ইডেন, স্টিগমা ও ভিক্টিম ব্লেইমিং এর কালচার

সুমিত রায়:

ইডেন বা অন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নগ্নচিত্র যখন ছাত্রলীগের মেয়েরা জোর করে ধারণ করে (ভবিষ্যতে কাজে এগুলোকে ব্যবহার করে এদেরকে সেক্স স্লেইভ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে বলে) তখন এই ছবিগুলোতেও মেয়েরা ভিক্টিমই। কিন্তু এদেরকে এগুলো দিয়ে ভয় দেখানো যায় কেননা ছবিগুলো প্রকাশ হলে মানুষ এদের এই ভিক্টিমহুডের কথা ভেবে এদের সাথে এমপ্যাথাইজ করবে না, এদের উপর নিপীড়নকারী ছাত্রীদেরকে প্রতি ক্রুদ্ধ হবে না, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে না, বরং ভিক্টিম ব্লেইমিং করবে, এই ভিক্টিমদের ওপরেই দোষ চাপাবে। কারণ নারীর যৌনতা নিয়ে সমাজের স্টিগমা বা কলঙ্ক, নগ্নতা ও এর প্রকাশ মানে ‘সতীত্ব’ হারানো, আর যারা ‘তা’ হারায় তারা সবসময় কলঙ্কিত। আর সেইসাথে জাস্ট ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস থেকে আসা ভিক্টিম ব্লেইমিং আছেই, ‘নিশ্চয়ই এরা আগে থেকেই খারাপ, অসতী, তাই এদের নিয়ে এসব হচ্ছে’, টাইপ ভাবনা। যারা এদের জোর করে এই স্লেভারির কাজ করালো, তারা ভালো করেই জানে যে এদের নিয়ে এই স্টিগমাটাইজেশন ও ভিক্টিম ব্লেইমিং হবে, আর এই সুযোগকেই তারা ব্যবহার করে বা করতে পারে।

এরপর এই মেয়েরা বাধ্য হয়ে সেক্স স্লেভারি করলো। অনেকেই এই মেয়েদের বাধ্য হয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়া বা সেক্স স্লেভারির কাজকে ‘বেশ্যাবৃত্তি’ বলছেন। কিন্তু এটা বেশ্যাবৃত্তি কী করে হয়? এরা কি টাকার বিনিময়ে যৌনতায় যাচ্ছে? টাকার বিনিময়ে কনসেন্ট দিচ্ছে? এটা কি “বৃত্তি” হচ্ছে? এরা যেটা করছে তা কি সার্ভিস দেয়া হচ্ছে? সার্ভিসের তো একটা অর্থমূল্য থাকে। স্পষ্ট অর্থে এটা সেক্সুয়াল স্লেভারি বা যৌন দাসত্বই, যেখানে বাধ্য হয়ে ধর্ষণের শিকার হতে হয়, যৌনতায় অংশ নিতে হয়, বেশ্যাবৃত্তি তো এর চেয়ে অনেক সম্মানের কাজ। তো যাই হোক, সেক্সুয়াল স্লেভারির কাজ করার মতো জঘন্যভাবে ভিক্টিম হয়েও এই মেয়েরা তা প্রকাশ করতে পারলো না।

ছাত্ররাজনীতিতে এখন আর ছাত্রলীগের রাইভাল বলে কিছু নেই। যখন রাইভাল ছিল তখন এরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয় পেত, কারণ একসাথে সাধারণ ছাত্র ক্ষেপলে টেকা মুশকিল। কিন্তু এখন রাইভাল নেই, তারা ধীরে ধীরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আধিপত্য তৈরি করা শুরু করে। আবরারের মতো শিক্ষার্থীরা এই আধিপত্য ও নিপীড়নের এক্সট্রিম কিছু ভারশনের শিকার হয়, তখন এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, নাহলে সব ধামাচাপা থাকে, কারণ বলার মতো কেউ নেই। ৫-৬ বছর আগে ঢাবির ছাত্রী হলে ছাত্রলীগের মারামারির সময় এরকম কিছু ঘটনা কানে এসেছিল, কিন্তু ধামাচাপা পড়ে যায়, মেইনস্ট্রিম নিউজেও আসেনি। কিন্তু এবারে এলো, কারণ একজন ছাত্রলীগ নেত্রীই সব প্রকাশ করেছে। রাইভালরিবিহীন দাপটে বোধ হয় এসব প্রকাশ্যে আসার এই একটাই উপায়, ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে রাইভালরি… দুর্ভাগ্য! তো শেষ পর্যন্ত তা ভালভাবেই ফাঁস হলো, আর মেইনস্ট্রিম নিউজ মিডিয়াগুলোতেও এলো। কিন্তু এর পর কী হলো? মানুষ কি এবারে এই ভিক্টিমদের সাথে এম্প্যাথাইজ করলো? নাহ…

প্রথমত দেখলাম, শাকেরা না শাকুরা নামের একটা ফেইক বা রিয়াল আইডি থেকে ইডেনের মেয়েদের ওপর ছাত্রলীগের নিপীড়ন নিয়ে লিখলো, কিন্তু সোশ্যাল কনজারভেটিভদের থেকে যেরকম এক্সপেক্ট করা যায় আল্টিমেটলি তাই হয়েছে। পুরো ন্যারেটিভের মূল বক্তব্য ছিল এই যে, ইডেনের মেয়েদের ‘সতীত্ব’ থাকে না। আর বলা হলো, যারা এভাবে জোর করে “বেশ্যাবৃত্তিতে” যায় না, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই নিজের উদ্যোগে অন্য ছেলেদের সাথে যৌন সম্পর্কে যায়। আর এসবের কারণে ইডেনের মেয়েদের বেশিরভাগেরই ‘সতীত্ব’ বলে কিছু থাকে না, এরা সবসময়ই খারাপ… ইত্যাদি।

এখানে হালকার ওপর দিয়ে নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে বলা হলো ঠিকই, কিন্তু এর চেয়েও বেশি প্রভাবশালী মেসেজটা ছিল এই যে, ইডেনের মেয়েদের ‘সতীত্ব’ থাকে না, এই সতীত্বহরণে যেহেতু ছাত্রলীগের একটা অবদান আছে, তাই তারা দোষী, কিন্তু সাধারণ মেয়েরাও দোষী, আর ভিক্টিমদেরও এতে দোষ আছেই। এই আইডি হয়তো লীগের রাইভাল অংশের পলিটিক্সের সাথেই জড়িত। কিন্তু ওই সোশ্যাল কনজারভেটিভ অবস্থানের জন্য তাকে লীগের দোষ দিতে হলেও সেটা দিতে হচ্ছে এই সতীত্ব নিয়ে স্টিগমাটাইজেশন, ভিক্টিম ব্লেইমিং এর সোশ্যাল ফেনোমেনাকে ইউজ করেই। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, একপক্ষ যেখানে সোশ্যাল স্টিগমা, ভিক্টিম ব্লেইমিংকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন করছে, অন্যপক্ষ সেখানে এগুলোকে ব্যবহার করেই প্রতিবাদ করছে, আর ভুক্তভোগী সেই সাধারণ ছাত্রীরা, যাদের ভিক্টিমহুডকে ব্যবহার করে এসব আধিপত্য, রাজনীতি চলছে।

এই খবর প্রকাশ হবার ফলে সামনে আসা দ্বিতীয় ইফেক্টটা ছিল, পুরো ইডেনের শিক্ষার্থীদের ওপর আসা স্টিগমাটাইজেশন। কোন মেয়ে বাসে করে ইডেনের সামনে নামলেই তাদের দিকে সবাই চেয়ে থাকে, ইডেনের মেয়েরা খারাপ, বেশ্যা, অসতী, এদের বিয়ে করা যাবে না এসব কথা ছড়িয়ে পড়ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এখানেও ওই একই স্টিগমাটাইজেশন ও ভিক্টিম ব্লেইমিং। ইডেনে ভিক্টিম হওয়া মেয়ের সংখ্যা অল্প হলেও ইডেন নামটা যেহেতু জড়িয়ে আছে, তাই স্বাভাবিকভাবে আশা করা যেত এই ইডেনের শিক্ষার্থী পরিচয়ওয়ালা যেকোনো মেয়ের প্রতি মানুষ সিম্প্যাথি দেখাবে, ইডেনের সব শিক্ষার্থী নিয়ে যদি জেনারালাইজেশন হয়ও তাহলে তাকে ইতিবাচকভাবেই ব্যবহার করা যেত, সেই পরিচয় হতো প্রতিবাদের ভাষা। ইডেনের সব মেয়ে চিৎকার করে বলতো, “হ্যাঁ, আমি ইডেনের শিক্ষার্থী, আমি ভিক্টিম”, আর এভাবে তারা ভিক্টিমদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতো।

কিন্তু, না। এখানেও সেই স্টিগমাটাইজেশন, ভিক্টিম ব্লেইমিং, কারণ সেই যৌনতা, সেই সতীত্ব। ইডেনের শিক্ষার্থী পরিচয় মানুষের কাছে আর সিম্প্যাথি তৈরি করছে না, বরং তৈরি করছে ঘৃণা। আর এজন্য কোন আবেগ কাজ করছে না, প্রতিবাদ হচ্ছে না। হ্যাঁ, যারা নিপীড়ন করতো, তারাও জানতো এরকমটাই হবে, আর এটার জন্যই তারা এরকমটা করতে পেরেছে। সফল হয়েছে।

এখন আমাদের দেশে বিচারব্যবস্থা কেমন তা মোটামুটি সবার জানা, এইসব কেইসে বিচারের ফল অনেকক্ষেত্রেই প্রতিবাদ, চাপ এসবের উপর নির্ভর করে, যখন অপরাধী ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে জড়িত। আর যেখানে এই স্টিগমাটাইজেশন, ভিক্টিম ব্লেইমিং এর জন্য প্রতিবাদই নেই, এম্প্যাথাইজিং নেই, সেখানে কীসের তদন্ত, কীসের বিচার, কীসের শাস্তি। আমি খুবই সন্দিহান এই নিয়ে যে আসলেই কোন বিচার হয় কিনা, হয়তো ধামাচাপাই পড়ে যাবে।

ঠিক এই জায়গায় আরেকটা জিনিস দেখা গেছে। ইডেনের ছাত্রীদের যেখানে ভিক্টিমদের সাথে আত্মিক হয়ে, আমরা সবাই ভিক্টিম – টাইপ প্রতিবাদী ভাষা ব্যবহার করার কথা ছিল, সেখানে স্টিগমাটাইজেশনের জন্য তারা এটা করতে পারছে না, আগেই বলেছি। দেখা গেছে, এখন তারা উলটে এটা জোর দিয়ে বলছে, এই ভিক্টিমের সংখ্যা খুব কম, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সবাই এরকম না, এসব জেনারালাইজ করা উচিৎ না… ইত্যাদি।

যারা ছাত্রলীগের এইসব কাজের প্রতিবাদ করছিল তারাও এখন বলছে সতর্ক হবার জন্য যাতে এতে সব সাধারণ ছাত্রীদের ক্ষতি না হয়। কিন্তু কেন স্পষ্ট করে বলতে হবে যে সব ইডেন শিক্ষার্থীই ভিক্টিম নয়? একেবারে সব শিক্ষার্থীর এরকম ভিক্টিম হওয়া তো অস্বাভাবিক, কিন্তু যাদের সাথে হয়, তাদের জন্যই সবাইকে এক হতে হয়, ভিক্টিমদের সাথে রিলেট করতে হয় সবাইকে, সবাইকে পাশে দাঁড়াতে হয়। এই অবস্থায়, জেনারালাইজেশন করা যাবে না টাইপ কথাই প্রতিবাদকে দুর্বল করে, ভিক্টিমের সাথে রিলেট করাকে আটকায়। সমাজে থাকা সতীত্ব কলঙ্কায়নকে, ভিক্টিম ব্লেইমিংকে ব্যবহার করেই ছাত্রলীগ এই নিপীড়ন চালিয়েছে। আর এগুলোকে ব্যবহার করেই এর প্রতিবাদকেও ডেটার করা হবে, যা এখন করা হচ্ছে। তারা সফল এই কাজে। ছাত্রলীগের এই সেক্সুয়াল স্লেভারি আর এই কলঙ্কায়ন ও ভিক্টিম ব্লেইমিংকে আলাদা আলাদাভাবে দেখা যাবে না। একটাকে বাঁচিয়ে আরেকটির প্রতিবাদ করা যাবে না। দুটোই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এখানে এই স্টিগমা ও ভিক্টিম ব্লেইমিং-ই এই সেক্সুয়াল স্লেভারির পুনরুৎপাদন করছে। দুটোর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করতে হবে।

এটাই একটি উদাহরণ যা দেখায়, কীভাবে সোশ্যাল লিবারালাইজেশন ও পলিটিক্যাল লিবারালাইজেশন একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। কীভাবে সোশ্যাল কনজারভেটিভ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক অধিকারকে আটকে দিয়ে মানুষকে বিভিন্নভাবে শোষণ করে। এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে একই সাথে দুটোর বিরুদ্ধেই বলতে হবে। যেসব ইডেন ছাত্রী এখন স্টিগমাটাইজেশনের সংকটে ভুগছে, তারা যদি নিজেদের এই স্টিগমার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে এই স্টিগমা আর ভিক্টিম ব্লেইমিং এর বিরুদ্ধেই অবস্থান নিতো, তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো, আর ছাত্রলীগ বা অন্য কোন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীও একে ব্যবহার করে নিপীড়ন চালাতে পারতো না, সাধারণ শিক্ষার্থী আরও বেশি প্রতিবাদী হয়ে এই গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য ভেঙ্গে দিত…।

শেয়ার করুন: