ভূমিহীন মোহছেনার ভূমি জয়ের গল্প

নাছিমা মুন্নি:

মোহছেনার জীবনের গল্প শুরু হয়েছিল সেই দুই বছর বয়সে। আজও মোহছেনা গল্পের মূলকেন্দ্রে থেকে গল্পের ছাপ রেখে যান তার চারপাশে। আলো ছড়ান। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ বা লড়াইয়ে সবার সামনেই দেখা যায় তাঁকে। হাতের কাছেই যেন বোরকা থাকে। বোরকা পরে সাথে দু’একজন সঙ্গী নিয়ে ছুটে যান অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজও।

মোহছেনার গল্পের শুরু যেখান থেকে-

মোহছেনা দিনে ঘর তৈরি করলে রাতে জোরদাররা ঘর ভেঙে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিতো। মেঘনা নদী থেকে চর জেগে ওঠার পর দরিদ্র দিশেহারা আশাহত নারীদের মতো মোহছেনাও মাথা গোঁজার আশায় এই চরকেই নিজের আবাসস্থল মনে করে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই চরকে দরিদ্র মানুষেরই সম্পদ মনে করে মোহছেনা। প্রথমে নিজের হাতে ঢোলকলমি দিয়ে এক রুমের ঘর তৈরি করে সেখানে। ঘরের চারপাশে নিজে মাটি কেটে ভরাট করে। বনজঙ্গল পরিষ্কার করে। নারীরা মাটি কাটে, নারীরা নিজের ঘর নিজ হাতে তৈরি করে বলে এই সমাজে নারীদের কেউ দেখতে পারতো না তখন। কথা বলতো না কেউ। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে এসব কাজ করতে হয়েছে মোহছেনাকে। কিন্তু মোহছেনা নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে লজ্জা বা অপমান মনে করেনি কখনও। এখনও ষাট বছর বয়সে নিজের হাতে ফসল ফলায়। নিজের হাতেই সব কাজ করে। নিজের উৎপাদিত পণ্য নিজে বাজারে এনে বিক্রি করে।

মোহছেনারা সাত ভাইবোন ছিল। মোহছেনার দুই বছর বয়সে বাবা মারা যায়। শুরু হয় খাবারের কষ্ট। বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে খাবারের জোগাড় করতে হতো তখন। দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় মোহছেনার। শ্বশুর বাড়িতে মারপিট করতো গরিবের মেয়ে বলে। যৌতুকের জন্য চাপ দিতো তারা। খাবার দিতো না মোহছেনাকে। মারপিট সহ্য করতে না পেরে সাত- আট বছর পর শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের পাংখার বাজারে। একটা বাড়ি পাহার দেয়। কিন্তু খাবারের জোগাড় করাই তখন দুঃসাধ্যই হয়ে ওঠে।

এরমধ্যে পাংখার বাজার এলাকায় চর ডেভেলপমেন্ট স্যাটেলমেন্ট প্রজেক্ট – সিডিএসপি এর কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয় হয় মোহছেনার। তারা মোহছেনার থাকা ও খাওয়ার দুর্দশা দেখে তাকে জমি, ঘর ও জমির খতিয়ান দেওয়ার আশ্বাস দেন। জোরদাররা বিষয়টি জেনে যায়। তখন নদী থেকে জেগে ওঠা চর জোতদারদের দখলে ছিল। শুরু হয় মোহছেনার জোতদারদের সাথে লড়াই। প্রতিদিন রাতে জোতদাররা অগণিত মোটর সাইকেল নিয়ে মোহছেনাকে মেরে ফেলার জন্য মোহছেনার বাড়ি ঘিরে ফেলতো। জোতদারদের হাতে থাকতো নানান অস্ত্র। মোহছেনা প্রতি রাতে পালিয়ে যেত তিন সন্তানকে ঘরে রেখে। আবার আলো ফুটলে সকাল হলে বাড়ি ফিরে আসতো। মোহছেনাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করতো মোহছেনার মতো ভূমিহীন নারীরা।

সেসময়ে এই সমাজের পুকুরগুলো ছিল জোতদারদের দখলে। জোরদাররা পুকুর ব্যবহার করতে দিত না কাউকে। জোতদাররা পুকুরের পানিতে নখও চুবাতে দিত না মোহছেনাদের। তখন মোহছেনার সন্তানেরা দিনের পর দিন খাবার পায় না। পরার কাপড় ছিল না। গোসল করতে পারতো না দিনের পর দিন। যেখানে দিনে এক কেজি চাল প্রয়োজন ছিল, সেখানে এক পোয়া চাল জোগাড় করা কঠিন ছিল মোহছেনার। আর সাথে বনজঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা তরকারি, কচুর শাক, এলাচার শাক থাকতো।

সিডিএসপি স্থানীয় জোতদারদের পুকুর সেচ করে মাটি কাটার ব্যবস্থা করে। সেখানেও জোতদারদরা বাঁধা দেয়। জোতদারদের সাথে মোহছেনার হাতাহাতি হয়। প্রতিদিন এমন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয় মোহছেনাকে। এক পর্যায়ে মোহছেনার এই লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হয় ভূমিহীন আট নয় জন নারী পুরুষ। তারা মোহছেনার লড়াইয়ের সাথে হাত মেলায় তারা। তারা সবাই মাটি কেটে ঘর ভিটা তৈরি করে। ২৫ টি পরিবার ঘর তৈরি করে তখন। পুলিশ ও স্থানীয় চেয়ারম্যান সেই ঘর উচ্ছেদ করতে আসে। পুলিশকে বাধা দেয় মোহছেনা ও তার সহযোগীরা।

এরপর ধান চাষ করার জন্য জমির আইল বাঁধে সবাই মিলে। ধান চাষ করে। ধান কেটে মাথায় করে বোঝা বয়ে নিয়ে এসে পঁচিশ জনে ভাগ করে নেয়। জোতদার খড়ের চিনে আগুন লাগিয়ে দেয়। জোতদার পুলিশ এনে মোহছেনাদের হয়রান করতে থাকে। ধানের ভাগ চাইতো জোতদাররা। মোহছেনাকে দিনের পর দিন লুকিয়ে থাকতে হতো। সবাই তাকে লুকিয়ে থাকতে সহযোগিতা করতো। কারণ সবাই মোহছেনার সাহসের ওপর ভরসা করতে পারে। তাই মোহছেনাকে কোনোভাবে ধরতে পারলে সবার সাহস শেষ হবে। কিন্তু মোহছেনা সবার সাহসের প্রতীক হয়েই থাকলো।

একদিন মোহছেনাসহ সবাইকে চেয়ারম্যান কোর্টে ডেকে নেওয়া হয়। সবাইকে ছেড়ে দিলেও মোহছেনাকে আটকে রেখে দেয়। পরে মোহছেনাকে বিভিন্ন মুছলেকা দিয়ে ছেড়ে দিলেও দুই বছর চেয়ারম্যান কোর্টে হাজিরা দিতে হয় মোহছেনাকে।

শুরু হয় আরো চ্যালেঞ্জ। যে জমি সিডিএসপি বন্দোবস্ত দেয় সে জমিতে চাষ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করার চ্যালেঞ্জ। শুরু হয় লবনাক্ত জমিতে ধান, ডাল, সয়াবিন বাদাম, মরিচ, শাকসবজি চাষ করা। মহাজন থেকে টাকা নেয় জমির ফসলের ওপর। ফসল তুলে নিজের খাবারের জন্য রেখে আর বিক্রি করে ধার শোধ হতো না। কেউ কেউ তখন জমি বিক্রি করে দিতো। তাই আরেকজনের জমিতে বদলা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা।

আর মোহছেনা নিজের জমিতে নিজের হাতে চাষবাস করতো। শীতকালে ঠাণ্ডায় মাঠে কাজ করতে যেয়ে হাত পা বাঁকা হয়ে যেত। পায়ে জুতা ছিল না। পরনে ছিল না শীতের কাপড়।

মোহছেনা জমিতে কাজকর্ম, চাষবাস করতো বলে আত্মীয়-স্বজন, মা বোনেরা মোহছেনার সাথে কথা বলতো না। এমনকি আত্মীয় বলে পরিচয় দিত না। মোহছেনার মা বোনরা পর্দানশীন ছিল বলে তার এসব কাজ কেউ মেনে নিতো না।

মোহছেনা এখনও খেতে খামারে কাজ করে। মাটি কর্ষণ করে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় তাঁর হাতের স্পর্শে ফলে সোনালী ধান, হরেকরকম শাকসবজি।

এতো লড়াই সংগ্রামে তার স্বামী মোহছেনার পাশে ছিল না। মোহছেনা যখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, যখন মোহছেনার নামে জমি বন্দোবস্ত হয়, তখন তার স্বামী মোহছেনার বাড়িতে আসে। মোহছেনা স্বামীকে নিয়ে এখন একসাথেই
থাকে।

দুই বছর বয়স থেকে আজ ষাট বছর বয়সে এসে ভূমি জয় করলেও সবরকম লড়াই তিনি জারি রেখেছেন এখনো। মোহছেনার সাথে কথা বললে যেকোনো নারী সাহস পাবে, পাবে জীবনে চলার দিশা।

মেঘনা নদী থেকে জেগে ওঠা চরে ঠাঁই হয়েছে কতশত মানুষের মোহছেনার মতো সাহসী নারীদের লড়াই আর আত্মবিশ্বাসের ফলে।

নাছিমা মুন্নি
উন্নয়ন কর্মী, ব্র্যাক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.