শিশুদের ওপর দয়া করুন

শাহমিকা আগুন:

জান্নাতুল চলে গেছে। চিরতরে। না জানা কোন দেশে, ওর মায়ের বুক খালি করে। মাত্র চার বছর বয়স। ছোট্ট একটা শরীর। অনেক কিছু সয়ে নিয়েছে এই বয়সে। ওকে হারিয়ে মা এখন পাগল্প্রায়। একবারের নিঃসন্তান মা আবার হলো সন্তানহারা। অনেক বছর সন্তানহীন থাকার পর জান্নাতুলকে পেয়ে সজোরে আঁকড়ে ধরেছিল। সেও চলে গেল।

কিন্তু কেন? তার আগে বলে নেই আমি জান্নাতুলকে কখনো দেখিনি। ওর মৃত্যুর পর আমার বোনের কান্নাকাটি শুনে জানতে পারলাম তার এক পরিচিত জনের বাচ্চা ছিল জান্নাতুল। মায়ের আহাজারিতে আকাশ- বাতাস বিদীর্ণ! এই কাঠফাটা গ্রীষ্ম তার খাঁ খাঁ রোদ্দুর দিয়ে তাপিত করেও শুষে নিতে পারছে না মায়ের শোকার্ত চোখের অশ্রু। কে দায়ী জান্নাতুলের মৃত্যুর জন্য? চার বছর বয়সেই কিডনি ফেইলিউর! কীভাবে?

কয়েক মাস ধরে শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল বাচ্চাটির। মা নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষা করে ধরা পড়েছিল কিডনিতে সমস্যা। ওষুধও দিয়েছিল ডাক্তার। কিন্তু খাবার নিয়ন্ত্রণের কথা বলতে হয়তো ভুলে গিয়েছিল। ফলে মা আরও বেশি করে দুধ, ডিম, আনার, আনারস, ডালসহ অনেক মিষ্টি জাতীয় খাবার বাচ্চাটিকে খাওয়াচ্ছিল। শবেবরাতের রাতে অনেক ভালো করে দুধ চিনি দিয়ে সুজি রেঁধে খাইয়েছিল। তারপর আর ধকল নিতে পারেনি শিশুটির শরীর। কিডনি ফেইল করেছে। চলে গেছে না ফেরার দেশে।

আমার ধারণা বাংলাদেশে কিডনি রোগের জন্য খাবার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা হয়তো সব ডাক্তার অনুধাবন করেন না। আমি আমার বাবার ডায়াবেটিসজনিত কিডনির সমস্যার কারণে হাসপাতালে ভর্তির পরের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা লিখছি।

তাকে বাসার কাছে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তারপর তাকে দেয়া হলো পাউরুটি, আটার রুটি, ডিম, আলু ও বাধাকপি ভাজি, ভাত, মুরগি, ডাল, সবকিছু লবনসহ। ঔষধও চলছিল। কিন্তু আমার বাবার অবস্থা ক্রমাগত খারাপ থেকে খারাপতর হলো। ডাক্তাররা পরিবারকে বলে দিলেন যে উনাকে সম্ভবত আর বাঁচানো যাবে না।
আমি বাংলাদেশে থাকি না। আমার বোন বাংলাদেশ থেকে জানানোর পর আমি সব শুনে বললাম সবগুলো খাবার বন্ধ করে দিতে। আমি দিলাম শুধুমাত্র জাউ লবন ছাড়া। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেঁকে বসলেন। বললেন, কিছু হলে এর দায়দায়িত্ব তারা নিবেন না। আমার পরিবার বললো, কোন দায়িত্ব হাসপাতালকে নিতে হবে না। শুরু হলো বাসায় বানানো আমার দেয়া পথ্য। আমার বাবার রক্তচাপ, ব্লাড সুগার, সোডিয়াম-পটাসিয়াম ব্যালেন্স, ক্রিয়েটিনিন ব্যালেন্স হওয়া শুরু হলো। পেশাবে প্রোটিনের পরিমাণ কমে গেল। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়া শুরু হলো এবং সাতদিনের মাথায় উনি বাসায় আসতে পারলেন।

কিডনি হলো শরীরের প্রধান ছাঁকন যন্ত্র। আমরা মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, বরবটি, লবন, চিনি যাই খাই না কেন তা ছাঁকন এবং পরিশোধনে কিডনি প্রধান ভূমিকা পালন করে। রক্ত পরিশোধন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম নিয়ন্ত্রণ, পিএইচ ব্যালেন্সসহ অনেক বড় বড় কাজ করে কিডনি। কাজ যেমন জটিল, কিডনি সমস্যা দেখা দিলে তা ঠিক করাও বেশ জটিল। তবে ঠিকমতো ডায়েট এবং ঔষধ দিয়ে কিডনি রোগীকে স্বাভাবিক জীবন-যাত্রায় ফিরিয়ে আনা যায় এবং কয়েক মাস পর কিডনি সম্পূর্ণভাবে হিলিং হওয়াও সম্ভব। আমার বাবা এখনো ভালো আছে। অনেক সময় দীর্ঘদিন ভালো থাকার পর রোগী ভুলে যায় পথ্যের কথা। আমার বাবাও মাঝখানে লুকিয়ে অনেক কিছু খাওয়া শুরু করেছিল এবং তার রক্তে শর্করার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়। আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দিল। রাতে শুরু হলো পাতলা পায়খানা। হাসপাতাল থেকে বের করে দিল ডায়রিয়া ভেবে। রাতের বেলা আমার ভাইরা পাগলের মতো আই সি ডি ডি আর, বি তে নিয়ে গেল। আমি শুনে বললাম, কিডনি ফেইলিউর, পাতলা পায়খানা তো হবেই। অন্য হাসপাতালে নিতে বললাম। আই সি ডি ডি আর, বি বাবাকে রাখলো না। পরে অনেক খুঁজে একটা হাসপাতাল পাওয়া গেল যেখানে তারা রাখতে রাজি হলো।

আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম একজন অসুস্থ কিডনি জটিলতা আক্রান্ত রোগীর স্বাভাবিক সিমটম কেন ডাক্তাররা বুঝতে পারলেন না? নতুন হাসপাতালটি ডায়াবেটিস, কিডনির জন্য বিখ্যাত, কিন্তু খাবার শুনে আমি স্তব্ধ। লাউ, ডিম, পাউরুটি, ভাত, বরবটি, বাঁধাকপি। আমার বাবার খবার মতো অবস্থাও ছিল না। আমি মাকে ভিডিওতে শরীরের কিছু পয়েন্ট দেখিয়ে দিলাম। বললাম, তোমার কাজ এই পয়েন্টগুলো এক্টিভেট করে দেয়া। কীভাবে করতে হবে দেখিয়ে দিলাম। মা তা করলেন। ডাক্তাররা তাদের ঔষধ দিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাঁচদিনের মাথায় আমার বাবা সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেন।

আমি বুঝতে পারছিলাম না ডায়াবেটিসের রোগীকে সকালবেলা তিন পিস পাউরুটি দিলে তো সকালেই তার রক্তের চিনির পরিমাণ বেড়ে গেল। ডায়াবেটিসের জন্য প্রসিদ্ধ হাসপাতাল কেন গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স ডায়েট ফলো করে না!

জান্নাতুল চলে গেছে। কিন্তু রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। কে দায়ী তার এই অকাল চলে যাওয়ার জন্য? আপাতদৃষ্টিতে সবাই ডাক্তারদের দায়ী করেন। কিন্তু আগে তো ভেবে দেখেন যে চার বছরের একটি শিশুর কিডনি কেন ফেইল করবে?

সম্প্রতি একটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে যাতে বেশ কিছু কোম্পানির পণ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যেমন, গ্রীণ ব্লিচিং এর সরিষার তেল, শমনমের সরিষার তেল, বাংলাদেশ এডিবল ওয়েলের সরিষার তেল, কাশেম ফুডের চিপস, সিটি ওয়েলের সরিষার তেল, আরা ফুডের ড্রিংকিং ওয়াটার, আল সাফির ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজান ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্ণ ডিউয়ের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকান ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার, আরার ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, দিঘী ড্রিংকিং ওয়াটার, প্রাণের লাচ্ছা সেমাই, ডুডলি নুডলস, শান্ত ফুডের সফট ড্রিংক পাউডার, জাহাঙ্গীর ফুড সফট ড্রিংক পাউডার, ড্যানিশের হলুদের গুড়া, প্রাণের হলুদ গুড়া, ফ্রেশের হলুদ গুড়া, এসিআইর ধনিয়ার গুড়া, প্রাণের কারি পাউডার, ড্যানিশের কারী পাউডার, বনলতার ঘি, পিওর হাটহাজারী মরিচ গুড়া, মিস্টিমেলা লাচ্ছা সেমাই, মধুবনের লাচ্ছা সেমাই, মিঠাইর লাচ্ছা সেমাই, ওয়েল ফুডের লাচ্ছা সেমাই, এসিআইর আয়োডিন যুক্ত লবন, মোল্লা সল্টের আয়োডিন যুক্ত লবন, কিং’য়ের ময়দা, রুপসার দই, মক্কার চানাচুর, মেহেদীর বিস্কুট, বাঘাবাড়ীর স্পেশাল ঘি, নিশিতা ফুডস এর সুজি, মধুবনের লাচ্ছা সেমাই, মঞ্জিলের হলুদ গুড়া, মধুমতির আয়োডিন যুক্ত লবন, সান ফুডের হলুদ গুড়া, গ্রীন লেনের মধু, কিরনের লাচ্ছা সেমাই, ডলফিনের মরিচের গুড়া, ডলফিনের হলুদের গুড়া, সূর্যের মরিচের গুড়া, জেদ্দার লাচ্ছা সেমাই, অমৃতের লাচ্ছা সেমাই, দাদা সুপারের আয়োডিন যুক্ত লবণ, মদীনার আয়োডিন যু্ক্ত লবন, নুরের আয়োডিন যুক্ত লবন।

তালিকাটি দেখেন। মশলা থেকে শুরু করে তেল, লবন, ঘি, নুডুলস কোনকিছুই বাদ যায়নি। এই অসাধু ব্যবসায়ীরা হলো আসল কালপ্রিট। যাদের পণ্য বাবা-মা অনেক টাকা দিয়ে কিনে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে, নিজেরা খাচ্ছে, আর দিনদিন মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কয়েক বছর আগে একটা লেখা লিখেছিলাম বিডিনিউজ২৪ডটকমে, ‘একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার সহজ উপায় আর কী হতে পারে’ যখন আমি সারে ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি শুরু করেছিলাম।

বাংলাদেশের কিছু লবন নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল বড় বড় ব্র্যান্ডের কোন প্যাকেটেই আয়োডিন নেই। লেখাটা ছাপার পর কিছুদিন হইচই হয়, তারপর আবার যেই কে সেই! আমার গবেষণার বিষয় ছিল দক্ষিণ এশিয়া এবং ইউরোপিয়ানদের হাড়ের রোগের সাথে ভিটামিন ডি, আয়োডিন এবং থাইরয়েডের সম্পর্ক এবং পার্থক্য।

লেখক শাহমিকা আগুন তার ছেলের সাথে

গবেষণাটি শেষ করতে পারিনি, কারণ ২০১৩ সালে আমার ছেলের অটিজম ধরা পড়ে এবং আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম, যা আমাকে অনেক রকম চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন করেছিল। সে যাই হোক আমি ও আমার ছেলে অটিজমকে আমাদের জন্য ব্লেসিং বানাতে সক্ষম হয়েছি।

অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবছেন যে আমি তাহলে আসলে কে! গতবার উইমেন চ্যাপ্টার আমার একটি লেখা ছেপেছিল ‘অটিজম একটি অপুষ্টিজনিত রোগ’ শীর্ষক। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন আমার পেশাদারিত্ব নিয়ে এবং এর সম্পাদককে অনেক হেনস্থা হতে হয়েছিল। আজ দুবছর পরও বাবা-মা যোগাযোগ করেন। অনেক সময় আমরা নিজের সীমাবদ্ধতার বাইরে কিছু হলে তা মানতে চাই না। কিছু মানুষ বারবার বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, আমি যা লিখেছি তার আসলে কোন সত্যতা নেই।

আমার সাথে অনেকেরই মতের মেলে না। আমি তা জানি। একটি রুমে ১০০জন মানুষকে আটকে দিয়ে চাবি লুকিয়ে রেখে বলা হয়েছিল তোমরা এখন থেকে বের হয়ে যাও। ছিয়ানব্বই জন চেষ্টা করে মেনে নিয়েছেন যে, এই বদ্ধ ঘর থেকে বের হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না। সারেন্ডার করলেন। চারজন অন্যধরনের কৌশল ব্যবহার করলেন এবং বদ্ধ দরজা খুলে বের হতে সক্ষম হলেন। এটা একটা গবেষণার অংশ। আমি মনে করি আমি সেই চারজনের দলে যে চলমান প্রথার বাইরে চিন্তা করে সমাধান খুঁজতে পারে এবং নিজেকে ও অন্যদেরকে মুক্ত করতে পারে।

আমি পেশায় পুষ্টিবিদ, হোলিস্টিক থেরাপিস্ট বা নেচারোপাথ এবং মাইন্ড-বডি কোচ। আমি খাদ্য ও পুষ্টিবিদ্যায় বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড থেকে দুটো মাস্টার্স, পাবলিক হেলথ এ ডিপ্লোমা করেছি। তারপর কিছুদিন সরকারি হাসপাতালে চাকরি করে পরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম। তার আগে হেলথ কেয়ারার হিসেবে কাজ করি।

২০১২ সালে সারে ইউনিভার্সিটিতে বিশ্ব বিখ্যাত পুষ্টিবিদ ডঃ সুসান লেনহাম-নিউ এর সুপারভিসনে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রজেক্ট মিলিনিয়াম রিসার্চ এ পিএইচডি করার সুযোগ পাই। ২০১৩ সালে আমার ছেলের অটিজম ধরা পড়ার পর আমি একরকম দিশেহারা হয়ে পড়ি। কোথাও কোন আশার বাণী শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি সব ছেড়ে দিয়ে মানসিক ও অটিস্টিক বাচ্চাদের কেয়ার হোমে কাজ নেই অটিজমকে বোঝার জন্য।

অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু এছাড়া আর কিছু তখন ভাবতে পারছিলাম না। শুরু করলাম মানসিক স্বাস্থ্য, নিউরন, মস্তিষ্ক, জিনতত্ত্ব, এপিজিনিওলজি ইত্যাদি নিয়ে ট্রেনিং নেয়া। সেই সাথে শুরু করলাম হোলিস্টিক ট্রেনিং নেয়া যেমন কিনেসিওলজি, কালার থেরাপি, ব্রেইন ভাইব্রেশন ফ্রিকুয়েন্সি থেরাপি, চাইনিজ মেরিডিয়ান পয়েন্টস, ফাইভ এলিমেন্টস, আয়ুর্বেদ নিউট্রিশান ও লাইফস্টাইল,ইমোশনাল ফ্রিডম টেকনিক, ভিসুয়ালাইজেশন, জার্মান নিউ মেডিসিন, মেডিটেসন, রেইকি, সি বি ডি, ল-অব-এট্রাকসান ইত্যাদি। আমার বারটির বেশি সার্টিফিকেট রয়েছে। আমি প্রাইভেট ক্লিনিকে নিজস্ব পদ্ধতিতে চিকিৎসা করি এবং অনলাইনেও রোগী দেখি। নিজের ছেলের পাশাপাশি ইংল্যান্ডসহ সারা পৃথিবীতে অনেক অনেক শিশু, তাদের পরিবার এবং অনেক বড়দেরকে বেশ জটিল রোগের যন্ত্রণা থেকে বের করে আনতে সফল হয়েছি। আমার রোগীদের একটা বড় অংশ আসে ডাক্তারদের রিকমেন্ডশনে বা ডাক্তাররা নিজেরাই আসেন তাদের বা তাদের সন্তানের চিকিৎসার জন্য।

ক্রনিক রোগ এখন মহামারি। এমন কোন ঘর পাওয়া মুশকিল যে ঘরে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী রোগী পাওয়া না যাবে। শিশুদে্র মধ্যে ক্রনিক রোগের মাত্রা এখন পৃথিবীর ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি। আমার এতো বছরের ক্যারিয়ারেও আমি এতো ভয়াবহ মাত্রার শিশু রোগী আগে এতো পাইনি।

রোগের প্যাটার্ন বদলে যাচ্ছে। আমি যখন চৌদ্দ পনের বছর আগে পড়েছি তখন, কেন্ডিডা, লিকি গাট, ক্রোন, মেটাল টক্সিসিটি, পেন্ডাস, আইবিএস, ডিভারকুলাইটিস, ব্রেইন ফগ, ফাইব্রোমেল্গিয়া, টিনিটাস ইত্যাদি ইত্যাদি রোগ নিয়ে পড়িনি। পরে আবার ট্রেইনিং নিতে হয়েছে। নিত্য নতুন রোগের নাম শোনা যাচ্ছে যার জন্য মেইন্সট্রিম ডাক্তাররা সাধারণত ট্রেনিং নেন না, বা মেইন্সট্রিম চিকিৎসা পদ্ধতি এই রোগগুলোকে এখনো রোগ হিসেবে স্বীকার করছে না। একারণে অটিজম, এ ডি এইচ ডি, লারনিং ডিসএবিলিটিসহ নতুন নতুন রোগের চিকিৎসাও তারা দিতে পারছেন না।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস আগামি দশ থেকে পনের বছরের মধ্যে চিকিৎসা পদ্ধতির মূল নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে পুষ্টিবিদসহ আমার মতো হোলিস্টিক চিকিতসকদের হাতে।

কেন বলছি, তা হলো আপনি যা খান এবং আপনি যা ভাবেন, তার বাইরে আপনি আর কিছু নন। মানুষ বুঝতে শুরু করেছে তা। পাশ্চাত্যে গত দশ বছরে যে ইন্ডাস্ট্রি সবচেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়েছে এবং আগাচ্ছে, হোলিস্টিক ও ওয়েলবিং হলো তার মধ্যে দ্বিতীয়।

ইংল্যান্ডে চিকিৎসা সেবা ফ্রি হবার পরও মানুষ ছুটছে আমাদের মত হোলিস্টিক চিকিৎতসকদের কাছে এবং প্রাইভেটভাবে পে করে চিকিৎসা নিচ্ছে। গত দশ বছরে থাইরয়েডের যে ঘনঘটা ছড়িয়েছে বেশিরভাগ মানুষের ঘরে ঘরে, তা অবিশ্বাস্য। ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদরোগের তো কোন কথাই নেই।

এখন কথা হলো, কেন? এই দায় কার? আমি মনে করি এই দায় অবশ্যই মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীদের, যারা টাকার লোভে খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। আমি গত বছর বাংলাদেশে গিয়েছিলাম রোগী দেখতে। বাচ্চাদের রিপোর্ট দেখে আমি মনে মনে কাঁদছিলাম! আহা আমাদের বাছাধনেরা! আহা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম! প্রত্যেকের শরীরে সীসা, এলুমিনিয়াম, পারদ, থ্যালিয়াম ইত্যাদির পরিমাণ একশ তে প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ!

কথা হলো এতো পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ বাচ্চার শরীরে কোথা থেকে ঢুকলো? প্রতিটা বাচ্চা ভুগছে। বাবা -মা এর মুখের দিকে তাকানো যায় না। আমি তো নিজেও মা, কী বলবো উনাদের! যেই বিষক্রিয়া আগে হয়েছিল তা শরীর থেকে ধীরে ধীরে বের করে দেয়া যায়। কিন্তু নিত্য যে বিষ ঢুকছে শরীরে তা থেকে উদ্ধারের কী উপায়!

শুধু যে বাংলাদেশে এমনটি হচ্ছে এমন কোন কথা নেই। সারা পৃথিবীতেই এমনটি চলছে। বাবা-মা বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে চিকেন ডিপারস, পিজ্জা, হটডগ, পাস্তা, নুডুলস, ক্রিস্প, চিপস, কোক, স্প্রাইট, জুস, হরমোন যুক্ত দুধ ইত্যেদি। এ ধরনের খাবার বাচ্চাদের অনেক অনেক ক্ষতি করে। বাচ্চার লিভার, গল ব্লাডার, স্প্লীন, কিডনি এর ফাংশন ধীর করে দেয়। কারণ এসব খাবারে যোগ করা হয় নানা রকম কেমিক্যাল, এপিটাইজার, মাত্রাতিরিক্ত গ্লুটেন যা শরীর সহজে হজম করতে পারে না। এই কেমিক্যাল্গুলো আধা ভাঙ্গা হয়ে রক্তে মিশে ধীরে ধীরে হয়তো এলার্জি, নয়তো অটো ইম্যুন ডিজিজ বা ব্রেইন ব্লাড বেরিয়ার ভেদ করে শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশে, আচরণে, মনোযোগের ক্ষেত্রে, সেন্সরি ইস্যুতে, বুদ্ধি বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং শিশুটি ধীরে ধীরে ক্রনিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

আমি বাচ্চাকে অরগানিক আপেল খাওয়াতাম। কী মনে করে রেখে দিলাম জানালার পাশে। আট মাস পরেও সেই আপেলে পচন ধরেনি। ইংল্যান্ডেই এ অবস্থা!
আমি শিশুর ক্রনিক কন্ডিশানের জন্য বাবা-মাকে দায়ী করি। একটা শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তার যদি ভালো করতে না পারে আপনারা ডাক্তারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। একবারও কী ভেবেছেন যে, শিশুর হাতে ক্রীস্প এর প্যাকেটটি কে তুলে দিয়েছিল? শিশুটিকে প্রতিদিন, কেইক, বিস্কিট, চকোলেট, আইস্ক্রিম, মিষ্টি, চানাচুর, ডাল্ভাজা ইত্যাদি কিন্তু আপনিই তুলে দিয়েছিলেন।

আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি বাবা-মায়েরা পেরেন্টিং রেস্পন্সিবিলিটি নিতে চান না। শিশুর বিস্কিটের বদলে একবেলা ফল যোগ করা খুব কঠিন, তার চেয়ে কোন ওষুধ খাইয়ে বসিয়ে রাখা অনেক সহজ। বাচ্চাটির লিভার কিডনির যে ক্ষতি হচ্ছে তা উনারা বুঝতে পারছেন না!

আরেকটা টেন্ডেন্সি হলো সবকিছুতে ক্রোমোজম, ডিএনএ, জীন, বংশকে দায়ী করা! একবারো কি ভেবেছেন জীন কী দিয়ে তৈরি? প্রোটিন, এমাইনো এসিড একটা বড় অংশ। এবার তাহলে ভাবেন তো যে ফরমালিনযুক্ত মাছ বা মাংস নিজে খাচ্ছেন, বা শিশুকে খাওয়াচ্ছেন তার গুণগতমান কী পর্যায়ের! প্রোটিনের মান ভালো না হলে আপনার জীন তো বদলে যাবেই, তাই না?

আমি আমার ট্রিটমেন্ট এর একটা বড় অংশ রাখি বাবা-মা এর ট্রমা রিলিজ এর জন্য। কারণ এপিজিনিওলজি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, আপনার নেতিবাচক চিন্তা ও পরিবেশ বদলে দেয় আপনার ডি এন এ এর স্ট্রাকচার। গত বছর আমি বেশ সময় নিয়ে কথা বলতে পেরেছিলাম স্টেম সেল এর আবিষ্কারকদের অন্যতম ব্রুস লিপটনের সঙ্গে। আমি স্পেশাল নিডস বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করি শুনে খুব আগ্রহ দেখালেন।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম উনার মতামত, বললেন, শরীরের ভেতরের পরিবেশ না বদলালে স্টেম সেল কিছুদিন কাজ করবে এবং আবার তা পুরনো সেলের মত কাজ শুরু করবে। কারণ সমস্যার মূল রয়ে গেছে। মূল সমস্যা যদি হয় ইমোশনাল ট্রমার কারণে, তো যতই সেল দেয়া হোক বা ঔষধ বা সাপ্লিমেন্ট দেয়া হোক, কাজ হবে না।

ইংল্যান্ডে আমি স্টেম সেল করা এরকম দুটো বাচ্চা পেয়েছি যারা কিছুদিন ভালো ছিল, তারপর অবস্থা আগের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিল। কারণ হলো বাবা -মা সহজ সমাধান চায়। আমার ন্যাচারাল পদ্ধতি তে সময় লাগে, কিন্তু কোন রকম সাইড এফেক্ট ছাড়া কাজ হয়।

আমি গত বছর বাংলাদেশে যাবার পর একটি বাচ্চা আনা হলো আড়াই বছর বয়সের। মায়ের কাঁধের ওপর রাখা। ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক গিয়েছেন, খুব একটা উপকার হয়নি। আমি বাচ্চা আর মাকে আমার পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে দেখলাম যে, বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় মা আত্মহত্যার কথা ভাবতো। আমি মা ও বাচ্চার ওপর কাজ করলাম। দেড় ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা উঠে দাঁড়িয়ে তারপর দৌড়ানো শুরু করলো। বাবা-মা বিশ্বাস করতে পারছিল না। কারণ এই বাচ্চা কখনও দু পা এর বেশি হাঁটতে পারেনি এর আগে।

একজন আর্মি অফিসার আর তার বাচ্চার চিকিৎসা করেছি। তার বাচ্চা এখন সুস্থ এবং তিনি অনেক অনেক বছর পর আরেকটি সন্তানের মা হয়েছেন। আমাকে লিখেছেন, ‘আমার এই আনন্দের পঞ্চাশ ভাগ ভাগীদার আপনি।‘ আমার বুক ভরে যায়। সেদিন আরেক মা বাচ্চার ভিডিও পাঠালেন। যে বাচ্চা কোন কিছু করতে পারতো না সে এখন ক্রিকেট খেলছে। বাচ্চাটির বাবা বাংলাদেশের একটি মেডিকেল কলেজের প্রধান, নিজে বড় ডাক্তার।

আমাকে বলেছিলেন, ‘বাসায় এখন আসলে ও যখন এসে জড়িয়ে ধরে, কী যে ভাল লাগে। আগে তো কাছেও আসতো না। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।‘ আহা! মানুষের পরিবারে শান্তি আনার চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে! কত কত মা বাবা আমাকে ধন্যবাদ জানায়! আমি ধন্যবাদ জানাই আমার ছেলেকে। ও আমার জীবনে না এলে তো আমার এই পথে হাঁটা হতো না।

আমি নিজে থাইরয়েডের রোগী ছিলাম। বলা হয় এটা সারা জীবনের রোগ, কিন্তু আমি আজ দুবছর হলো থাইরক্সিন নেই না। আমি পেরেছি নিজেকে সারিয়ে তুলতে থাইরয়েডের হাত থেকে। কথাগুলো বলার কারণ হলো, সবকিছু ডাক্তারদের ওপর ছেড়ে না দিয়ে অন্য পদ্ধতিরও খোঁজ করুন।

আমি জানি না যদি জান্নাতুলের মা আগে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, আমি ওর জন্য কিছু করতে পারতাম কিনা। হয়তো পারতাম, হয়তো না, হয়তো এভাবেই ওর মৃত্যু হবার কথা ছিল। কিন্তু তারপরও বুকের ভেতর খচখচ করে ওঠে। মানা যায় না।

বাজেয়াপ্ত করা খাবারের তালিকাগুলোর দিকে তাকাই, কত নির্দ্বিধায় এরা বছরের পর বছর এসব প্রোডাক্ট বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে! আমার বোনের বাচ্চাকে একবার শপিং মল থেকে ফ্রাইড চিকেন খাওয়ানোর পর পেট ফুলে বাচ্চার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতালে ভর্তি করে অনেক কষ্টে তাকে বাঁচানো গেছিল। কী যে মিশিয়েছিল সে খাবারে একমাত্র তারাই জানে!

মনে হয় জান্নাতুলের ডাক্তার যদি বলতো ওর মাকে, কী ধরনের খাবারগুলো পরিহার করতে হবে, তাহলে হয়তো মায়ের বুকটি খালি হয়ে যেত না অকালে!

আমি অগাস্টের শেষের দিকে বাংলাদেশে একটি সেমিনারে যাচ্ছি বাবা-মায়ের অনুরোধে, যারা আসতে চান যোগাযোগ করতে পারেন। আমি প্রফেশনালদেরও অনুরোধ করবো আসার জন্য। শেখার কোনো শেষ নেই, শিখতে কোন ইগো থাকারও কথা না। একটা সঠিক তথ্য একজনের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। যে বাবা-মায়েরা হতাশ যে, বাচ্চাকে কী খাওয়াবেন তাদের জন্যও অনেক সুবিধা হবে।

আমাদের বাচ্চারা ভুগছে। পৃথিবীজুড়েই এই চিত্র। আমি প্রশাসনের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, দয়া করে খাদ্যে বিষক্রিয়া বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নেন।

মা-বাবাদের বলছি, দয়া করে প্রসেস খাবার বন্ধ করে, ঘরে তৈরি খাবার দেন। যারা মনে করেন যে, বাচ্চার জন্য এইটুকু করার সময় নেই, দয়া করে বাচ্চা নেয়ার আগে চিন্তা করুন। কারণ বাচ্চা কোন প্রোডাক্ট না, একটা জীবন, একটা মানুষ। তাকে পৃথিবীতে এনে ভোগানোর কোন অধিকার কারো নেই।

আর হে অসাধু ব্যবসায়ীরা! দয়া করে একটু দয়ালু হোন। মানুষ মেরে যে রোজগার আপনারা করছেন, তা আপনাদের জীবনে কোন শান্তি আনতে পারেনি, ভেবে দেখেন একবার। মিথ্যা, ঠকবাজির আয়, মানুষের হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের বদলে যে কিছু টাকা আপনারা পকেটে ঢুকিয়েছেন, তা কীভাবে বুমেরাং হয়ে আপনার জন্য কাজ করেছে, ভাবেন একবার। উন্নতি আপনার হয়নি। যদি হতো, তো বছরের পর বছর ঠকবাজি করতে হতো না আপনাকে। একবার সৎ পথে ব্যবসা করে দেখেন। মানুষকে জীবন দেয়াতে যে আনন্দ, তার আমেজ অফুরন্ত। প্লিজ প্লিজ প্লিজ দয়া করুন আমাদের বাচ্চাদের ওপর। সবাই মিলে ভেজাল খাবারকে ‘না’ বলুন।

লেখকের সাথে যোগাযোগের ঠিকানা:

[email protected]

শেয়ার করুন: