মেট্রোরেলের প্রথম চালক মরিয়মের জন্য শুভকামনা

সুপ্রীতি ধর:

বাংলাদেশে মেট্রোরেলের নতুন যাত্রায় প্রথম চালক হতে যাচ্ছেন একজন নারী। তাঁর নাম মরিয়ম আফিজা, তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। আপাতত এটুকু খবরই জেনেছি, তাও ফেসবুক মারফত।

প্রথম চালক হিসেবে তিনি অভিনন্দন পাওয়ারই যোগ্য। তাই তাঁকে স্যালুট।

কিন্তু ফেসবুকে দেখলাম অন্য হাওয়া। সবাই মেয়েটার পড়াশোনা নিয়ে সমালোচনা করে বলছে, ‘রসায়নে পড়াশোনা করে, বা এতো পড়াশোনা করে যদি চালকই হতে হয়, তবে তো পুরো শিক্ষাই বৃথা’। ঘুষটুষ দেয়ার বিষয়গুলো বাদই দিলাম সমালোচনার টেবিল থেকে। মোটামুটিভাবে পড়াশোনার সাথে চালক পেশার মিল না পাওয়াটাই সমালোচনার অন্যতম বিষয়। এই জাতি পরীক্ষায় নকল করে পাশ করে ‘অফিসার’ হয়ে গাড়ি চালায়, বাড়ির মালিক হয়। যারা তা হতে পারে না তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এটা একটা সার্কেল। তথাকথিত সাফল্যের আর ব্যর্থতার। এর বাইরে আর কিছু নেই।

ফেসবুকে নিউজটা দেখে কেন জানি আমার মাথায় এসবের কিছুই আসেনি। শুধুই মনে হয়েছে, দেশে মেট্রোরেল এই প্রথমবারের মতোন যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে, সেই ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে যে বা যারা তাদের মধ্যে প্রথম চালক হিসেবে আছেন মরিয়ম। এবং তিনি একজন নারী। আমার এটুকুই ভালো লাগার বিষয়। রসায়ন পড়ে কেন চালক হবেন, বা ঘুষ দিয়ে চাকরি বাগিয়েছেন কিনা সেগুলো আমার মাথায়ই আসেনি। তিনি যে রেল চালানো শিখেছেন, সেটাকেই বরং আমি প্রশংসার চোখে দেখছি। বাংলাদেশে কয়টা মেয়ে এই কাজটা শেখে? এটা কি কোন সহজ, মামুলি কাজ? রসায়ন বা অন্য যেকোনো বিষয়ে পাশ করেও কেউ যদি মনে করে যে, না, আমি নতুন কিছু শিখবো, নতুন কোন পেশায় যোগ দেবো, তাহলে আপত্তিটা কোথায় আপনাদের?

বিদেশে এসে এই বাংলাদেশিরাই হেন কাজ নেই যে তারা করে না। প্রয়োজনে সেই বিষয়গুলোতে তারা ছোটখাটো কোর্স বা ডিপ্লোমা করে তারপর কাজে যোগ দেয়। তাহলে নিজ দেশে নয় কেন? মরিয়মকেও তো রেল চালানো শিখতে হয়েছে। নাকি সে স্নাতক পাশ দিয়েই রেল চালাবে? ও যে তার পড়ালেখা সংক্রান্ত পেশার সাথে খাপখাওয়ানো চাকরির জন্য বসে না থেকে এমন একটা চ্যালেঞ্জিং পেশাকে বেছে নিয়েছে, সেজন্য তাঁকে দ্বিতীয়বার স্যালুট।

দেশে এতো এতো মানুষ চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, অথচ একটু বুদ্ধি খাটালেই মানুষ অনেককিছু করতে পারে। নিজেরাই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কেন সেই সাবজেক্ট অনুযায়ীই কাজ পেতে হবে সবাইকে? যদি না পায় তাহলে কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? এই যে আমার এক ফেসবুক বন্ধু দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ এনে সারাদেশে তা অনলাইনে বিক্রি করছে, এটা কি ভালো কাজ না? নাকি এতে তার মা-বাবার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে?

উন্নত দেশগুলোতে ১৫ বছর থেকেই কাজ করতে শুরু করে ছেলেমেয়েরা। সেই সুযোগও তাদের জন্য রাখা আছে। সামারে কাজ করে যে টাকা আয় করে তা দিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেয় পুরো বছর। খুব কমসংখ্যকই যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে। কারণ তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য ছোটবেলাতেই ঠিক করে ফেলতে পারে। আর কোন কাজই ফেলনা না ওসব দেশে। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কয়েক বছর কাজ করার পর যদি মনে হয় যে ‘যথেষ্ট হয়েছে, এবার অন্য কাজ করবো’, সেই সুযোগও আছে। আবারও ফিরে আসতে পারে নিজের স্বপ্নমতোন কাজে।

আমাদের দেশেও তো এখন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে বিভিন্নক্ষেত্রে। বিশেষ করে করোনা-পরবর্তিতে অনেক যুবক-তরুণদেরই দেখছি উদ্যোক্তা হয়ে নানান কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে। খুব ভালো লাগে এসব দেখলে। গতকাল দেখলাম গ্রামের এক তরুণ ছেলে দয়াল চন্দ্র বর্মণ তার বাবার সাথে কৃষিকাজ করে আর তা নিয়েই ইংরেজিতে ভ্লগ বানায়। তুখোড় ইংরেজি বলে। কে জানতো ওর ভিতরে এই প্রতিভা আছে যদি সে নিজেই তার চর্চা না করতো?

লেখাপড়া শিখে বাড়িতে বসে সবার মাথা নষ্ট করার চাইতে নিজের হাতে জীবনটাকে চালানো শেখাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। ড্রাইভিং শিখে মানুষ শুধু প্রাইভেট গাড়ি বা অফিসের গাড়ি না, বাস-ট্রাক সবই চালাতে পারে। একজন শিক্ষিত মানুষ যখন এসব পেশায় আসবে তখন আপনা থেকেই পরিবেশ পাল্টে যাবে। বিশেষ করে মেয়েরা যখন চালকের আসনে বসবে তারা খুব শান্তচিত্তে তা চালাবে। দুর্ঘটনাও ঘটবে কম। ঘণ্টাভিত্তিক এসব চাকরিতে ভালো বেতন, ছুটি, অবসর সবকিছু নিশ্চিত করাটা সরকার তথা নিয়োগকর্তাদের দায়িত্ব। মুখে বলবে দেশ সিঙ্গাপুর বা লস এঞ্জেলেস হয়ে গেছে, আর কাজের ক্ষেত্রে তা হবে ‘লামাপাড়া’ টাইপের, তাতো হবে না।

সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার

শিক্ষিত মেয়েরা ঘরে বসে থাকে কবে, কখন, তার পছন্দসই চাকরি পাবে সেই আশায়। কেন রে বাবা! চাকরিজীবী পরিবারগুলোর বাচ্চাদের দেখাশোনা করাটাও তো পার্টটাইম চাকরি হতে পারে কারও কারও জন্যে! আমাদের মান্দি মেয়েরা অনেকেই তা করছে। তারা বাসায় হেল্প করার কাজটাও চাকরি হিসেবে নিচ্ছে। বৃদ্ধনিবাসে, বা ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোতেও কাজ করা যেতে পারে। বড় বড় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন এসব ডে-কেয়ার, বৃদ্ধ নিবাস গড়ে তুলতে, আর সেখানে কাজ করবে আমাদের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বা ঘরে বসে থাকা মা-বোনেরা। উপার্জন করবে নিজ হাতে।
এরকমটাই কি হওয়া উচিত না?

চালক মরিয়মকে আমি সাধুবাদ জানাই যে তিনি এই কাজে নিজেকে ব্যাপৃত করেছেন। তাঁর আরও সমৃদ্ধি কামনা করি। মানুষের কথায় যেন ঝরে না পড়েন, সেই আশাটুকু রাখতে চাই।

সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার

শেয়ার করুন: