রেজভিনা পারভীন:
ছোটবেলায় বাসায় অতিথি আসলেই প্রশ্ন করতো, কে তোমাকে বেশি ভালবাসে ‘বাবা’ না ‘মা’? ছোট্ট শিশুমন তখন বিপাকে পড়ে যেত কার কথা বলবে, বাবা না মা? তখন শিশুমন নিজেই উত্তর দিত, ‘দুজনেই’ তখন আবার প্রশ্ন করতো অতিথিরা ‘কে বেশি বলো. বলো ’?? এভাবে চাপাচাপি করে বাবা না মা এর প্রতি ভালবাসা পরিমাপ করার কিছু প্রয়োজন আছে কি? সন্তানের কাছে তার মা –বাবা দুজনই সমান! তাদের ভালবাসাকে তুলনা করার কিছু নেই!
সবকিছু কেমন যেন চাপাচাপি সংস্কৃতি হয়ে গেছে! মা দিবসে মাকে ভালবাসি বলতেই হবে! বাবা দিবসে বাবাকে ভালবাসি বলতেই হবে, বন্ধু দিবসে বন্ধুত্বের জয়গান গাইতেই হবে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ছবি আপলোড করেই সম্পর্কের দায়িত্ব শেষ।
আমার বিশেষ দিবস নিয়ে আপত্তি /দ্বিমত কোনটাই নেই! ভাবনাটা হলো পশ্চিমা বিশ্ব আর বাজার অর্থনীতির যুগে ভালবাসাটাও কেমন যেন চাপের মধ্যে পড়ে গেছে! এই একদিন যেভাবেই হোক ভালবাসা প্রকাশ করে ফেলতে হবে। বাকিসবদিন চুলোয় যাক। কেক , কার্ড, ছবি আঁকা, শাড়ি কত কী মায়েদের জন্য কিনছি, বানাচ্ছি। সব আয়োজন একদিনের জন্য। আমার এক বন্ধু খুব সুন্দর এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন, “আজকে মা পুজা ,কালকে কি বিসর্জন?” আমরা কি আমাদের সন্তানদেরকে একদিনের ভালবাসায় অভ্যস্ত করছি? ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখেছিলাম, অনেকেই দেখেছেন হয়তো – মা সারাদিন ঘরের কাজ করছে, ছেলে কম্পিউটারে চ্যাটিং এ ব্যস্ত, মা একসময় একটা ভারি কাজ করতে পারছিলেন না, তাই ছেলের কাছে সাহায্য চাইলে ছেলে বলে দিল, পারবো না ব্যস্ত! চ্যাটিং এর এক পর্যায়ে ছেলের মনে হলো, আজ মা দিবস, তখন সে দৌড়ে মার কাছে গেল, আমি ভাবছিলাম ছেলেটি স্যরি বলার জন্য গিয়েছে, ভাবলাম যাক একদিনের জন্য হলেও তো স্যরি বলবে, কিন্তু ঘটলো অন্য কিছু; ছেলেটি মোবাইল বের করে মাকে ঘর মোছা থেকে তুলে এনে সেলফি তুললো, মা ক্লান্তিতে হাসতে পারছিলেন না তাই মাকে জোর করে হাসতে বাধ্য করলো। কারণ ফেসবুকে মায়ের সাথে হাসি মুখের সেলফি না দিলে বন্ধুরা কী মনে করবে? মায়ের হাসি মুখ ও আজকাল আমাদের চাপের মুখে পড়ে গেছে।
কিন্তু মা ঐ একদিনের ভালবাসার কাঙাল নয় সে সবসময় ৩৬৫ দিনের ভালবাসার কাঙাল !
আমার পরিচিত আনেকেই আছেন যারা মায়ের প্রতি দায়িত্ব বলতে যা বোঝায় তার সিকিআনা পালন করেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু ফেসবুক এ টাচি বক্তব্য আর ছবি দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। অবশ্য মা দিবস ছিল বলে এই একদিন অন্তত তারা মাকে যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছে এটাই বা কম কীসে?
মাকে ভালবাসলে মা এর ৩৬৫ দিনের ভাল থাকার বিষয়টি বিবেচনা করুন। বৃদ্ধ বয়সে মাকে নিজের প্রয়োজনে টানাটানি না করে, মা কোথায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেরকম জায়গায় থাকতে দিন, মাকে তার প্রিয় বিছানায় ঘুমাতে দিন, মা আপনার কোনো ব্যবহারে কষ্ট পান সেটি অনুধাবন করুন, বৃদ্ধ বয়সে মা- বাবাকে ভাগাভাগি না করে একসাথে রাখুন, মা কেমন আদর্শ সন্তান পছন্দ করেন, তেমন সন্তান হওয়ার চেষ্টা করুন;
রেজভিনা পারভীন
নৃবিজ্ঞানী
উন্নয়নকর্মী