এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার

ফারদিন ফেরদৌস:

একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ চোখের সামনে ঘোষণা দিয়ে মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে বলে গেলেন এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। এটা টেকনিক্যাল মার্ডার।

মেয়েটি মরে গিয়ে মানবীয় সভ্যতার মুখে খসখসে ঝামা ঘষে দিয়ে গেলেন। সহপাঠী ইভটিজার আম্মান সিদ্দিকী ও তার দোসর সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কালিমালিপ্ত মুখ জাতিকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। পুরুষতান্ত্রিকতা বিকৃত মানসিক রোগ। সেই অসুখে আক্রান্তের সবিশেষ উদাহরণ এখন আম্মান ও দ্বীন। এই আম্মানেরা কেবলমাত্র নারী বলে ফাইরুজকে ক্রমাগত হয়রানি করে গেছেন, কোণঠাসা করে রেখে অবদমিত যৌন জিঘাংসা বাস্তবায়নের অভিপ্রায় দেখিয়ে গেছেন। আর এমন অশুভ দাবানলে অক্সিজেন সরবরাহ করে গেছেন প্রক্টর নামের তথাকথিত শৃঙ্খলা রক্ষক! এই প্রক্টর একজন শিক্ষক বটে। তার কাছে সন্তানসম নারী শিক্ষার্থীরা চরমভাবে অনিরাপদ নয় কেবল, রীতিমতো মৃত্যু ভয়ে বিধ্বস্ত।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা খুব স্পষ্টভাবে তাঁর মৃত্যুর জবানবন্দি দিয়ে গেলেন। কী পাগলাটে ও বিকৃত মননজাত সমাজ আমরা কায়েম করেছি। যেখানে বিচারহীনতা এখন প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। অবন্তিকা জীবদ্দশায় ন্যূনতম বিচার পাননি। বোধ করি এখনও পাবেন না। অবন্তিকার সতীর্থ সহপাঠীরা কয়দিন বিচার চেয়ে আহাজারি করবেন। সেই প্রতিবাদী আন্দোলনকেও সহসাই রাজনৈতিক মোড়কে আবৃত করে স্তিমিত করে দেয়া হবে। উপাচার্য সাদেকা হালিম ক্ষমতার সাথে সুর মিলিয়ে বলবেন, ‘আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব বলে সাময়িক বহিষ্কার করেছি, আমি আর কীইবা করতে পারি?’
অথচ ফাইরুজ খুব স্পষ্টভাবে তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে জানিয়ে গেছেন, ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।’

“(কাপুরোষোচিত অপ্রকাশযোগ্য ‘খ’ বর্গীয় শব্দ) তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলছস কেনো? তোরে যদি এখন আমার জুতা দিয়ে মারতে মারতে তোর ছাল তুলি তোরে এখন কে বাঁচাবে?” -এটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কাম প্রক্টরের ভাষা। সত্যিকারের সভ্যতা যদি এই পরগণায় বেঁচে থাকত তবে এতক্ষণে এই প্রক্টরের উদ্ধত ফ্যাং চেপে ধরে বিষদাঁত ভেঙে ফেলা হতো।

একটা জীবনের অমূল্য প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা খুব সহজ কাজ নয়। মা বাবা শত জ্বালাযন্ত্রণা সয়ে নিয়ে গভীর মমতায় সন্তানকে বড় করে তোলেন। সেই সন্তানের এমন অপঘাতে অকাল মৃত্যু কারো পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। ফাইরুজ অবন্তিকাকে নিজের সন্তানের জায়গায় রেখে একবার ভাবি তো, মায়ের বুকে কী ঘটে চলেছে এখন। তাঁর চোখের জলেরও তো ঝর্ণাধারা বইবার একটা সীমা আছে। সম্প্রতি স্বামীহারা এই মা জননী কিভাবে নিজেকে প্রবোধ দেবেন।

সংশয়হীন ও নিঃসন্দেহে আমাদের এই কন্যাটি একজন মেধাবী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছিলেন। পড়ছিলেন আইন নিয়ে। একদিন নিজেই বড় বিচারক হয়ে উঠতে পারতেন। অথচ এমন পুষ্পের মতো সুন্দর মানুষটিকে অঙ্কুরেই বিচারহীনতার ঘেরাটোপে বন্দি করে অন্যায্যতার গিলোটিনে মেরে ফেলা হলো। এ দায় আমাদের সকলের। আমরা তো ন্যুনতম মানবিক সমাজ কায়েম করতে পারি নাই। এখানকার যৌন বিকারগ্রস্ত অধিকাংশ কাপুরুষেরা নিজের লালসা দিয়ে বোধ ও বিবেক মাপে। জ্ঞান দিয়ে আবেগ অনুভূতি পরিচালিত করে না। বিচারহীনতার অলক্ষুনে সংস্কৃতি ও লাগামহীন ক্ষমতার দম্ভ এদেরকে এতোটা বেপরোয়া করেছে।

মেয়েটি ইবলিশ ও তার বশংবদদের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার সাথে পেরে উঠেননি। ফাইরুজ তাঁর ফেসবুকের ‘বায়ো’তে লিখে রেখেছেন Ever high is my head- চির উন্নত মম শির। সত্যিকার অর্থেই মাথা উঁচু করে বেঁচে রইলেন অবন্তিকা। লজ্জা ও গ্লানিতে আমাদেরই সবার মাথা এখন হেট।

ফাইরুজ অবন্তিকার শেষ লাইন ‘এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতারও’ -যেন আমাদেরই সবার মনের কথা। কার্যত আমরা সবাই কি অমন কৌশলগত ভীতিকর মৃতাবস্থায় আটকে পড়িনি? এখন এই অন্ধকার ভয়াল ভূমিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কোনোদিন মুক্তির গান শোনাতে আসবেন না…

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥
দেহমনের সুদূর পারে
হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে॥
আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।
বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা–
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে।

লেখক: সাংবাদিক
১৬ মার্চ ২০২৪

শেয়ার করুন: