প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা:
লকডাউনের দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা আমি ফিল করেছি, সেটা আমার ছোটমেয়েকে নিয়ে। মার্চে মেয়েটার বয়স চার বছর হলো। এখনও হাত দিয়ে ভাত খেতে পারে না। আবার যখন অফিসে যাওয়া শুরু করবো, তখন সে বলতে গেলে না খেয়েই থাকবে। আমি আর বর অফিসে গেলে বাসায় তিন বাচ্চা আর আমার বাবা থাকেন। আমার বাবার বয়স বাহাত্তর বছরের বেশি। আমি সকালে সবার জন্য দুপুরের খাবার রান্না করে রেখে যাই। সবাই যার যার মতো নিয়ে খায়, কিন্তু আমার ছোট্ট বাবুটা যেহেতু হাত দিয়ে খেতে পারে না, আর অন্য কারো হাতে খেতে চায় না আমি আর বাবুর বাবা ছাড়া, প্রায়ই দিনই সে না খেয়ে থাকে। সন্ধ্যায় আমি বা বাবুর বাবা বাসায় আসলে তখন খাইয়ে দেই।
আমরা বাচ্চাদের আত্মনির্ভরশীল হতে শেখাই না। আদরের অতিশায্যে নিজেদের অজান্তেই পরনির্ভরশীল বানাই। ব্যাপারটা শুরু হয় জন্মের পর থেকেই। ছেলে বাচ্চা হলে আমরা তাকে গাড়ি বা বল কিনে দেই, মেয়ে বাচ্চা হলে পুতুল বা হাড়ি-পাতিল। একটা কথা প্রায়ই শুনি, মেয়েদের জন্য “টিচিং প্রফেশন” টা বেস্ট, কেননা এতে রিস্ক নাই, ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অনেক রিস্ক। তরকারি রান্নাতেও রিস্ক নাই, মাস্টারিতে রিস্ক নাই, আমি অবাক হই ভেবে। একটা তরকারি রান্নাতে কতটুকু হলুদ/মরিচ/লবণের মতো বড় একটা হিসাব যে মেয়েটা করতে পারে, সে কেন ডেবিট-ক্রেডিটের হিসাব করতে পারবে না!
বলছিলাম নির্ভরশীলতা নিয়ে। ছেলের সাথে সাথে যদি মেয়েটাকে দিয়েও বাজার করানোর অভ্যাস করানো হয়, অথবা ছেলেটাকে দিয়ে যদি ঘর গোছানোর কাজটা করানো হয়, তাহলে মেয়েটা/ছেলেটা পারবে না কেন? মেয়ে/ছেলেকে কেন আত্মনির্ভরশীল বানানো হয় না, আমি বুঝতে পারি না। আমি নিজে এখনও বাজারে যেতে লজ্জা পাই, দামাদামি করতে লজ্জা পাই, বেশি দাম দিয়ে নিয়ে এসে বরের বকা খাই।
আমি যখন রান্নার জোগাড় করতে বসি, আমার পিচ্চি মেয়ে এসে আবদার করে, “আমিও কাটবো, মা”। আলু আর ছিলার মেশিন দিয়েছি তাকে আলু ছিলার জন্য। পিচ্চির বাপ দৌড়ে আসছে, মেয়ের হাত কেটে যাবে বলে। আমার মা হওয়ার উপরে প্রশ্ন উঠে গেছে। মেয়ের হাত কেটেও গেছে। দুইদিন আসে নাই আর আলু ছিলার জন্য। কিন্তু দুইদিন পর সে আবার আসছে আলু ছিলতে। এখন আমি তাকে দিয়ে আলু, পটল, শসা ছিলাতে পারি। এবং খুব সুন্দর করে সে এগুলো ছিলে দেয়। সে যখন সবজি ছিলে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। আর পিচ্চির বাবা, আমার বর তার বড় মেয়েকে গালাগালি করে, কারণ সে রেস্পন্সিবিলিটি নিয়ে কোন কাজ করে না। কীভাবে করবে, আমরা তাকে শিখাই-ই নাই। আর ছেলের কথা নাই বললাম। একদিন ছেলেকে শাস্তিস্বরূপ থালা বাসন ধুইতে বলা হয়েছিল। তার কান্নাকাটি মরা কান্নাকেও হার মানিয়েছে।
আমার এক কলিগ, তার গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করার জন্য ইউকে গিয়েছিল। তার বর্ণনা অনুযায়ী সেখানে তার নিজের রান্না, নিজের কাপড়, নিজের ঘর পরিষ্কার নিজেকেই করতে হয়েছে। এবং সে রাতভর কান্না করতো এসব কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে। বাংলাদেশ থাকাকালীন তার মা তাকে লিচু ছিলে বক্সে ভরে দিতো, টিফিন হিসেবে। আমার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু বলছিল “সে যখন ঘরের কাজ করে যেমন ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, থালা বাসন ধোয়া, এসব করে বন্ধুর মা বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে, আহারে আমার ছেলেটা।”
আমার বড় মেয়েকে বাসার সামনের দোকানে যেতে বললে সে এমন ভাব করে যেন মাটি কাটাও এর চেয়ে সহজ কাজ, কারণ আমরা তাকে শিখাই নাই। ছেলে বা মেয়েরা মাকে বা বাবাকে কাজে সাহায্য করবে, এটা অনেকটা বাবার ব্যবসা ছেলে বা মেয়ে চালানোর মতো। এজন্যই অফিস শেষে বাসায় এসে যখন বউ রান্না ঘরে ঢোকে, আর বর টিভি খুলে চায়ের অর্ডার দেয়, কেওয়াজ লাগে।
আমরা বৃদ্ধ বয়সে মেয়ের সংসারে থাকতে লজ্জা পাই, কিন্তু ছেলের সংসারে থাকতে লজ্জা পাই না। আমরা নিজের ছেলেমেয়েদের কাছে সেবা আশা করি না, আশা করি অন্যবাড়ির একটা মেয়ে এসে আমাদের সেবা করবে! আমি আমার নিজের বাবাকে, “আজ যদি একটা ছেলে থাকতো!” দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে দেখেছি। অথচ আমার বর অনেক সময় ভাত বেড়ে তার সামনে দেয়, রান্না করে তার জন্য আলাদা করে উঠিয়ে রাখে। নিজের মা/বাবা কিংবা ভাইবোনের সাথে ঝগড়া মেনে নিতে পারি, তাদের গালাগাল সহ্য করতে পারি, কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি যদি একটু কটু কথা শোনায় সেটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না। নিজের মা বললে ওড়না গলায় টেনে নিতে পারি, শাশুড়ি বললে মাথায় ঘোমটা দিতে পারি না। আমরা বৃদ্ধবয়সে বৃদ্ধাশ্রমে কাটানো মানতে পারি না, অথচ জোয়ান বয়সে বন্ধুদের মিস করি, ছোটবেলায় ফিরে যেতে চাই। জীবন কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় ফিয়ে যাওয়ার সুযোগ ঠিকই করে দেয়।
আমরা মেয়েকে রাজকন্যার মতো করে বড় করি, কিন্তু বিয়ের পর বরের মাইর খেয়েও সংসার করতে বাধ্য করি, তাতে মরে যাক না কেন, তারপরও সেই সংসার থেকে বের হয়ে আসা শেখাই না!
আমরা ছেলেকে রাজার মতো করে বড় করি কিন্তু মা’কে/বাবা’কে সকালে এককাপ চা বানিয়ে খাওয়াবে সেটা শেখাই না। এমনকি নিজে চা বানিয়ে খাবে সেটাও শেখাই না। বিয়ের আগে বাপ মা আর বিয়ের পর বউয়ের উপর ডিপেন্ড করে বাঁচতে শেখাই। আমরা আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে শিক্ষিত বানাই, কিন্তু স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত বানাই না। অন্য সবাইকে ভালোবাসতে হয় শেখাই, নিজেকেও যে ভালোবাসতে হয়, শেখাই না। আজব এক জাতি আমরা।
আহা জীবন, আহারে জীবন,
জলে ভাসা পদ্ম যেমন।।।
প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা
ব্যাংকার