ফাহমিদা খানম:
এই সংসার জায়গাটা অনেক আজিব একটা জায়গা। এক সময়ে যে সংসার নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেছি আজকাল সেখানে বিদ্রোহের সুর শুনে চুপসে থাকি।
রান্নাঘর থেকে বড় বউয়ের কন্ঠে শুনতে পাই —
“সংসার করতে আসা মানে কি চৌদ্ধগুষ্ঠির মনপছন্দ মতন রান্না করা! আমি কি কেবল সবার জন্য একাই আত্মত্যাগ করে যাবো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে মৃত স্ত্রীর জন্যে হিংসা হলো, শাহানা বড়ো ভাগ্যবতী। এসব কথা শোনার জন্যে বেঁচে নাই। সামান্য ব্যাপারে বউ এমন রিঅ্যাক্ট করবে জানলে হয়তো বলতামই নাহ।
বড় মেয়ের ঘরের নাতি ঢাকা কলেজে সুযোগ পাবার পর ওর মামারাই বললো হোস্টেলে থাকার দরকার নাই, এখানেই থাকুক। ভাগ্যিস ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে, শুনতে পেলে কী ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো! বড় মেয়ের প্রথম সন্তান, আমাদের সবার চোখের মনি। শাহানা বেঁচে থাকার সময়ে নাতি এলে অস্থির হয়ে যেতো। আচ্ছা, এসব যেন কবেকার কথা? কী দ্রুতই না চারপাশ বদলে যাচ্ছে! নাকি আমিই সেকেলে পড়ে আছি কে জানে!
নাতির জন্যে বড় বউমাকে পরোটা বানাতে বলেছিলাম, তাই হয়তো এই মধুর বর্ষণ কানে এলো। অবশ্য বউকে দোষ দিয়েও লাভ নাই। সংসারে একা আত্মত্যাগ একাই আর কতদিন করবে?
টেবিলে নাস্তা দেখে নাতিটা খুশি হলেও আমার মনে আনন্দ আসে না, বরং আতংকিত হই এই ভেবে আগামী দুই বছর এসব তিক্তকর অভিজ্ঞতা তাকেও দেখতে হবে। শাহানা বেঁচে থাকলে হয়তো কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিতো, অথবা নিজেই কিছু রান্না করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কিন্তু আমি যে কিছুই করতে পারি না! অক্ষমতার দায়ভার নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে কেবল দেখি আর শুনি, একটা বয়সের পর বধির আর না দেখার ভান করে থাকি, কারণ আমি বুঝে গেছি ভুলটা আমার নিজেরও কম না। নিজের একাকিত্বের চাইতেও সংসারের দ্বন্দ্ব আজকাল বেশিই ভাবায় আমাকে।
ছোট ছেলেটার বিয়ের পর থেকেই অশান্তির শুরু। মনে পড়ে বিয়ের পর বেয়াইন বলেছিলেন—
“এই যুগে এতো মানুষ একসাথে থাকা তো কষ্টকর, আপনি আলাদা করে দিচ্ছেন না কেনো?”
সেদিন রাতেই ছোট ছেলের রুম থেকে উচ্চস্বরে কথা কানে আসে—
“তোমার মা কেন আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে কথা বলবেন? বিয়ের আগে থেকেই তো তুমি জানতে আমরা বাবার সংসারে দুভাই থাকি”।
“আমাদের ভালোর জন্যেই হয়তো বলেছেন, তুমি নেগেটিভভাবে দেখছো কেনো?”
“বাবা যতদিন আছেন এসব কথা উচ্চারণ করবে না আর, এ বাসার সমস্যা হলে বাবা দেখবেন, প্লিজ সব কথা বাড়িতে বলার প্রয়োজন নাই”।
তারপর থেকে ছেলে শ্বশুরবাড়ি যায় না, সেই নিয়েও কতো কী হলো! কতো বিচার এলো আমার কাছেই, অথচ ওদের নিজেদের পছন্দের বিয়ে। বিয়ের পর থেকে বউমা বলে আসছে সে রান্নাবান্না করতে পারে না, তাই বড় বউয়ের উপরে চাপ পড়ায় সেও বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। দুই বছর এভাবে কাটলেও সবার অসন্তোষ ঠিক টের পাই, ছোট বউ বাচ্চা হতে গিয়ে বাবার বাড়ি গেলেও এখনও ফেরেনি।
আজকাল পেছনের দিকের কথা খুব মনে পড়ে। চার সন্তান নিয়ে কতো হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত একটা পরিবার ছিলো! ওদের মায়ের হুট করে মৃত্যুর পর আমিই দুই ছেলেকে বলেছিলাম –
“আমি বেঁচে থাকতে তোমরা আলাদা হইও না, একসাথে এক ছাদের নিচে দুই ভাই থেকো”।
বড় ছেলের বউ এতোকাল সবাইকে দেখেছে, এমনকি শাহানা বেঁচে থাকতেও তেমন সমস্যা হয়নি, নাকি আমিই বুঝিনি কিছু! হয়তো তখনও কিছু হতে পারে, কিন্তু শাহানা হয়তো চেপে গেছে অথবা সংসার ছোট ছিলো বলে দায়িত্ব কম ছিলো। দুছেলের বউই আমাদের চোখে সমান, কিন্তু কেউ যদি এটাকে নিজের সংসার না মনে করে সেখানে কী করার আছে! সময়, জীবন, বাস্তবতা কঠিন হয়ে উঠলে এক সময় জোয়ারে ভেসে যাবে। বড়ো সেঁকেলে ছিলাম বলেই আজও অনেককিছু বুঝতে পারি না।
মনে পড়ে নাতিনটা যখন কানে কানে এসে বলতো –
“দাদাভাইয়া, চাচী কিন্তু খাবার অর্ডার দিয়ে এনে রুমে একা একা খাচ্ছে”।
আমার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইতো না,পরে দেখে শুনে হতভম্ব হয়ে ভাবতাম, বড়দের কথা বাদই দিলাম, বাসায় যে ছোট দুটি বাচ্চা আছে এদের কথাও কি ভাবতে পারে না? কী জানি, এসব জ্ঞান কি কেউ কাউকে শেখাতে পারে নাকি বলতে? অবশ্য এসব নিয়ে কিছু বলার রুচি হয়নি, আর ছেলেকে বলা মানেই তো বাসায় কুরুক্ষেত্র ডেকে আনা। বোধ বিবেকের এতো ঘাটতি দেখে মাঝেমধ্যে অসহায় লাগে আর শাহানাকে মনে মনে হিংসা হয়। এতো অশান্তির মাঝে আবার দুছেলে ভাগ্নেকে কাছে রাখার দুঃসাহস করলেও আমি কিন্তু একদম চাইনি, বুঝে গিয়েছিলাম যে স্নেহের চাইতেও বাস্তবতা কঠিন! নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি কবেই!
শাহানা ছিলো ঘরকুনো স্বভাবের, এই সংসার ,সন্তান নিয়েই ছিলো তার জগত। দুই পরিবারের যতো আত্মীয়স্বজন বিপদে আপদে এখানেই চলে আসতো যখন তখন, বরং আমিই মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতাম। বড় ছেলের এসএসসি পরীক্ষার আগে দুই ছেলেকে ড্রয়ংরুমে ফ্লোরিং করে ঘুমাতে হয়েছিল বলে রাগ হয়েছিলাম খুব–
“এভাবে বলো না এতো মানুষ হোটেলে ভাড়া করে থাকা কী সম্ভব তুমিই বলো”!
“আমাদের ছেলেটার মেট্রিক পরীক্ষা সামনে শাহানা”!
“চিন্তা করো না, এভাবে সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে শিখলে দেখবে জীবনে আর কোথাও ঠেকবে না”!
হজে যাওয়া উপলক্ষ্যে এক আত্মীয়ের পুরো পরিবার বাসায় উঠেছিল তখন। সবার বিপদেআপদে শাহানা নিজেই স্বেচ্ছায় সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতো। আজকাল প্রায়ই ভাবি আমাদের দুই কন্যা কি মায়ের স্বভাব পেয়েছে? নাকি ওরাও কেবল নিজেদের কথাই ভাবে? বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় তো নাই।
রাতে ছোট ছেলেকে খাবার টেবিলে জিজ্ঞেস করি –
“নাতিন আর বউমাকে কবে আনবি বাপ?”
“ও এখন আসবে না বাবা, বাবুকে আরেকটু বড় করেই আসবে, একা নাকি পারবে না। তুমি দেখতে চাইলে শুক্রবারে চলো”।
ছেলের কালো মুখ বুঝিয়ে দেয় অনেক কিছুই, বাচ্চার বয়স এখন তিন মাসের মতন, আর বাচ্চাকে যে কয়বার দেখতে গেছি বেয়াইন ইশারায় বুঝিয়েছেন, এখানে এলে বাচ্চার যত্ন নেবে কে? তার মেয়েই তো এখনও ছোট! একটা বয়সের পর নিশ্চুপ হয়ে শোনা আর দেখা ছাড়া কিছু করার নাইও। নিজের ছোট মেয়েটা প্রবাসে একা চাকুরি সংসার, সন্তান কীভাবে সামলায় বলার ইচ্ছে হলেও চুপ করে থাকি। অশান্তিকে বড় ভয় পাই এখন।
পরদিন বড় ছেলে আর বউয়ের কথা কানে আসে—
“আমার বাচ্চারা কি এখানে বড় হয়নি? ওর ব্যাপারে এতো প্রায়োরিটি কেন সবার? কই, আমি তো বাচ্চা হবার পর এভাবে বাবার বাড়িতে পড়ে থাকতে পারিনি?”
“আহ, চুপ করো বাবা শুনলে কষ্ট পাবেন, আর তুমি তো পরিবারের বড় বউ”।
“বড় ছেলে আর বড় বউয়েরই সব দায়-দায়িত্ব? কেমন স্বামী তুমি নিজের বউয়ের ভালমন্দ পর্যন্ত বোঝো না?”
আমি অনুভব করি সত্যিই অন্যায় হচ্ছে আর এর জন্যে একমাত্র আমিই দায়ী। বড় গাছের নিচে ছোট গাছ আলো বাতাস পায় না আসলে। স্নেহ নিম্নগামী তাই বলে আমি এই অন্যায়ের দায়ভার নিতে সত্যিই অক্ষম, সবার আলাদা জগত হয়েছে সেখানে আমার সংসারে ওদেরকে বেঁধে রাখার চিন্তাই ভুল। মনের ভেতরে যে অসন্তোষ জমা হচ্ছে সেটা সামাল দেওয়া এই বয়সে সম্ভব হবে না, নিত্যকার অশান্তির চাইতে দূরে থেকে সম্পর্ক ভালো থাকলে সেটাই ভালো। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করি না, যতদিন বেঁচে আছি হয়তো আমাকে দেখতে সবাই আসবে, তাই সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য দুছেলেকে একই বাড়িতে আলাদা করে দেবার ডিসিশন নিয়ে নেই। আমার দায়িত্ব পালন করেছি, কিন্তু ওদেরকে জোর করে আটকে রাখার অধিকার আমার নাই। কাহলিল জিবরানের সেই কবিতাটা মনে পড়ে যায়, আর নিজের মনের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করতে থাকি।
এই যে জোর করে সব নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কতো কী হারিয়ে ফেলি! অথচ সহজ করে দেখলেই সহজ হয় চারপাশ। সম্পর্কে ফাটল ধরার আগেই আলাদা হোক, তবুও শান্তি থাকুক সবার মধ্যে। এই বয়সে এসে অশান্তি ভালো লাগে না, তাছাড়া সংসার আমার আর শাহানার, সেখানে শর্ত দিয়ে জোর করে আটকে রাখার ভাবনাই ভুল। আমাকে কে দেখবে অথবা আমি কোন ছেলের সাথে থাকবো অথবা আদৌ কেউ দায়িত্ব পালন করবে কিনা সেটার চাইতেও বড় বিষয় সম্পর্ক ভালো রাখা।
সংসারে ছোট ছোটো অভিমানগুলো জমে জমে বিস্ফোরণ হবার আগেই লাগাম টেনে ধরাটা খুব জরুরি। ছেলেদের শর্ত থেকে মুক্ত করে দিয়ে আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, যে যার জগতে ভালো থাকুক নিজের মতন করে বাবা হিসাবে এটা ছাড়া কিছুই চাওয়ার নাই এই বয়সে।