার হাত ধরে টানাটানি করছে, হেনস্থা করছে আর গায়ে হাত দিচ্ছে। বুঝলাম, সাংবাদিকতার কারণে তাদের স্বার্থ আহত হচ্ছে বলেই মারজানের ওপর এই হামলা। কিন্তু তাদের মাঝে লোলুপতা সৃষ্টি হলো কেন? তারা এক নিমিষেই ভুলে গেলো কেন যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাধারী ও প্রগতিশীল (!)শিক্ষার্থী? হুট করেই তারা ১০/১২ জন হায়েনার মতো আচরণ কেন করলো? নিমিষেই তারা কেন ভুলে গেলো ‘ওরাও মানুষ’?
কারণ তাদের মননে ও মানসে লিঙ্গ বৈষম্য ও লৈঙ্গিক সমতার বিষয়গুলো দাগ কাটেনি। প্রগতিশীলতার কথা বললেও তাদের মগজে নারীর ব্যাপারে আদিম উদ্দামতা আর প্রজননের যন্ত্র ব্যাতিত অন্যকোনো ধারণা প্রতিষ্ঠিত নেই। নারীদের নিজেদের সমকক্ষ মনে করে না। বরং নিজেদের অধীন মনে করে। যার ফলে লৈঙ্গিক সমতার ক্ষেত্র বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এই ব্যাপারে রজার লিমন’র বক্তব্যকে যথার্থ মনে হয়েছে। তিনি বলেন -লৈঙ্গিক সমতা বলতে কোনও ব্যক্তির লিঙ্গ (নাবালক ছেলে বা মেয়ে এবং সাবালক পুরুষ কিংবা নারী) নির্বিশেষে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পদ, সুযোগ ও সুরক্ষা লাভ করা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে সমান অধিকারকে বোঝায়। এখানে লিমন মোটাদাগে পাঁচটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এই পাঁচটি ক্ষেত্রই এখনও আহত। আমরা এখনো সমতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি।
জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়নের যে ১৭টি লক্ষ্য স্থির করেছে, তাতে লৈঙ্গিক সমতাকে পঞ্চম স্থান দেওয়া হয়েছে। যে মৌলিক লক্ষ্যগুলোকে জাতিসংঘ সমস্যা বলে বিবেচনা করেছে তার মধ্যে লৈঙ্গিক সমতাও রয়েছে। এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯ এর ৩ ধারায় লৈঙ্গিক সমতার ব্যাপারে বলেছে, “জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।”
স্পষ্টতঃ এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র তার সাধারণ জনগণের মাঝে সমতার বিধান করবেন। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র এখনও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কিছুমাত্র আইন করেই নিজেদের দায়মুক্ত করেছেন। আর নির্বাচন এলে “বৈষম্য দূরীকরণ ও সমতা প্রতিষ্ঠা”র ব্যাপারটা ভোট আদায়ের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। নেতাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। গণমাধ্যমে ও জনসভার মাঠে জোর গলায় এসব বলে বলে ভোট আদায়ের চেষ্টা করা হয়। অথচ সমাজে বৈষম্যের মুক্তি না মেলা পর্যন্ত আন্দোলন জারি রাখা উচিত।
তাই নারীমুক্তির এই আন্দোলনে অন্য কারও উপর নির্ভর না করে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীকেই বুঝে নিতে হবে তাদের অবস্থান।
মুমিন আনসারি
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সহ-সভাপতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।