‘ক্রীড়া লেখক সমিতি’র সম্মাননায় নারীরা নেই কেন?

মনজুরুল হক:

বাংলাদেশের সর্বস্তরে একটি স্লোগান ব্যাপকভাবে উচ্চারিত-নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর সমঅধিকার। এই স্লোগানের আড়ালে কী ঘটে সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না। এক লাইনে বলা যায়, আওয়ামী লীগের টানা ১৪ বছরের চ্যালেঞ্জহীন পাওয়ার প্রাকটিসের রেজিমে নারীর অপমান, অমর্যাদা, অবহেলা যতটা হয়েছে তা আগে কখনও হয়নি। এরই সর্বশেষ নজির রাখলো ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ক্রীড়া লেখক সমিতি’।

সমিতির ৬০ বছর পূর্তিতে স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে ‘দেশের সেরা ১০’ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব নির্বাচন করে সম্মাননা দিয়েছে তারা। এই তালিকায় প্রথম সাকিব আল হাসান, দ্বিতীয় কাজী সালাহউদ্দীন, তৃতীয় নিয়াজ মোর্শেদ। দ্বিতীয় হওয়ায় কাজী সালাহউদ্দীন সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাফুফে’তে তার আমলের অর্জন নিয়ে এখানে আলোচনার কিছু নেই। সেই ব্যর্থতা ‘দেশের সেরা ১০’ সম্মাননার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে এই তিনজন ছাড়াও আরও যাদের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, সেখানে একজনও নারী ক্রীড়াবিদ নেই! তবে কি বাংলাদেশে সম্মাননা দেওয়ার মতো কোনো নারী ক্রীড়াবিদ নেই? তাদের পাফরমেন্স কি এতোটাই বাতিলযোগ্য?

আসুন, দেখে আসি নারী ক্রীড়াবিদদের উপাখ্যান—

 

১. জোবেরা রহমান লিনু

টেবিল টেনিসে ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, জাতীয় পর্যায়ে সর্বাধিক বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য গিনেস বুকে স্থান পাওয়া। ১৯৭৩ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে জাতীয় পর্যায়ে টেবিল টেনিসে রানার্সআপ। ১৯৮০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান টেবিল টেনিসে পঞ্চম স্থান। ১৯৮২ সালে ভারতের হায়দরাবাদের পেন্টাদুলায় আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় ডাবলসে রানার্সআপ। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ টেবিল টেনিসের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বিটিসি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিযোগিতায় শিরোপা জয়। ১৯৮০ সালে এশিয়া চ্যাম্পিয়নশীপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেন।

 

২. মাবিয়া আখতার সীমান্ত

ভার উত্তোলনে ২০১৯ এসএ গেমসে স্বর্ণপদক। ২০১৬ সালে ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে ৬৩- কেজি শ্রেণীতে স্বর্ণপদক। ২০১৫ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন প্রতিযোগীতায় ৬৩- কেজি ওজন শ্রেণীতে সিনিয়র এবং জুনিয়র ক্যাটাগরীতে একটি স্বর্ণ পদক এবং দুটি রৌপ্য পদক।

৩. মাহফুজা খাতুন শিলা

২০১৬ সালে ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত ১২তম এসএ গেমসে ১০০-মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে সাঁতারে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক অর্জন। পুরস্কারের ঝুলিতে রয়েছে ২০০৭, ২০০৮ ও ২০১০ সালে ইন্দোবাংলা গেমসে স্বর্ণ জয়। ২০১০ সালে নেপালের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ প্রতিযোগিতায়ও স্বর্ণ জিতেন মাহফুজা। এছাড়া দেশ-বিদেশে আরও অনেক অর্জন তো রয়েছেই। প্রথম জীবনে খুলনা বিভাগে দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বিকেএসপিতে প্রথমে সাঁতারের চেয়ে দৌড়টাকেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। পরে কোচের পরামর্শে সাঁতারেই মনজয়।
ভারতের গুয়াহাটির ডক্টর জাকির হোসেন অ্যাকুয়াটিক কমপ্লেক্সে ৫০ মিটার ও ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকের দুটি ইভেন্টে সোনার পদক জিতে ইতিহাসে নাম লেখান শিলা।

৪. রাণী হামিদ

বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার। ১৯৮৫ সালে ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব অর্জন। তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন। তিনি ছিলেন দাবা অলিম্পিয়াডে প্রথম নারী যিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে অলিম্পিয়াডে জাতীয় পুরুষ দলের হয়ে খেলেছেন। ১৯৮৯ সনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাসেদ আন্তর্জাতিক মহিলা দাবায় যৌথ চ্যাম্পিয়ন হন রাণী হামিদ। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছয়বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হন। এছাড়া ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯২, ১৯৯৬,১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০১,২০০৪ ও ২০০৬ এ জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০০৬ পর্যন্ত তিনি মোট ১৫ বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেছেন। কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশীপ’২০১৫তে রাণী হামিদ বাংলাদেশের হয়ে স্বর্ণ পদক জয় করেন। দাবার বিশ্বকাপ খ্যাত “দাবা অলিম্পিয়াড”এ তিনি অসংখ্যবার বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ করে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

৫. বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে জিতেছে এশিয়া কাপের শিরোপা। প্রথমবারের মত ৫০ ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ২০০৭ সালে জুলাইয়ে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দলটির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। এতে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ দলের বিপক্ষে দু’টি খেলায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়েছিল। এরপর দলটি ২০০৭ সালের এসিসি মহিলাদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ও শিরোপা জয় করে। ২০১১ সালের মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রতিযোগিতায় ৫ম স্থান অধিকার করে। এর ফলে বাংলাদেশ দল নেদারল্যান্ডসের পরিবর্তে একদিনের আন্তর্জাতিকে খেলার মর্যাদা লাভ করে।

৬. বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল

নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে শিরোপা জয় সাবিনা-সানজিদা-কৃষ্ণাদের। ২০২০-২০২১

ক : এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৫, নেপাল। ২০ ডিসেম্বর ২০১৫
খ : এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৬
গ : এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ওমেন্স চ্যাম্পিয়ন্সশিপ ২০১৭, কোয়ালিফায়ার্স। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ফাইনাল। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
ঘ : সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ফাইনাল। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
ঙ : জকি ক্লাব গার্লস ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০১৮, হংকং। ১ এপ্রিল ২০১৮। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
চ : এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ওমেন্স চ্যাম্পিয়ন্সশিপ ২০১৯, কোয়ালিফায়ার্স, ঢাকা। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮। বাংলাদেশের মেয়েরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
ছ : সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮, নেপাল। ৭ অক্টোবর ২০১৮। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
জ: বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১৯, ঢাকা। ৩ মে ২০১৯। বাংলাদেশ অপরাজিত যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন।

এতকিছুর পরও ‘ক্রীড়া লেখক সমিতি’র রাডারে নারীদের এইসব সাফল্যগাঁথা ধরা পড়লো না! সেটা কি রাডারের দোষ, নাকি যারা এখানে আসন অলঙ্কৃত করে বসে আছেন তাদের মূর্খতা? দেশের অনেক ইনস্টিটিউটের মতো স্পোর্টস ইনস্টিটিউটগুলোও ভেঙে পড়েছে। সেসব জায়গায় অকাট মূর্খরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ক্রীড়া লেখক সমিতিই বা তার বাইরে যায় কী করে? তারা ‘বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন’ নিয়ে এতোটাই নিমগ্ন যে তাদের চোখে কেবল দুটো জিনিস ধরা পড়ে, এক—বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন’, কারণ এটাতে চাকরির পিলার মজবুত হয়। দুই—ক্রিকেট, কারণ এখানে চার্ম, টাকা, খাতির সবই আছে। নেট খুললেই শত শত লিঙ্ক থেকে ক্রিকেটের খবর পাওয়া গেলেও তারা চোব্য-চোষ্যসহ বিদেশ সফর করতে পারে। সেই বদান্যতায় তাদের প্রথম পছন্দ ক্রিকেট। আ গ্লোরিয়াস অনার গিভিং ইভেন্ট! ক্রিকেট ইজ আ হাই-ভ্যালু সেলেবল কমোডিটিজ!

জানুয়ারি ৩, ২০২৩

শেয়ার করুন: