সবাই বলা শুরু করলে কী দাঁড়াবে?

দিনা ফেরদৌস:

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোন নারীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি, ভিডিও ভাইরাল হলে সমাজে তার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে যায়। অপরদিকে যেই কু-পুরুষের সাথে ভাইরাল হয় তার উপর সামাজিক, পারিবারিক কোন চাপ’তো থাকেই না, বরং বীরত্বের সাথে চলে সে। সমাজ তখন সেই মেয়েটির সাথে তার পরিবারকেও এমনভাবে চাপে রাখে যাতে লজ্জায়, ভয়ে পুরো পরিবার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কী কঠিন বৈষম্য!

সেই মেয়ে যদি সব ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চায় অথবা কেউ যদি তার পাশে এসে দাঁড়ায়, হাত ধরে, তবে সেই মানুষটিকেও পর্যন্ত হেনস্থা করে ছাড়া হয়। যার প্রমাণ আমরা অভিনেত্রী প্রভা, মিথিলার ক্ষেত্রে দেখতে পাই। তাহলে সহজেই বোঝা যায় কোন দৃষ্টকোণ থেকে রাজীব ও ইফতেখার আহমেদ ফাহমিদের মতো লোকেরা মিথিলা, প্রভাদের ছবি, ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন! যাতে সমাজের ধিক্কার শুনতে শুনতে ভয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে নাই হয়ে যান তারা, নষ্ট হয়ে যায় তাদের ক্যারিয়ার। ইফতেখার আহমেদ ফাহমির বা রাজীবের নাম কতজন মনে রেখেছেন, বা তাকে কোথাও কি কখনও এইভাবে যখন তখন আক্রমণ করা হয়? আমি অন্তত দেখিনি। এখনও ইউটিউবে এইসব ছবি পাওয়া যায়। বিষয়টি যদি গোপন থাকতো আর আমি জানতাম, গোপনই রাখতাম। সকলের জানা, দেখা ঘটনা তাই উদাহরণের খাতিরে নিয়ে আসা।

কিছুদিন ধরে আমরা সবাই মিলে কমবেশ মাতামাতি করছি জান্নাতুন নাঈম প্রীতির ” জন্ম ও যোনির ইতিহাস ”  বইটি নিয়ে। যেখানে তিনি জয়া আহসান, পরীমণি, গিয়াসউদ্দীন সেলিম ও ফারহানা মিলির নাম সরাসরি ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও আছে আরও অনেক লেখক, সাহিত্যিকের নাম। তুমুল বিরোধিতার মুখে বইটি ইতিমধ্যে বইমেলা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একজন লেখকের লেখা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হতেই পারে। তাছাড়া যাদের কথা লেখক বিনা অনুমতিতে প্রকাশ করেছেন, তারা যদি মনে করেন মানহানির মামলা দিবেন, সেটাও তারা পারেন, কিন্তু শুধু প্রীতিরই না, যে কারও বই, বইমেলা থেকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে। কারো কথার সাথে দ্বিমত থাকা, আর কথা বলার অধিকার বন্ধ করে দেয়া দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এতে ইগনোর করতে না পারার দুর্বলতাই প্রকাশ পায়।

এই সমাজে প্রতিদিন কোন না কোন নারী ঘরে বাইরে, কাছের মানুষ, দূরের মানুষ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, এমনকি বাচ্চারাও রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু সমাজের ভয়ে, ইজ্জতের ভয়ে পরিবারের লোকজন এইসব চাপা দিয়ে রাখে। একটাই ভাবনা থেকে যে হয় সমাজে মুখ দেখানো যাবে না, নয় বিয়ে দেয়া যাবে না। বিষয়টি এতোই সহজ যে চাইলেই যে কেউ যে কোন নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে  তার তথাকথিত ‘ইজ্জত’ লুটে নিতে পারে। ঠিক সেই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যখন কোন নারী বলেন, আমি কোন কাগজের সম্পর্ক ছাড়াই শুধু নিজের জৈবিক চাহিদা থেকে আনন্দের জন্যে বা ভালোলাগা/ভালোবাসা থেকে কোন একজনের সাথে বা অনেকের সাথে বিছানা শেয়ার করেছি, পারলে আমার ইজ্জত চলে গেছে বলে দেখ কী হয়! অথবা তোমাদের কাছে ইজ্জত চাইতে গেছে কে আর ইজ্জত দেবার বা নেবারই তোমরা কে, তখন এই সমাজের কলিজায় শুধু আঘাত-ই লাগে না, সাথে সাথে সমাজ এইসব কথার ওজন বহন করতেও ভয় পায়। কারণ সমাজ চায় ইজ্জতের ভয় দেখিয়ে মেয়েদের দমিয়ে রাখতে। যে মেয়ে যত ইজ্জতের তোয়াক্কা করবে, সে মেয়ে ততোই ভয়ে থাকবে, ততোই বহুগামী পুরুষদের পক্ষে ‘ইনটেক’ মেয়ে বিয়ে করা সম্ভব হবে। ততই ভয় দেখিয়ে সুবিধা নেয়া যাবে, কিন্তু ইজ্জতের ভয়ে মেয়েরা মুখ খুলবে না ভেতরে ভেতরে চুরমার হয়ে গেলেও। আর আমরাও জানতে পারবো না কোনদিন আমাদের বাপ, ভাই, স্বামী, ছেলের আসল চরিত্র। তারা সবসময় ফুলের মতো পবিত্র হয়েই থাকবেন।

প্রীতির এইভাবে কারো সাথে ইচ্ছাকৃত অন্তরঙ্গভাবে মিশে, গল্প করে তাদের নাম প্রকাশকে আমি সমর্থন আমি করি না। কারণ এটা প্রতারণার পাশাপাশি, মানুষের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যাবার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে আগামীতে।

বইটিতে কী কী লেখা আছে সবারই মোটামুটি জানা এখন। তারপরও একটু উল্লেখ করছি যে লেখা আছে গিয়াসউদ্দীন সেলিম পঞ্চাশ জনের উপরে মেয়েদের সাথে বিছানা শেয়ার করেছেন, যাদের অনেকের নামই উনার মনে নেই। ভাগ্যিস মনে নেই, নাহলে এতোক্ষণে তাদের সংসারেও লাল বাতি জ্বলে উঠতো। কিন্তু উনি যদি এখন সেইসব নাম মনে রেখে তালিকা ধরে সেই সময়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথাবার্তা লেখে ছাপিয়ে দেন, তো সেইসব মেয়েদের কী হবে, অন্যদিকে সেইসব মেয়েও যদি প্রীতির মতো করে বলা শুরু করে তাদের বিয়ের আগের মিউচুয়াল অন্তরঙ্গ মুহূর্তের গল্প, তো এই সমাজে কী ধরনের উলট-পালট শুরু হতে পারে, ধারণা করতেও শংকা হচ্ছে।

বহু মেয়েই হয়তো প্রেমিকের বাচ্চা পেটে নিয়ে সংসার করতে গেছে, বহু প্রেমিক জানে তাদের সন্তান বড় হচ্ছে অন্য লোকের পরিচয়ে, বহু পুরুষ পরিবারের চাপে অন্যকোন মেয়েকে বিয়ে করে এখন সহজভাবে সংসার করছে, জানাজানি হলে বর্তমান সত্যিকারের ভালো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এক নিমিষেই সব উলট পালট হয়ে যেতে পারে বহু গোছানো সংসার। বহু সন্তানই জানে না তার আসল পিতা কে, তারাও বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। মানুষের গোপনীয়তাকে রেসপেক্ট করতে না পারলে মানুষের উপর মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে, ভালোবাসার উপর থেকে ভরসা উঠে যাবে। অনেককে বলতে শুনি, সব নাটকের সংসার। যাদের মুখে এইসব শুনেছি, তাদের বেশিরভাগকেই দেখেছি, একটা সংসারের জন্যে ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে।

ব্যক্তি জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কচলাতে যাওযার মধ্য দিয়ে নারীবাদের আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। বহু নারীবিদ্বেষীর লেখায় দেখলাম যে নারীবাদ বিছানাবাদে পরিণত হচ্ছে এখন। কে, কার সাথে বিছানায় যাবে, কী গল্প করবে এইসব নিতান্তই দুজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সমাজের এখান থেকে কিছু শেখার নেই। কিন্তু যারা সত্যিই নারীদের উন্নয়নের জন্যে কাজ করছেন, এইসব মেসেজের মাধ্যমে তাদেরকে ভুলভাবে তুলে ধরা হচ্ছে সমাজে, তাদের কাজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

নারীবাদের উদ্দেশ্যই তখন বিশাল প্রশ্নের মুখে পড়বে। এরই মধ্যে পড়েও গেছে। আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, লম্বা লম্বা লেকচার দেয়া নারীবাদী নারীরা দুইদিন পর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে বলেন, সে আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তিনি আমাকে প্রেমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে হাউ কাউ করতে। আর ওইদিকে বলেন, একা আছি ভালো আছি। একা তো থাকতেই জানেন না, বরং আরেকজনের সংসার, বউ, বাচ্চাকাচ্চা আছে জেনেই তৃতীয় পক্ষ হয়ে ঢুকে যান অন্যের সংসারে। সেইসব পুরুষ আপনাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন বলে ভণ্ড, প্রতারক বলতেই পারেন। দিনশেষে যখন সেইসব পুরুষ নিজেদের সংসারে ফিরে যায়, তখন আবার ইগোতে লাগে।

মানলাম পুরুষরা ভণ্ড, কিন্তু এই যে সমাজে দেখান একা আছি ভালো আছি , এটা কি নিজের সাথে নিজের ভণ্ডামি নয়? দিনশেষে যদি সেই ভণ্ড পুরুষদের না পাওয়ার জন্যে হাহাকার করে মন, তাদের সাথে প্রতারণা বা ব্ল্যাকমেইলিং করে আটকে রাখার চেষ্টা করতে হয়, তাহলে তো সমস্যা। কেউই তো কম যান না। ওইসব ব্যক্তিগত ক্যাঁচালের দায় এই সমাজ নেবে কেন, যদি না ওখানে জোর জবরদস্তি না হয়ে থাকে। আর বিছানায় গিয়ে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করারও কিছু নেই। তাই যাই করুন নিজেদের মধ্যে রাখার চেষ্টা করুন, সেই সুন্দর মুহূর্তের প্রতি সম্মান রেখে।

সবাই বলা শুরু করে দিলে কেউ-ই শান্তিতে থাকতে পারবেন না। না নারী, না পুরুষ, কেউই না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.