মুভি ‘দ্যা ডেনিশ গার্ল’ ও একজন ট্রান্সজেন্ডারের প্রতিক্রিয়া

নীলিমা সুলতানা:

প্রথমেই বলে রাখি এই লেখাটা প্রায় পুরোটাই স্পয়লার। এটা ঠিক ফিল্ম রিভিউ নয়, সিনেমাটির পর্যালোচনার সাথে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির বর্ণনাই বেশি, যাতে পুরো কাহিনীটাই আমি বলে ফেলেছি। যারা সিনেমাটি দেখে ফেলেছেন বা কখনো দেখবেন না বলে ভাবছেন, তারা চাইলে লেখাটি পড়তে পারেন। আর যারা সিনেমাটি কখনো দেখবেন বলে ভাবছেন তাহলে এই লেখা পড়লে নিজ দায়িত্বেই পড়বেন, না পড়লেও ক্ষতি নেই।

টম হুপারের পরিচালিত এই সিনেমাটি (২০১৫) এ নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম আমি। বাংলায় সমান্তরাল আর নগরকীর্তন ছাড়া ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমার বিশেষ নেই এটি ছাড়া। সাথে হয়তো বলা যায় তামিল ওয়েব ফিল্ম সুপার ডিল্যাক্স এর কথাও যার একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল ট্রান্সজেন্ডার। এ ধরনের সিনেমা দেখার আগে আমাকে ভীষণভাবে যুদ্ধ করতে হয় নিজের সাথে। কারণ আমি জানি, এরকম চরিত্র নিয়ে তৈরি মুভি কিংবা সিরিজ আমি দেখতে চাই। আবার একই সাথে অনুমেয়ভাবে জানি যে এমন কিছু দেখার পর আমি বিষণ্ণতা ও অবসাদে ডুবে যাবো, যা থেকে বেরুতে আমাকে বেশ সংগ্রাম করতে হবে। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি।

শুরুতেই বলা উচিত এই সিনেমার কাহিনীর বাস্তব প্রেক্ষাপট আছে। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র লিলি এলবে যার আগের নাম ছিল এইনার ভেগেনার। এইনার এবং গের্দা ভেগেনার বাস্তবেই স্বামী স্ত্রী ছিলেন এবং বাস্তবেও দুজনেই ছিলেন ডেনমার্কের দুজন তরুণ চিত্রশিল্পী। এইনার আঁকতেন ল্যান্ডস্কেপ আর গের্দা পোট্রেট এবং এইনার একজন সফল চিত্রশিল্পী ছিলেন। তবে সিনেমার কাহিনীতে তারা গত শতকের বিশের দশকে প্যারিসে গিয়েছিলেন দেখানো হলেও বাস্তবে সময়টা ছিল ১৯১২। প্যারিস তখনও মুক্তমনা শহর হিসেবে পরিচিত ছিল এবং গের্দা ও এইনার সেখানে প্রকাশ্যে লেসবিয়ান কাপল হিসেবে বাসও করতেন।

চলচ্চিত্রটি যদিও মূল কাহিনীর বদলে এই বাস্তব ঘটনা নির্ভর ২০০০ সালে প্রকাশিত ডেভিড এবারশফের রচিত একই নামের উপন্যাস থেকে নেয়া হয়েছে। সেজন্যই হয়তো কিছু ঘটনার সাথে বাস্তবের মিল নেই। যেমন, চলচ্চিত্রে এইনারের বাল্যবন্ধু হান্স এক্সিল চরিত্রটি যাকে একই সাথে লিলি/এইনারের বাল্যবন্ধু ও গের্দারও পরবর্তী সময়ের বন্ধু হিসেবে দেখানো হয়েছে সেই চরিত্রটি কাল্পনিক। তাছাড়া বাস্তবে এইনার নারী হবার পর লিলি এলসে ইভান্স নাম নিয়েছিলেন, লিলি এলবে নামটি একজন সাংবাদিকের সৃষ্টি। সিনেমাতে দেখানো হয়েছে ইউটেরাস প্রতিস্থাপন বা দ্বিতীয় অপারেশনের সময় লিলি মারা গিয়েছিলেন, যদিও বাস্তবে ১৯৩১ সালে তার পঞ্চম অপারেশনের সময় লিলি মারা গিয়েছিলেন। অন্য একটি অমিল হচ্ছে লিলির আগেও এধরণের সম্পূর্ণ রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আরেকজন গিয়েছিলেন। ডোরা রিকটার নামে একজন জার্মান রূপান্তরকামীকেই জানা ইতহাস মতে প্রথম রূপান্তরিত নারী বলা হয়। এগুলো অবশ্য ইতিহাসের কচকচানি। সিনেমাতে বরং আসি।

সিনেমাতে দেখানো হয়েছে এইনার তার শৈশব হতে লালিত সুপ্ত নারীত্ব চেপে রেখেই বড় হয়েছিলেন। খ্যাতিমান হয়েছিলেন একজন ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট হিসেবে, তার স্ত্রী গের্দার সাথে তার ছয় বছরের সুখের সংসারে তার এই নারীত্ব লুকোনোই ছিল। গের্দা নিজেও একজন পোট্রেট আর্টিস্ট হলেও খুব একটা সফল ছিলেন না। নিঃসন্তান এই দম্পতির জীবনে হঠাৎ পরিবর্তন এনে দেয় একটি ঘটনা। গের্দা তার ছবির নারী মডেল সময়মতো উপস্থিত না হওয়ায় এইনারকে নারীর পোশাক পরিয়ে তার ছবির মডেল বানান। এই সুযোগ এইনারের বহুদিনের সুপ্ত নারীত্বকে জাগিয়ে তোলে। তবে আরেকটি ঘটনা এই সত্ত্বাকে আরও প্রকাশিত করে যখন গের্দাই কৌতুক করে এইনারকে মেয়ে সাজিয়ে এক বন্ধুর পার্টিতে নিয়ে যান এইনারের কাজিন লিলির পরিচয় দিয়ে। সেই পার্টিতে হেনরিক নামে একজন পুরুষ লিলিকে একজন নারী ভেবেই বন্ধুত্বের আহবান এবং হঠাৎ চুমু খেয়ে বসলে সেই ঘটনা গের্দার চোখে পড়ে এবং এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হয় ও গের্দা এইনারকে অনুরোধ করেন লিলিকে তাদের জীবন থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু এইনার তাতে সম্মত হলেও ততক্ষণে নিজের মধ্যে লালন করা নারীত্বকে ভালোবেসে ফেলেছেন এবং লিলি হিসেবেই নিজেকে নিয়ে স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে।

গের্দা প্রথমে এইনারকে সত্যিকারের পুরুষ হিসেবে ফিরে পাওয়ার জন্য চিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যায় কিন্তু তাতে হিতে বিপরীতই হয়। এইনারকে মডেল করে আঁকা তার ছবিগুলো প্রদশর্নীর জন্য গের্দা প্যারিস থেকে ডাক পেলে দুজনে প্যারিস চলে যান এবং এইনারের মানসিক দুরবস্থা দেখে তাকে লিলি হতে সাহায্য করতেই গের্দা সেখানে এইনারের বাল্য বন্ধু হান্সকে খুঁজে বের করে এবং সবকিছু খুলে বলে তার সাহায্য চায়। হান্স এবং গের্দা যৌথভাবে এইনারকে সাহায্য করতে বিভিন্ন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তারা সবাই এইনারকে পাগল হিসেবেই সাব্যস্ত করেন। গের্দা এক পর্যায়ে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন, এইনারকে শারীরিকভাবে নারীতে রূপান্তরিত করার জন্য সম্মত করেন এবং ডাঃ কুর্ট ওর্মেক্রসের কাছে দুজনে যান। কুর্ট এইনারকে বলেন যে এমনটা করা সম্ভব এবং দুটো অপারেশন করতে হবে একটা এইনারের পুরুষ অঙ্গ অপসারণ আর দ্বিতীয়টি নারী অঙ্গ প্রতিস্থাপন। সেই সাথে এটাও বলেন যে এমন অপারেশন আগে কখনো করা হয় নি এবং এতে ঝুঁকির পরিমাণ পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এইনার/লিলি সানন্দে প্রথম অপারেশনের জন্য রাজি হন এবং সফলও হয় অপারেশনটি। তবে দ্বিতীয় অপারেশন করতে গিয়ে লিলি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান।

এই সিনেমার আকর্ষণীয় দিক এর ব্যতিক্রমী কিন্তু বাস্তবভিত্তির উপর রচিত কাহিনী, দুর্দান্ত চিত্রায়ন ও আবহ সঙ্গীত এবং বিশেষ করে গের্দা চরিত্রে এলিসিয়া ভিকানদের এর অভিনয়। তার অভিনয় এতোটাই বাস্তবসম্মত হয়েছিল যে কখনো মনেই হয়নি যে অভিনয় দেখছি। প্রথমের হাসিখুশি এবং সুখী গের্দা, এইনারের নারীত্ব প্রকাশিত হবার পর উদ্বিগ্ন গের্দা, তারপর সবকিছু মেনে নেয়ার দ্বন্দ্ব অথবা তার প্রতি হান্সের দূর্বলতা প্রকাশ এবং নিজেরও দূর্বলতা আর সবশেষে এইনার/লিলির প্রতি তার চিরকালীন ভালোবাসা এত সুন্দরভাবে এলিসিয়া ফুটিয়ে তুলেছেন যার কোন তুলনা হয় না। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য এলিসিয়া বেস্ট সাপোর্টিং রোলে অস্কার জিতে নিয়েছিলেন যদিও সিনেমার মূল চরিত্র দুটির একটি হয়েও তিনি পার্শ্বচরিত্র কিভাবে হলেন সেটা ঠিক বোধগম্য নয়। এমনকি সিনেমার নামকরণ দ্যা ডেনিশ গার্লও দ্ব্যর্থবোধক যাতে গের্দা বা লিলি দুজনকেই বোঝানো সম্ভব। হান্সের সাথে গের্দার প্রথম দেখা হবার সময়ও হান্স গের্দাকে একজন ডেনিশ গার্ল হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন।

এইনার/লিলি চরিত্রে এডি রেডমেইন অভিনয় করেছেন এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন সত্যি তারপরও মনে হয়েছে সত্যিকারের একজন ট্রান্সজেন্ডারের মানসিক দ্বন্দ্ব বা আচরণগত বৈশিষ্ট্য তিনি নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাবে। বিশেষ করে নিজের মধ্যে লিলিকে খুঁজে পাবার পর হঠাৎ করেই তার চলাফেরা বা আচরণে মেয়েলি ভাব প্রকাশ করাটা আমার কাছে বাস্তবস্মত মনে হয়নি। সেটা বোধহয় জরুরিও ছিল না। এটি অবশ্য একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। তাছাড়া বাকি সব পার্শ্বচরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন সবাই দারুণ এবং বাস্তবসম্মত অভিনয় করেছেন। প্লটে যে দুর্বলতাটি আমার চোখে পড়েছে সেটি হলো এইনারের শৈশবে উপলব্ধি করা নারীত্ব পরবর্তী জীবনে এমনকি বিয়ের প্রথম ছয় বছরেও প্রকাশিত না হওয়া এবং এইনার নিজেও এই জিনিসটি ভুলে থাকা আর তারপর হঠাৎ করে বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া।

সত্যিকার অর্থে এই জিনিস হঠাৎ একদিনে হওয়া সম্ভব নয় এবং একজন ট্রান্সজেন্ডার চিরদিনই ট্রান্সজেন্ডার, সে কখনও সেটা ভুলে থাকতে পারবে বলেও মনে হয় না। এটা অবশ্য আমি নিজের সাথে মিলিয়ে বলছি, মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকতেই পারে। হতেই পারে এইনারের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন বা সিনেমায় তার জীবনের আগের অংশে এই দ্বন্দ্বটা ছিল কী ছিল না সেটা আলোকপাত করা হয়নি। এই সিনেমায় এইনারের সেক্সুয়ালিটিও সেভাবে খোলাসা করে দেখানো হয়নি। গের্দার সাথে তার বিবাহিত জীবন থেকেই সিনেমার শুরু এবং দুজনের মধ্যে নিয়মিত না হোক শারীরিক সম্পর্ক যে অনুপস্থিত না সেটাও দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে নারী সাজে একজন পুরুষের চুমু গ্রহণ এবং তার সাথে যোগাযোগ রাখা এইনারের সেক্সুয়ালিটির একটি ভিন্ন দিক প্রকাশ করে। এটা খুবই সম্ভব এবং বাস্তব মনে হয়েছে। সেক্সুয়ালিটিকে এমনিতেই ফ্লুইড বলা হয় নারী হিসেবে কোন পুরুষের প্রতি আকর্ষিত হওয়া এইনারের পক্ষে অসম্ভব নয়। হয়তো এই আকর্ষণ সুপ্ত ছিল আর এইনার হেটরো, বাই বা যেকোন সেক্সুয়ালিটিরই হতে পারেন।

তবে এইনার তার নারীত্ব উপলব্ধি করার পর তার লুকিয়ে জামা পরা, বুক ভাঁজ করা কিংবা দুই উরুর মাঝে নিজের পুরুষ সত্ত্বা লুকিয়ে নিজেকে শারীরিকভাবে নারী হিসেবে কল্পনা করার চেষ্টার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি বারবার। এমন আচরণ তো আমিও বহুবার করেছি, হয়তো এটা অন্য ট্রান্সওমেনদের ক্ষেত্রেও ইউনিভার্সাল। আর নিজেকে বারবার খুঁজে পেয়েছি বলেই কাহিনীর পরিণতি বা এইনার/লিলির নিজের ও তার প্রতি অন্যদের আচরণে আমি নিজেও বিষণ্ণ থেকে বিষণ্ণতর হয়েছি।

জানি না একজন সিসজেন্ডার মানুষের একই অনুভূতি হবে কিনা। সময় বদলেছে, এ যুগের লিলিদের হয়তো কষ্টটা একটু কমেছে তবে এখনো যে বহুদূর বাকি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা প্রাপ্তিতে কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিনেমার লিলি এলবে বলেছিল সে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখেছে যে সে নিজের গর্ভে একটি সন্তান ধারণ করেছে যে তাকে লিলি বলেই ডাকছে। দুঃখের বিষয় সেই স্বপ্ন সার্থক করার মতো অগ্রগতি এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞান করতে পারে নি, কতটুকু কি হবে তা ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। সিনেমার মূল মোটো বোধহয় এটাই যে ভালোবাসা শাশ্বত, নারী-পুরুষ বিভেদে সেটা চলে যায় না, যা থাকে চিরকালেই থাকতে পারে। বাস্তবেও এই সময়ের অনেক ট্রান্সজেন্ডার কাপলের কাহিনীতে বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে যৌন রূপান্তর তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেনি।

ভালোবাসা যে শুধুই যৌনতা নয়, সেই অনুভূতিটি আরও বিশেষ কিছু তাই মনে হলো সিনেমাটির বক্তব্য। সিনেমাটির শেষ দৃশ্য আমার মন ছুঁয়ে গেছে। কোন এক সুন্দর পাহাড়ের চূড়ায় ভীষণ বাতাসে লিলির দেয়া স্কার্ফটি যখন গের্দার হাত থেকে উড়ে যায় তখন হান্স সেটা ধরতে গেলেও গের্দা বলে ওকে উড়তে দাও। এই ওড়া লিলিরই প্রতীকী ওড়া, যেই মুক্ত স্বাধীনতা এইনার/লিলিরা খোঁজে।

শেয়ার করুন: