নারী আসলে কীসে আটকায়?

প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা:

নারী আসলে কীসে আটকায়?

জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতায়!

বিল গেটসের টাকায়!

হুমায়ুন ফরিদীর ভালোবাসায়!

তাহসানের কণ্ঠে কিংবা হৃতিক রোশানের স্মার্টনেসে!

এসবের কোনকিছুই তো নারীকে আটকাতে পারে নাই। তবে?

আমার যখন বিয়ে হয় বয়স কেবল ১৯ ছুঁয়েছে। টগবগে যৌবন নিয়ে ছুটে চলি কলেজে, কোচিং এ, বান্ধবীদের আড্ডায়। জীবন সুন্দর। টাকা-পয়সা, ফ্যামিলি, প্রেম.. কোন দায়িত্ব নাই। বাপি-মামনি খুব ভালোভাবে একটা কথাই মাথায় ঢুকিয়েছিলো, এমন ছেলের সাথে প্রেম করা যাবে না, যে ছেলে “শিক্ষিত” না। অন্তত সার্টিফিকেট কর্তৃক ঘোষিত শিক্ষিত। তো, এই চিন্তায় আসলে প্রেম করা হয়ে ওঠেনি। বাপি বলতেন, “ছেলে শিক্ষিত হলে, বেকার হলেও তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবো! বাড়ি-গাড়ি, জমি-জমা না হলেও চলবে। তাছাড়া মেয়েকেও পড়াশোনা করাচ্ছি, দুজনে মিলে ঠিকই জীবন চালিয়ে নিবে।” অন্যদিকে ঢাকাতে বড় হওয়ার সুবাদে হিন্দু ছেলের বড়ই অভাব ছিল চারপাশে। দুই’একজন যা ছিলো, তাদের কারো সাথেই জমেনি কখনো।

যাইহোক, হঠাৎই জানতে পারলাম আমার বাপি-মামনি স্বপ্নের রাজকুমার পাওয়া গেছে, যে তাদের মেয়েকে সুখে রাখতে পারবে।সেই রাজকুমারকে আমারও ভালো লেগেছে প্রথম দেখাতেই। দেখতে বেশ সুন্দর, সুন্দর হাসি, ব্যাংকে চাকরি করে। নির্ঝঞ্ঝাট, আর কী চাই? ছেলের কিছু চাহিদাও নেই, এক্কেবারে সোনায় সোহাগা। আর আমি? যেহেতু জীবনে হালকা-পাতলা প্রেমও হয়নি, তো রাজকুমারকে অপছন্দ হওয়ার কারণও ছিলো না…. ঝাঁপ দিয়ে দিলাম সমুদ্রে। সংসার নামক সমুদ্রে।

দীর্ঘ ১৭ বছরের সংসারের পর বুঝলাম, অনেক হয়েছে সংসার সংসার খেলা, এবার ক্ষেমা দেয়ার পালা! কারণ আরও অর্ধ যুগ আগেই আমি আসলে সেই রাজকুমারকে ছেড়ে দিয়েছিলাম মানসিক ভাবে। কেন?

একটা ছেলে বাচ্চা জন্ম নেয়ার পর থেকেই তার মাথায় ঢুকানো হয় তাকে দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবারের, সংসারের, গার্লফ্রেন্ডের, বন্ধুদের, বোনের, সমাজের। এতো এতো দায়িত্বের ভিড়ে নিজের মনের যত্ন নেয়ার কথা তাদের শেখানো হয় না।তাদের শেখানো হয় তুমি কর্তা, তোমার মনের মতো করেই সব চলবে, তুমি কারো মনের মতো করে চলবে না, তাহলে তুমি “পুরুষ” হতে পারবে না! ভালোবাসলেও সেটা প্রকাশ করবে না, কষ্ট পেলেও কান্না করবে না, আঘাত পেলেও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করবে, কারণ তুমি পুরুষ (!)। অন্যদিকে একটা মেয়ে বাচ্চা জন্ম নেয়ার সাথে সাথে তাকে শেখানো হয় “তোমাকে সহ্য করতে হবে যেকোনো কিছু, ভালো লাগুক বা না লাগুক। কর্তার ইচ্ছায়ই কর্ম। তোমার বাসার পুরুষের পছন্দমতো তোমাকে চলতে হবে, তোমার ভালো লাগুক বা না লাগুক।”

আমার বড় মেয়ের নাচ শেখার খুব ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু তার বাবার “ইচ্ছে” হলো মেয়েকে গান শেখাবে, ফলাফল শূন্য। কোনটাই হলো না। যেহেতু আমি তখনও বেকার, সুতরাং আমার আসলে জোর করে বলার ক্ষমতা ছিলো না। মা-মেয়ে কারোরই মনের ইচ্ছা পূরণ হলো না। বাইশ বা তেইশ বছর বয়সী মা, লেখাপড়ার প্রেশার, বাচ্চার প্রেশার, শরীরের চাপ, সংসারের চাপ, সব সহ্য করতে করতে একসময় ভুলেই গেলাম আমার রাত-বিরাতে রিকশায় ঘোরার খুব ইচ্ছে ছিলো। স্বামীর হাতের আঙ্গুলের মধ্যে আঙ্গুল আটকে, সিনেমা হলে অন্ধকারে বেশ গভীর চুমু খেতে, রাস্তার পাশের ফুচকার দোকানের ফুচকা খেতে, রিকশায় বৃষ্টিতে ভিজতে, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে, হুট করে অল্প বাজেটে ট্যুর দিতে।

খুব আশা করতাম, জন্মদিনে কয়েকগোছা বেলিফুলের মালা কিংবা চুড়ি কিংবা একটা সুতির শাড়ি বা থ্রিপিস নিয়ে স্বামী সারপ্রাইজ দিবে। একসময় মেনেই নিলাম ওসব আসলে নাটক সিনেমাতেই হয়। খুব সিলি ব্যাপার, তাই না? এইজন্য কি কেউ কাউকে ছেড়ে যায়?? আচ্ছা বলেন তো, স্বামী কিংবা বাচ্চা অসুস্থ হলে যদি এইটা আশা করেন রাত জেগে তাদের সেবা করবে, তাহলে নারীরা এই সিলি ব্যাপারগুলো কেন আশা করতে পারবে না? কারণ আমরা “মন” নামক বস্তুটাকে বেমালুম ইগ্নোর করে যাই। আমরা আসলে শরীরটাকে এতো বেশি ফোকাস করি, মনের কথা “মনেই” থাকে না। মনের অসুখের কথা আমরা সব-সময়ই বেমালুম ইগ্নোর করে যাই।

আমার এতোটুকু জীবনে একজন মাত্র ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি “ও আমার একমাত্র সম্পদ, চলে গেলে আমি একদম নি:স্ব হয়ে যাবো।” অন্য পুরুষদের মতো কখনও আমরা শুনিনি তার স্ত্রীর বদনাম, কতোটা অযোগ্য তার স্ত্রী তার তুলনায়, কতোটা ক্যাটক্যাট করে তার স্ত্রী তার সাথে! একজন সত্যিকারের পুরুষ জানে নিজের স্ত্রীকে সম্মান করতে এবং অন্যদের কাছে সম্মানিত করতে। যেসব পুরুষরা ভাবেন, অন্যদের কাছে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা যায়, তারা কি নিজেদের সম্মানিত করছেন?

আমি একসময় কিছু বলার আগে চিন্তা করতাম এই কথাটা বললে আমার স্বামী কষ্ট পাবেন নাতো, তাকে অপমান করা হবে নাতো, তাকে অন্যদের সামনে ছোট করা হবে না তো? কিন্তু এখন আর আমি সেটা ভাবি না! কারণ তাকে কষ্ট দিয়ে কথা বললে আমার নিজের মনে জমানো কষ্ট লাঘব হয়, যে কষ্ট তিলে তিলে তিনি আমার ভিতর গড়েছেন। এমন না যে, আমাদের টাকার অভাব আছে, আমাকে উনি ভালোবাসতেন না! অভাব ছিলো আচরণে। আমাকে উনি সম্মান করেন না। আমার স্বামীর ধারণা আমি ওনাকে ছাড়া অচল। আদতে ওনাকে ছাড়া আমি অচল নই, অপরিপূর্ণ। উনি আমাকে যেটুকু ভালোবাসা দিয়েছেন, হয়তো অন্য কেউ আমাকে অতটুকু ভালবাসা দিতে পারবে না। কিন্তু কেউ যদি আমাকে আমার প্রাপ্য সম্মান দেয়, বিশ্বাস করে, আমাকে পেয়ে গর্ববোধ করে, তাকে আমি আমার সবটুকু উজাড় করেই ভালোবাসবো।

নারী… ভালোবাসা, টাকা, ক্ষমতা, সৌন্দর্য কোনকিছুতে আটকায় না। খুব কথিত আছে, “কোন নারী যদি টাকা উপার্জন করে তাহলে সে ভাবে তার জীবনে পুরুষের দরকার নেই”। খুব বিশ্রী রকমের বাজে একটা কথা প্রচার করা হয়েছে। নারী-পুরুষ একটা কয়েনের এপিঠ-ওপিঠ। একজন অন্যজনকে ছাড়া একেবারেই অসম্পূর্ণ। কিন্তু নিজে সম্পূর্ণ হতে হলে যেমন অন্যজনের যত্ন করতে হবে, তেমনি নিজে সম্পূর্ণ হতে হলে আগে নিজেকে ভালোবাসতে হবে। যে মানুষ নিজেকে ভালোবাসে না সে কীভাবে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে? রামকে ভালোবেসে সীতাদেবী রাজপ্রাসাদ ছাড়লেও, অবিশ্বাসের তীরটা তার দিকেই ছোঁড়া হয়েছিলো।

আচ্ছা আমি যদি আমার স্বামীকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসি সমাজ কি সেটা মেনে নেবে? আমি তো আমার স্বামীর কাছে মানসিক শান্তি পাচ্ছি না, এমনকি তার স্পর্শও আমাকে আর টানে না। শুধুমাত্র বাচ্চাদের মা আমি, এইজন্যই শুধু বাকি জীবন আমি এই শাস্তি মাথায় নিয়ে চলবো? কী করা উচিৎ আমার? আমি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী, যদি ডিভোর্স দিতে চাই তাহলে তো বলবেন “নারী, টাকা, ক্ষমতা, ভালোবাসা, কণ্ঠে, স্মার্টনেস কিছুতেই আটকায় না, তাহলে কীসে আটকায়?” একবারও আপনারা “সম্মান-বিশ্বাস” শব্দগুলো মনে করার প্রয়োজনবোধ করেননি।

নারী আটকায় সম্মানে-বিশ্বাসে-ভালোবাসায়-যত্নে, সর্বোপরি সবকিছুর সংমিশ্রণে।

দুটো মানুষ যখন একসাথে থেকে মানসিক শান্তি পাচ্ছে না, তাহলে এটাও নিশ্চিত যে তারা শারীরিক শান্তিও পাচ্ছে না। এরকম একটা সম্পর্ককে জিইয়ে রাখার কোনো মানে নেই। সব নারীরাই ভালো আর সব পুরুষই খারাপ বিষয়টা এরকম নয়, যে আপনাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারে তাকে ভালো থাকতে দেয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। যে ভালো রাখতে জানে, শতকিছুর পরেও তার কাছেই আটকে থাকবে। সিম্পল।

লেখক: ব্যাংকার

০৫.০৮.২০২৩

শেয়ার করুন: