সৌদি আরবে হ্যালোইন উৎসব!

ফারদিন ফেরদৌস:

চরম রক্ষণশীল সৌদি আরব তুমুল রেজারেকশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কে জানত সৌদিতে মুভি, থিয়েটার, কনসার্ট, নারীর স্পোর্টস চালু করা হবে?

আরববিশ্ব এখন বিশ্ব কালচারে নিজেদেরকে এডপ্ট করে নিচ্ছে। সম্প্রতি দুবাইতে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে মন্দির উদ্বোধন করা হয়েছে। ইউএইয়ানরা ইজরাইলির জন্যও দরজা খুলে দিয়েছে। সৌদি এরাবিয়ানরাও জিউয়েসদের সাথে ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে।

এমন বাস্তবতায় গেল শুক্রবার আতশবাজির ঝলকানি, শব্দের ঝংকার (সাউন্ড ইফেক্ট) আর ভুতুড়ে সাজসজ্জার মধ্য দিয়ে সৌদিতে দুইদিনের হ্যালোইন উৎসব শেষ হয়।

আরব নিউজের খবরে জানা যাচ্ছে, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি সৌদি আরবেও এবার উদযাপিত হয়েছে হ্যালোইন উৎসব। এ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দেশটির রাজধানী রিয়াদের বিনোদনকেন্দ্র বুলেভার্ডেতে আয়োজন করা হয়েছিল কস্টিউম পার্টির। ভয়ংকর পোশাক পরার শর্তে এ দুই দিন বুলেভার্ডেতে দর্শনার্থীদের বিনা মূল্যে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে।

‘মৃত আত্মাদের স্মরণে’ প্রতিবছর অক্টোবরের শেষে ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে হ্যালোইন উৎসব হয়। তবে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে এর আগে এ উৎসব দেখা যায়নি।

সৌদি আরবে এমন উৎসব আয়োজন করায় খুশি অংশগ্রহণকারীরা। তাঁরা বলছেন, এ অনুষ্ঠান নিছকই বিনোদন।

উৎসবে উত্তর আমেরিকার পৌরাণিক প্রাণী ওয়েন্ডিগোর আদলে একটি পোশাক পরে এসেছিলেন নিজ দেশে প্রথম হ্যালোইন উদযাপনকারী আবদুল রহমান। আরব নিউজকে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, এটি বিশাল এক উদযাপন, এটি আমাদের মনে প্রশান্তি তৈরি করে। এটি হারাম নাকি হালাল, তা আমার জানা নেই। কেবলই আনন্দ লাভের জন্য আমরা এ উৎসব উদযাপন করছি। আর কিছু নয়।’

খালেদ আল হারবি নামের অপর এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের মনে কী আছে, তার ওপর ভিত্তি করেই কর্ম নির্ধারিত হয়। আমি নিছক মজা করার জন্য এখানে এসেছি।’ আল হারবির সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যরাও উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যদের কেউ পরেছেন রক্তাক্ত চিকিৎসকের পোশাক, আবার কেউ রক্তাক্ত নার্সের পোশাক পরে এসেছিলেন। আল হারবির কোলে ছিল পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য। দুই বছরের শিশুটির পরনে ছিল ডাইনির পোশাক।

সৌদি আরব তাদের পুরনো খোলস ভেঙ্গে বিশ্বমানুষ হয়ে ওঠবার পথে দুর্বার যাত্রা শুরু করেছে। এতদিনকার অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় প্রথা বা আচারের কড়াকড়ি ব্রেকডাউন করে দিচ্ছে। নারীর ভোটাধিকার, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ স্বামী কিংবা বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধজন বা মাহরাম ছাড়া একা চলবার অনুমতি এমনকি হজে অংশগ্রহণের অনুমতিও দিয়ে দিয়েছে। দুই পবিত্র মসজিদ ও কা’বা শরীফের ভবিষ্যত কাস্টডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমান ধর্মীয় সংস্কারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। এমনকি জিউয়েসদের জন্য হিব্রু ভাষায় আলাদা কুরআন প্রণয়নের কথাও বলেছেন!

বিস্ময়কর সত্য হলো, আমাদের দেশজ অতি ধর্মাচারিরা এসব বিষয় নিয়ে ‘টুঁ’ শব্দটি করে না! তাদের আলাপ কেবল পহেলা বৈশাখ আর নারীর অবগুন্ঠনে ঘুরপাক খায়! কথাগুলো আজকালকার বাঙালি ধর্মাচারিদের মনে করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো তাদের কেউ কেউ কথায় কথায় বলে বাংলাদেশ সৌদি আরব না! অথচ বিপুলসংখ্যক আরবভক্ত মানুষ আমাদের ধর্মীয় আঁতুড়ঘর সৌদি আরবের নাম জপে সেকেন্ডে সেকেন্ডে জল পান করে।

এই জনগোষ্ঠীটা পহেলা বৈশাখ এলে নানামুখী ধর্মীয় গসিপের ভাণ্ড খুলে বসে। হারাম হারাম বলতে বলতে এদের নিজেদের জীবনসহ আশেপাশের সবার জীবন বিষিয়ে তোলে। তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার তুল্যমূল্যে হ্যালোইনের ভুত বা ডাইনিবিলাস কি অধিকতর উচ্চমার্গীয়?

দেশি বা বিদেশি সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে জীবনকে নানা উপায়ে উদযাপন ও শুদ্ধ তরিকায় আনন্দ খুঁজবার রিচ্যুয়াল বা কৃত্যের বন্দনা আমরা করি। তাই সৌদি আরবের হ্যালোইনে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। যেমন মত-ভিন্নমতের বা পক্ষ-বিপক্ষের কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়, আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, ভাই ফোঁটা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মেরি ক্রিস্টমাস ডে, হ্যালোইন কিংবা ঈদ উৎসবে।

আমরা আপত্তি করি বোধের অন্ধত্বে।
আপত্তি করি বেহেশতের টিকেট সেলিং-এ।
আমরা ঘোরতর আপত্তি করি ধর্মের অনৈতিক সওদাগরিতে।

হ্যাপি হ্যালোইন!

লেখক: সাংবাদিক
৩১ অক্টোবর ২০২২

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.