একবার হলেও প্রজাপতি হতে চাই!

ফাহমিদা খানম:

বিশাল পৃথিবীতে কতো জীবন যে অপচয় হয়! কতো দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়ায় পৃথিবীর বুকে কেউই জানে না। সব ক্ষত কি আর চোখে দেখা যায়? আজকাল অনুভব করার মানুষ কই, সবাইতো আমার আমিকে নিয়েই ব্যস্ত।

“মা, তুমি এসব উটকো ঝামেলা কেনো বাসায় আনো? আজীবন তোমার এসব কাজে আমরা বিব্রত হয়েছি, এটা বোঝার মতো ক্ষমতা কি এখনও হয়নি তোমার?”
“আমি আবার কী ভুল করলাম?”
“কাকে জিজ্ঞেস করে বুয়াকে বাচ্চাসহ বাসায় রেখেছো?”
“নেশাখোর জামাইটা দুইদিন পর পর এতো মারে, তাই বলেছি ঐ ব্যাটার সংসার না করে গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে যেতে। একটু সুস্থ হলেই মেয়েটা চলে যাবে।”
“বুয়াকে তার স্বামী মারুক, কাটুক, যা ইচ্ছা করুক, আমাদের কী? আজ তার জামাই সিকিউরিটির সাথে ঝগড়া করেছে, কাল এসে মারামারি করবে। তোমার বউমা অনেক বিরক্ত তোমার এসব কাজে”।
“কেউ নেই বলেই জায়গা দিয়েছি, ঘরের এককোণেই তো পড়ে আছে, তাতে কার কী সমস্যা হচ্ছে?”
“প্লিজ, এসব ঝামেলা আর কখনও এ বাসায় আনবে না। অন্যের সমস্যা দেখা আমাদের দুজনের একদম পছন্দ না।”

স্তব্ধ হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই মুখের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেলাম, রক্তের টান বলে কথা! সার্টিফিকেট ছেলের অবস্থার পরিবর্তন করলেও মানসিকতা বদলাতে পারেনি। আসলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ধরে শিকড় হয়তো এভাবেই মানুষ বয়ে চলে!

