রূপের বন্দনা নয়, শুধু সম্মানটুকু দিন

সাবিহা সুলতানা:

তন্বী শ্যামা শিখরি-দশনা পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যেক্ষামা চকিত-হরিণী প্রেক্ষণা নিম্ন-নাভি;!
শ্রোনীভারাদলস-গমনা স্তোক-নম্রা স্তনাভ্যাং
যা তত্র স্যাদ যুবতি-বিষয়ে সৃষ্টি রাদ্যের ধাতু;!

(সে তন্বী, সে শ্যামা, সুন্দর শিখর যুক্ত তার দাঁত, পাকা বিম্ব ফলের মতন তার ওষ্ঠ ও অধর, তার কোমর সরু, তার দৃষ্টি হরিণীর মত চঞ্চলা, গভীর তার নাভি, তার গতি নিতম্বের গুরুভারে শিথিল, স্তনের ভারে সে সামান্য ঝুঁকে রয়েচে- তুমি এরকম যাকে দেখবে, তোমার মনে হবে যুবতী সৃষ্টিতে সে-ই বিধাতার আদর্শ।- কালিদাস)

একজন নারীর আদর্শ দেহ সৌষ্ঠব বর্ণনায় কালিদাস এই শ্লোকটি রচনা করেছিলেন কয়েক শত বছর পূর্বে। সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত নারী মানেই পুরুষের কল্পনায় ঠিক এমনই কিছু কল্পনা, কিছু বাস্তবতায় মিশেল “অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা” টাইপের অদ্ভুত এক সত্ত্বা। এই অদ্ভুত জীবের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত হবে সবকিছু মনোলোভা, যা দৃষ্টি এবং আত্মার খোরাক জুগিয়ে যাবে সকল পুরুষের।

এখন কথা হলো বাস্তবিকই নারী কি এমন? আর এমন মনোহর হয়েও পুরুষের কাছে কি নারী শুধুই পূজনীয়? এতো স্তাবক যাকে নিয়ে তাকে তো কাছে পেলে তাকে মাথায় তুলে রাখা উচিত ছিলো পুরুষের। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অর্ধেক মানবী আর অর্ধেক কল্পনা যখন সারাদিনের সংসারের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর সারা শরীর এলিয়ে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ে, নয় মাস গর্ভধারণ করে স্ফীত উদর নিয়ে বমি করতে করতে দিনাতিপাত করে, কর্মজীবী হলে সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে নিজের সাইজের তিন গুণ ঢিলেঢালা জামা পরে এক কোলে বাচ্চা সামলিয়ে আরেক হাতে রান্না বান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন কোথায় ছিটকে পরে কালিদাসের সেই “তন্বী শ্যামা” বরং তার পরিবর্তে “শিখর দশনা” তখন প্রকট রুপ নেয় পুরুষের চোখে। বাস্তবতার ধাক্কায় নারীর সেই রমনীয় রূপ আর না খুঁজে পেয়ে রোমান্টিসিজম কোথায় হারিয়ে যায় পুরুষের কাছ থেকে।

অথচ নিজের কপালটিও যে ধীরে ধীরে চুলের অভাবে গড়ের মাঠ হতে শুরু করেছে, মেদ জমতে জমতে শার্টের নিচে নিজের ভুড়িখানাও যে অবাধ্যের মতো বেড়ে উঠেছে সেদিকে তাদের কদাচিৎ খেয়াল থাকে। আর তাদের সেদিকে খেয়াল থাকবেই বা কী করে, পুরুষের শারিরিক সৌন্দর্য বন্দনা নিয়ে তো আর কবি, সাহিত্যিকরা কোনো শ্লোক বা স্তাবক রচনা করেননি। কোনো নারী সাহিত্যিকও এগিয়ে আসেননি সেভাবে কখনোই। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে যে পুরুষ সেই পরিচয়ই তার যথেষ্ট, বাহ্যিক রূপে কিছু যায় আসে না। এই সমাজে শুধু নারীকেই রূপ দিয়ে নিজের মূল্য নির্ধারণ করতে হয়। পুরুষের সেই দায় নেই।

আর তাই সে যুগের কালিদাস থেকে শুরু করে এ যুগের কালিদাস আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদরা নারীকে শুধু বড্ড বেশি নারী হিসেবেই দেখতে চান। পেলব অঙ্গে বাঁকে বাঁকে আগুন ছড়িয়ে পুরুষের কাছে দৃষ্টিনন্দন পোশাকটিই নারীর পরিধান করা উচিত বলে মনে করেন। কারণ তাদের মতো আলোকিত মানুষের কাছে নারীর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য পুরুষের সামনে নিজেকে দৃষ্টিনন্দন হিসেবে উপস্থাপন করা।

তারা ভুলেই যায় এই নারীই সন্তান পালন করতে গিয়ে একাধারে কয়েক রাত্রি নির্ঘুম কাটানো সেই জননী যার ‘চকিত হরিণী’ দৃষ্টি কবেই রাতজাগা কালিমা লেপে বিবশ হয়ে গিয়েছে। এই “শ্রোনীভারাদলস- গমনা”র শ্লথ গতি কবেই ঝড়ো গতি হয়েছে সেই সাত সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলাতে, “পক্ক বিম্বাধরোষ্ঠি” শুকনো হাসির আড়ালে কত কষ্ট লুকিয়ে রেখে নিত্যদিনের এক একটি যুদ্ধ সামাল দিয়ে চলেছে, তার খোঁজ কয়জন রাখে? অথচ এটাও নারীর আরেক রূপ।

তাই জনাব আলোকিত স্যার, আপনার বন্ধ করে রাখা আরেক নয়ন এবার খুলুন প্লিজ। নারী মানেই শুধু আপনাদের মনোরঞ্জনের পণ্য নয়, তার ভূমিকা অনেক বিস্তৃত। তাকে তার যোগ্যতা দিয়ে বিচার করতে শিখুন। সে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপনা করবে এটা তার উপরেই ছেড়ে দিন। সে যে পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যেটা তার লাইফস্টাইলের জন্য সুবিধাজনক সে সেটাই পরবে, সেটা শাড়ি, সালোয়ার কামিজই, পাশ্চাত্যর পোশাক, অথবা তার স্ব স্ব ধর্মীয় পোষাকই হোক না কেনো।

একটি ভালো বই, একটি ভালো মিউজিক যেমন আত্মার খোরাক জোগায়, ঠিক তেমনি একজন নারী নিজের ভালো লাগার জন্যেই একটি সুন্দর পোশাক পরতে পারে, প্রসাধন করতে করতে পারে, নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। শাড়িও তাই একজন নারী নিজের ভালো লাগার জন্যেই পরতে পারে। নারীর সকল আয়োজন যে শুধু পুরুষের জন্য হবে এই ধারণা থেকে এবার একটু বের হয়ে আসুন।

কল্পনা থেকে বাস্তবতায় নেমে এসে নারীকে দেখুন। নারীকে যদি ভালোবাসতে হয় তবে গর্ভাবস্থায় তার স্ফিত উদরকে ভালোবাসুন, তার রাতজাগা চোখের নিচে পড়া কালিমাকে ভালোবাসুন, কর্মক্লান্ত মুখের ঘামকে ভালোবাসুন, শুধুই পেলব অঙ্গে শাড়ি জড়িয়ে রাখা কালিদাসের তন্বী শ্যামার দেহকে নয়। যদি নারীর এই রূপকে ভালোবাসতে পারেন তবে নারীকে সর্বরূপে সর্বপোশাকেই ভালো লাগবে।

গল্প, সাহিত্যে অনেক রূপের বন্দনা তো হলো, এবার নারীর প্রয়োজন তার যোগ্য সম্মান। সেটা করতে শিখুন, সর্বোপরি নারীকে নিয়ে সেক্সিস্ট, রেসিস্ট মন্তব্য ও মুখরোচক আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে একজন সতীর্থ মানুষ হিসেবে দেখুন, তাহলেই আমরা কৃতার্থ থাকবো। আর কিছুর দরকার নেই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.