প্রতিষ্ঠিত পাত্র পেয়ে বাবা এক মুহূর্ত দেরি করেননি। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে ছিলাম। তখন আসলে সেই যুগে বাবা-মা মেয়েদের মতামতের চেয়েও নিজেদের পছন্দকেই দাম দিতেন । বিয়ের পর কিছুদিন শ্বশুরবাড়ি ছিলাম ইন্টার পরীক্ষা দেবার পর মফঃস্বল থেকে সংসার জীবন করার জন্য ঢাকাশহর রওয়ানা দিলাম। ট্রেনেই টের পেয়েছিলাম দুজনের মানসিকতার দুরত্ব ঠিক রেললাইনের মতোন ! বয়স্কা দুইজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের সিট ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে সবাইর সামনেই সে কি ধমক ! গাঁটেরপয়সা খরচ করে টিকিট কেটেছে কি অন্যকে সিট ছাড়তে? ধমকের ভয়ে বসলেও ঘৃণায় মন ভেঙ্গে গিয়েছিলো । শুরুটা ছিলো এভাবেই।
” শোনো বুয়ার বাচ্চাটার অনেক জ্বর তাই কিছু টাকা আগাম চাইছে হাসপাতালে নিবে”
“দুইদিন পর পর এসব ঝামেলা ভালো লাগেনা এর আগের টাকাপয়সা কি শোধ হইছে? ”
“এ মাসেই শেষ হবে তখন ওর স্বামী পা ভেংগেছিলো ”
“রানু এসব মানুষকে কেনো বিশ্বাস করো? এরা মিথ্যা কথা বলে টাকা নেয় কবে বুঝবে তুমি? ”
সংসারের সব টাকাপয়সা ওর কাছেই থাকতো বন্ধুদের সামনে হেসেহেসে বলতো তার বউটা নাকি খুব বোকাসোকা তাই সংসারের সবদিক তাকেই সামলাতে হয় ।বউয়ের হাতে টাকাপয়সা দিলে নাকি না খেয়ে মরতে হবে এমন বোকাসোকা বউ নিয়ে সংসার করা যে কতো যন্ত্রণার! খুব আনন্দ করে বউয়ের বোকামী নিয়ে সবার সামনেই বলতো আর আমি সবার সামনে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম , স্ত্রীকে ভালবাসা দেখানোর চেয়ে সম্মান করাটা ও জরুরী স্বামী লোকটা কখনওই বুঝেনি । মেকী ভালোবাসা দেখানোতে আমি বিশ্বাসী ছিলাম না তবে হ্যাঁ মানুষকে বিশ্বাস করে মাঝেমধ্যে ঠকেছি তবুও কেন জানি বিশ্বাস হারাতে পারিনি। বড়ো ছেলে ছিলো পেটে কেউতো ছিলো না বুয়াটা খুব দেখেশুনে রাখতো বাচ্চা হবার আগে শ্বাশুড়িমা আর ননদ এলো বাসায়।
“ও কি বউমা তুমি মাছের লেজ খেয়ে বুয়াকে ভালো টুকরো দিলে? ”
“একটু ভালো খাবারের জন্যই ওরা মানুষের বাসায় কাজ করে আম্মা ”
খাবার টেবিলে সবাইর সে কি হাসি আমার বোকামো নিয়ে , শুনলাম নিজের ভালো নাকি পাগলেও বুঝে ! স্বামী ও বলে বসলো আমি নাকি নিজের ভালো বুঝিনা তাকেই সবকিছু খেয়াল রাখতে হয় ! আসলে কোন কাজ কার কাছে কি অর্থ নিয়ে আসে জীবনভর এটাই বুঝে উঠতে পারিনি আমি।
স্বামী প্রতিষ্ঠিত হতে সময় নিয়েছে কিন্তু ঢাকা এনে আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়েছিল সবাই বাহবা দিতো বিশেষ করে ওর বন্ধুরা। ততদিনে দুই বাচ্চার মা আমি কিন্তু যখন পড়াশোনা শেষ করে নিজ পায়ে দাঁড়াতে চাইলাম ঠিকই স্বভুমিকায় নামলো –
“কিসের জন্য চাকুরী করবে তুমি? আমি কি তোমাকে খাওয়াতে পরাতে পারছিনা ? ”
“বাচ্চাদের স্কুলেই টিচার নিবে আর ওরা স্কুলে গেলে আমিতো বাসায় একাই থাকি ”
“সংসার আর সন্তান দেখাশোনা করাই মেয়েদের আসল কাজ ”
” ইন্টার পাশ ছিলাম সেইতো ভালো ছিলো এতো কষ্ট করে কেনো পড়ালিখা করলাম? ”
“রানু আমার অন্য বন্ধুদের বউরা কেউ এমএ পাশ করেনি, আমিতো গর্ব করে বলতে পারি আমার বউ এমএ পাশ আর আমিই তাকে পড়িয়েছি”
মুগ্ধ হয়ে আবিষ্কার করেছি আসলে আমাকে স্বনির্ভর করতে নয় স্রেফ বাহবা পেতেই এসব। বাহিরের থেকে মনে হবে খুবই কেয়ারিং একজন মানুষ কিন্তু স্ত্রী হিসাবে আমি জানতাম আমার মুল্য কতটা! নিজের শারিরীক, রাঁধুনি আর বাচ্চার জন্ম দেবার জন্য বিয়ে এর বাহিরে কিইবা মুল্য ছিলো! পল্লীকবি জসিমউদদীনের কবিতার সেই পংত্তি দুটো —
” হাতে তারে মারিতো না বটে
ঠোঁটে যে মারিতো শতত”

প্রতি ম্যারেজ ডে’তে বন্ধুবান্ধব দাওয়াত দিয়ে আমার জন্য সারপ্রাইজ রাখতো কিন্তু সারাদিন অনেক মানুষের রান্নাবান্না করে আমি ক্লান্ত হয়ে যেতাম আর এসব মেকী লোকদেখানো জিনিস আমার ভালো লাগতো না- দুজনার একান্ত সময় বরং অনেক মধুর ছিলো আমার কাছে। পার্কে হাঁটা কিংবা সিনেমা দেখতে যাওয়া পছন্দ করতাম প্রকৃতি খুব টানতো আমাকে। কতো চেয়েছি বলদা গার্ডেন আর আহসান মঞ্জিল যেতে! ওর আবার বেরুতে ভালোই লাগতো না বলে যাওয়াই হয়নি আর ।
“তুমি এমনতর কেনো রানু? জানো আমার বন্ধুপত্নীরা সবসময় কি বলে? ভাই ভাবির কপাল আপনার মতন স্বামী পেয়েছে আপনি কতো কেয়ারিং স্বামী! ”
খুব বলতে ইচ্ছে করতো সেটা বাহিরের মানুষের সামনে নিজেকে জাহির করতে , ব্যক্তি তোমাকে আমি অন্তত বুঝে গেছি অনেক আগেই অনেক কিছুই আসলে বুকের ভেতরে থাকে কিন্তু মুখ ফুটে আর বলা হয়না ।
আসলে সাথে নিয়ে ঘর করলেও আমার আমিকে ও বোঝেনি কেবল চাপিয়ে গেছে নিজের পছন্দনুয়ায়ী। সংসারের চেনা ছকের বাহিরেও যে কেউকেউ থাকতে পারে এটাইতো বুঝেনি।

ওর জগতের মহিলারা শ্বাশুড়ি ননদের সাথে ঝগড়া করে পরচর্চা করে আনন্দ পায়, টিভি দেখে আর স্বামীর সাথে ঘুমায়। অকারণ চেঁচামেচি আর অকারণে জটিলতা করতো ওর বোনেরা ভাইয়ের সাফল্যে তাদের অবদান শুনাতো । আমি আসলে এসব চুপচাপ শুনতাম বলেই কি ওরা এসব বলে আনন্দ পেতো নাকি আমার অবস্থান কোথায় সেটা বুঝিয়ে ? এরা সবাই সব পরিস্থিতিতে চেঁচিয়ে আনন্দ পেতো আর আমি ছিলাম নির্বাক শ্রোতামাত্র ! নিজেকে বিকশিত করার বদলে বিশিষ্ট করার এই গুণপনা আমার কখনওই ভালো লাগেনি সবচেয়ে বড় কথা স্বামীও বুঝেনি বরং আজীবন বলে এসেছে আমি নাকি সৃষ্টিছাড়া মেয়েমানুষ! অন্য যেকোন মেয়েমানুষ নাকি এটুকু পেলেই কৃতার্থ হয়ে যেতো। আচ্ছা সংসারে যে সবাই একইরকম হয় না এই সহজ সত্যটা কেনো বোঝেনি? নাকি আমারই ভুল আমিই সবার মতন হতে পারিনি!

“চলো ঈদের শাড়ি কিনতে যাই? ”
“রোজা রেখে বের হতে ইচ্ছা করে না, তুমি বাচ্চাদের জন্য কিনে নিয়ে এসো আমি পরে কিনে নেবো।”
পাশের বিল্ডিং এর দারোয়ান যখন ছেলেকে নিয়ে দোয়া চাইতে এলো মুখ দেখেই বুঝেছিলাম ঝড়ের আভাষ।
“আমি কি দারোয়ানের ছেলের ফরম ফিলামের জন্য টাকা দিয়েছি তোমায়? রানু, এভাবে আমার টাকাপয়সা নষ্ট করার অধিকার কে দিয়েছে? ”
সেইদিন বুঝেছিলাম যার নিজের পায়ের নিচে ভিত নেই, অন্যের দয়ায় জীবন চলে, তার আসলে এসব আদিখ্যেতা মানায় না। নিজের কিছু না থাকলে অন্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ভুল। চোখে আঙুল তুলে দেখানোর পর ভেতরে ভেতরে ক্ষয়েছি। দুইদিন পরেই বউকে সারপ্রাইজ দিতে লাল টুকটুকে শাড়ি এনেছিলো, আমার ছুঁতেই ইচ্ছে করেনি। দয়া করে দেয় নুন, ভাতে মারে পাঁচগুণ –কথাটার অর্থ বুঝেছিলাম যে!

একদিন অফিস থেকে খবর এলো মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন উনারাই হাসপাতালে নিয়েছিলো। স্ট্রোক করে এক সাইড অবশ হয়ে গিয়েছিলো। দুই ছেলে একটু বড় হলেও মেয়েটা তখনও ছোট। ওর অফিস থেকে টাকাপয়সা তুলতে গিয়ে কতো যে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছি! বুঝেছি নারী ঘরে-বাইরে কতোভাবে যে নিগৃহীত হয়! নারী মানেই যুদ্ধ- কী ঘরে কী বাইরে! চিকিৎসায় এতো খরচ হচ্ছিলো বলে নিজে থেকেই পাড়ার একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকুরি নিয়েছিলাম। বাড়িওয়ালা নিজেই ছিলেন স্কুলের সেক্রেটারি।
শুরু হলো আরেক যুদ্ধজীবন। ভোরে উঠে সব গুছিয়ে স্কুলে যেতাম বাসায় ফিরেই শুরু হতো সাংসারিক কাজ। স্কুলে যাবার সময় সামান্য পাউডার বা কাজল দিলেই বাজে কথা বলতো –শারীরিক অক্ষমতার রেশ মিটিয়ে নিতো মুখে।
“আজ ফিরতে দেরি হলো কেনো?”
“মিটিং ছিলো, তাই একটু দেরি হয়ে গেলো।”
“রানু, মিটিং ছিলো নাকি আড্ডা ছিলো? আর এখন থেকে ক্লাসেও বোরখা পরে যাবে তুমি।”
কথা না বাড়িয়ে সংসারের কাজকর্ম করতাম, টাকা বাঁচানোর জন্য তখন বুয়া রাখার বিলাসিতাও বাদ দিয়েছি, আর রাত জেগে খাতা দেখতাম।

“মা, বাবা তোমাকে সেই কখন থেকে ডাকছেন, আর তুমি টিভি দেখছো?”
“বাবা কেনো ডাকছেন সেটা শুনে এলেই পারতে।”
“ওটা তোমার কাজ মা।”
বাচ্চারাও ধরেই নিয়েছে সব দায়িত্ব কেবল আমারই। আমিও যে একজন মানুষ, আমারও যে ইচ্ছে হয়, কই কেউতো বোঝেনি! স্কুলের চাকুরি, সংসারের সব কাজ, রোগীর সেবা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠতাম, তবুও কোথাও যাবার উপায় ছিলো না। বিদেশ যাবার সূত্রে এক চাচাতো দেবর বাসায় ছিলো কয়েকদিন। দেবর-ভাবির ঠাট্টা শুনে ও একদিন রাতে বলেছিলো, আমি নাকি চরিত্রহীনা। স্বামী বিছানায় পড়ে আছে বলে অন্য পুরুষের কাছে ঘেঁষতে পাগল হয়ে গেছি। শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছি। এতোই সহজ নোংরা অপবাদ দেয়া! বুকের ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে গিয়েছিল। তারপর স্বামীর উপরে তীব্র অভিমান করে নিজেকে খোলসে পুরেছিলাম। আস্থা আর বিশ্বাস যেখানে এতো হাল্কা, সেখানে কিইবা করার ছিলো?

পাঁচ বছর ভুগে ও চলে গেলো। এই পাঁচ বছরে আমাকে অমানষিক যন্ত্রণা দিয়েছে। ওর ভেতরের সন্দেহবাতিকতা আমি পারিনি দূর করতে। গাজিপুরে একটা জায়গায় বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছিলো। উকিল ডেকে সেই বাড়ি তিন সন্তানকে দিয়েছে। আমি জানিইনি। হয়তো ব্যর্থতা আমারই। বিশ্বাসযোগ্যা যে হতে পারিনি! আমাকে হয়তো ভালবেসেছিল, কিন্তু পাঁচ বছরের তিক্ত স্মৃতি আগের সব ভালো কাজকে মুছে দিয়েছিল। কতো কষ্টেসৃষ্টে দিন পার করেছি! সবসময়ই নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম বাচ্চারা বড়ো হলে আমার সুদিন আসবেই। কী যে বোকা ছিলাম আমি! আজীবন অবাস্তব কল্পনাই করলাম কেবল!

তবে দিন এখন পাল্টেছে, আগের সেই অভাব নেই। দুই ছেলে পড়াশোনা শেষ করে নিজ পছন্দে বিয়েও করেছে। বড় ছেলেটা এখন নিউজার্সিতে আছে। খুব আগ্রহ করে একবার নিয়ে গিয়েছিল। আগ্রহের জায়গাটা যদিও ছিলো দুই বাচ্চাকাচ্চা পাহারাওয়ালা বিশ্বাসী একজন। দুজনেই লম্বা সময় ব্যস্ত থাকে, বোবাকালা হয়ে ছয়মাস ছিলাম। তারপর আবারেও দেশে ছোট ছেলের কাছে। আগ্রহের বিষয়টা জানার পর মন ভেঙ্গে গিয়েছিল, আর সেইসাথে একাকীত্ব তো ছিলই।

“মা, তুমি ইচ্ছে করলেই ভাইদের বলে সমান অংশ দিতে পারো আমাকে, আর বড়ো ভাইয়ের অংশ তো ছোড়দা একাই ভোগ করে।”
“বাড়ির অংশ তোমার বাবাই ভাগ করে গেছেন।”
তবুও মেয়ের কথা শুনে ছেলেদের বলেছিলাম– দুজনেই সাফ জানিয়ে দিলো বোনের বিয়েতে খরচ হইছে অনেক, আর বড়ছেলে ছোট ভাইকে টাকাটা দেয় মায়ের জন্যই।

“মা, প্রতিবছরই কি মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ইফতারি পাঠাতে হয় নাকি?”
“বাবারে, মেয়ে যখন আছে, কিছু লৌকিকতা মানতেই হবে”
“তার মানে আপনি ইংগিতে বোঝাতে চাইছেন আমার মা-বাবা আমার জন্য কিছু করেন না, এইতো!”
“বৌমা, আমি কিন্তু তা বলিনি। একই শহরে আছি, আর মেয়েটা আশা করে, তাই একটুআধটু করতেই হয়!”
“তোমার বৌমা তো ঠিক কথাই বলে মা, কই আমরা তো কিছু পাবার আশা করি না। বলো যে তোমার মেয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে চলতেই জানে না”।
“মা, শ্বাশুড়ি সবসময় খোঁটা দেয় ভাইয়েরা আমার জন্য তেমন কিছুই করে না।”
“আমি যতটুকু পেরেছি করেছি, বাড়তি কোত্থেকে দিবো?”

মেয়ের মুখে আর হাসি ফুটে না। জয়েন্ট পরিবারে অন্য বউদের সাথে টেক্কা দিয়ে সে সবার উপরে থাকতে চায়। মায়ের অক্ষমতা বোঝার চেয়ে নিজ স্বার্থই তার কাছে বড়ো। আচ্ছা নিজের জিনিস কথাটার অর্থ কী? আসলে কিছুই না।
“বৌমা, মেয়েটাকে বের করেই দিলে? ওর যাওয়ার কোন জায়গা কিন্তু ছিলো না।”
“এসব উটকো ঝামেলা আমার সংসারে চলবে না।”

স্তব্ধ হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম কী জোর দিয়ে বললো, ‘আমার সংসার’! ভালো লাগলো শুনে এই জেনারেশন এটা অন্তত বলতে পারে। আমাদের যুগ কেটেছে অনিশ্চয়তায়, নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েও ভয়ে ভয়ে কেটেছে। আগে শ্বশুরবাড়ির মন যুগিয়ে চলেছি। তারপর স্বামীর আর এখন ছেলে বউয়ের। ছেলের সংসারেও আছি পরগাছার মতোন। দুজনে চাকুরি করে বলে তাদের সংসার আর বাচ্চা দেখি, কিন্তু সেখানে শ্রদ্ধা কই? আমার ভালো লাগা মন্দলাগা দূরে থাক তাদের মন যুগিয়েই চলতে হয় আমাকে। ভালোবাসা পরের ব্যাপার, প্রাপ্য সম্মানইবা জোটে কয়জনের? সবাইতো মরণোত্তর সম্মানই পায়। জীবিত মাকে অবহেলা করে মৃত মাকে নিয়ে স্মৃতিরোমন্থন চলে।

জীবনের আট/দশটা প্রয়োজনের মতো সংসার জীবন করে গেছি জীবনকে উপেক্ষা করে চলা সম্ভব নয় বলে। বারবার শুধু হেরেই গেলাম জীবনের কাছে। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা সন্তানরা মাকে বোঝেইনি, কী বোকার মতো আশা করেছিলাম আমার শূন্যতা, কষ্টগুলো একদিন ওরা অন্তত ঠিকই বুঝবে! আমি কাকে গিয়ে বলবো আমার শরীরের অংশগুলোও আমায় বোঝেনি!

হঠাৎ করে মনে পড়লো সেই যে স্বামীর উপর অভিমান করে নিজেকে খোলসে পুরেছিলাম আর বেরুতেই পারিনি। শুঁয়োপোকা হয়েই রইলাম প্রজাপতি আর হওয়া হলোই না। জীবনভর সবার মন যুগিয়েই চলেছি, বাবা-স্বামী আর এই মধ্যবয়সে ছেলেদের। এটাই কি নারীজীবন? নারী সংসারে বেঁচে থাকে অন্যের প্রয়োজন হয়ে নিজের জন্য বাঁচা হয় কি তাদের?

স্কুলে চাকুরি করার সময় জোহরা নামে এক আপাকে চিনতাম, বাবার মৃত্যুর পর ভাইবোনকে মানুষ করতে গিয়ে আর বিয়েই করেননি। পুরষ্কার হিসাবে ভাইবোনেরা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে। মাঝেমধ্যে কথা হয় ফোনে আমার সাথে। উনি নাকি সত্যিই ভালো আছেন সবার অনুগ্রহ করুণা আর গলগ্রহ না হয়ে।

নিজের দিকে অনেকদিন পর তাকালাম – এতোগুলো বছর বয়ে বেড়ানো খোলস থেকে যে আমারও বের হবার সময় হয়েছে! এতোকাল ছিলাম সবার প্রয়োজন হয়ে, এবার না হয় নিজের জন্যে একটু বাঁচি! সংসারকে সময় দিতে গিয়ে নিজেকে আর কখনও সময়ই দেয়া হয়ে উঠেনি। কখনও কোথাও যাওয়া হয়নি, কতশত ইচ্ছের মুখে বাঁধ দিয়ে যে চলেছি একদিন সুখের দেখা পাবো বলে! ছেলেমেয়ে আর সংসারের বন্ধনে দিন দিন শিকড় বেড়েছে কেবল, আর আমার আমিকে আমি একদম হারিয়ে ফেলেছি। দিনশেষে আপন দূরে থাক, কেউই বোঝেনি আমাকে।

শুনেছি পানি সবসময় নিচের দিকেই গড়ায়, তাই আফসোস হচ্ছে না একদমই। যে যা করবে সেটাই জীবনে ফেরত আসবে, তবে মূল্যহীনতার বোঝা হয়ে আমি আর এখানে পড়ে থাকতে চাই না। বহুকাল ধরে খোলসে বন্দী হয়ে আছি, এখন সময় হয়েছে খোলস ভেঙ্গে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে উড়ার। কারও জন্যে নয়, নিজের জন্যই খোলসটা ছাড়া দরকারি আসলে।

ফাহমিদা খানম
২৫/১১/২০২২

শেয়ার করুন: