রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়েরই খণ্ডচিত্র দেখছি ইডেন কলেজে

নাদেরা সুলতানা নদী:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন পড়তে আসি (শিক্ষা বর্ষ ৯৫/৯৬), বলতে দ্বিধা নেই তখন আমার পরিবার রীতিমত এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি। আমি এবং আমার পারিবারিক বৃত্তান্ত যা তাতে আমার মতো কারও ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অনেকটাই অবিশ্বাস্য।

তারপরও হাতে এলো ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘কালবেলা’, ‘গর্ভধারিণী’, ‘দূরবীন’ এর মতো বেশ কিছু বই, পড়ে ফেললাম এবং আমি সরাসরি যুক্ত হই ছাত্র রাজনীতিতে দিন বদলের স্বপ্ন নিয়ে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সময়টা কাটিয়েছি, মিছিল মিটিং এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক এক বলয়ে। যদিও আমার রাজনৈতিক দর্শন জীবনের এ বেলা পর্যন্ত ভেতরে থাকলেও জীবনযুদ্ধে আমি হেরে যাওয়া এক মানুষ হয়েই ক্যাম্পাস ছেড়েছি! মিছিলে হাঁটা নানান লড়াই সংগ্রামে মুখর থাকা আমি একটা সময় পর সব গুটিয়ে নিজেই বেছে নেই জীবনের নূতন ঠিকানা।

এই ভূমিকা আজ কেন? নিজের সময়ের স্মৃতিচারণ এলো মনে সময়ের ছাত্র রাজনীতির নামে অভিনব সব অপরাধ চিত্র দেখে। দেখছিলাম ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ এর সক্রিয় কতিপয় ছাত্রী কর্মীদের কর্মকাণ্ডের নানান খবরাখবর এবং তাদের নানামুখী প্রকাশ বা প্রতিবাদ।

৯০ এর পরের সময়কে দেখা বিশেষ করে তারুণ্যের নিশ্চয়ই জানা আছে বড় দুটো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে থাকা ছাত্র রাজনীতি মানেই তার সাথে সকল সময়ই জড়িয়ে ছিল যে ইতিহাস তার সাথে ভীষণ করে আছে অস্ত্র, বোমা, এবং ক্ষমতায় থাকা না থাকাদের অলিখিত এক যুদ্ধের ইতিহাস। তখন থেকেই এই বাংলাদেশ দেখে আসছে বিশেষ করে সরকার ক্ষমতায় থাকা সময়ের সরাসরি যুক্ত ছাত্র দলটির দাপটের নানা চিত্র! ক্ষমতাধারীদের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় অপকর্মের ধরন আমাদের কিছু জানা, অনেক কিছুই থাকে অজানাও।

৯০ এর পরপর মিডিয়ায় ভীষণ করে যা আসতো তা হচ্ছে এই ইডেন কলেজেই সেই সময়ের এক ছাত্রীনেত্রীর অস্ত্র বহন করার বিষয়টা। নিজের জীবনের একটা ছোট অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। সেই সময়ের ইডেনে থাকা এক ছাত্রদল নেত্রী, শাওন না কী যেন নাম। আমার সাবজেক্ট ‘দর্শন’ এরই ছাত্রী ছিল সে। আমার সাথে কেউ একজন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মধু’র রেস্তোরায়, নোটের জন্যে। সেই সময় আমি নিজেই আমার কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে নোট ধার নিতাম। পরীক্ষার আগে কোনভাবে পড়ে হলে যেয়ে পরীক্ষা দিতে বসতাম। সেই মানুষের কাছ থেকে সেই নেত্রী রুমে এসে নোট নিয়ে গেলো কদিনের জন্যে। কপি করে আবার ফেরত দিয়ে যাবে এই আশ্বাসে। কিন্তু গেল তো গেলোই, আমার সেই নোট আর কিছুতেই আমার হাতে এলো না। একদিন সাতসকালে সেই ইডেন হোস্টেলে যেয়ে হাজির হলাম এবং যথারীতি তাকে পেলাম না। অনেক ঘুরেও আমার নোট আর উদ্ধার করা গেলো না। আমি যে কতোটা ভুগেছি সেই গল্প আজ আর না করি। কাছের বন্ধুরাও আমার উপর যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিল এই ঘটনায়, কেন আমি এমন নেত্রীকে বিশ্বাস করলাম!

এই স্মৃতিটা আবার আজ মনে পড়লো, কারণ ক্ষমতায় থাকা বড় দুটো দলের মাঝে সবসময়ই দেখেছি একটা শ্রেণী সবসময়ই বুঝিয়ে দেয় যে তারা যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা রাখে। কারণ আমার অভিজ্ঞতায় দলের মাঝে যে চর্চা তাতে এই নীতি নৈতিকতার বিষয়গুলো ওভাবে ধর্তব্যের মাঝে তখনও ছিলো না, এখনও নেই।

আমি আমার সময়টাতে অনেকবার স্লোগান ধরেছি, ‘অস্ত্র, শিক্ষা একসাথে চলে না’ বলেছি ঘৃণা নিয়ে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে। জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রনেতা মানিকের নাম যখন উঠে এলো রেপিস্ট হিসেবে, আমরা সকল ছাত্র রাজনীতিতে থাকা দল, মতের, হলের, এবং সাধারণ ছাত্রী প্রতিনিধিদের নিয়ে নেমেছি একসাথে প্রতিবাদে। তখন এমনও দেখেছি সকলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকলেও সেই সময়ে ছাত্রলীগে জড়িয়ে থাকা ছাত্রীরা সবাই দলীয় পতাকার বাইরে এসে আমাদের সাথে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারেনি অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে কন্ঠ ছেড়ে সবটকু স্পর্ধা নিয়ে!

অনেকবার দেখেছি বিশেষ ঐ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আমাদেরই ভাইবোন সহপাঠিদের নানান অন্যায় অবিচারের কাছে নতি স্বীকার করতে। দেখেছি কেমন করে তারা পুতুল হয়ে নাচে অদৃশ্য বা দৃশ্যমান সুতোর টানে।

ক্ষমতা বলয়, এ এক নেশা… বোধ, বিবেচনা, হৃদয়, মস্তিষ্ক সবই হয়ে যায় অন্ধ। দেখাতেই হবে আমি বা আমরা আছি কতোটা উপরে…। মূলত এই ক্ষমতা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা ছেলেদের কর্মকাণ্ড নানান সময় মিডিয়ায় উঠে এলেও মেয়েদের এই বিষয়টিতে সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল অনেকটাই কম!

কিন্তু একটা সময় পর এই বিশ্বাসকে টেনে হিঁচড়ে, চেয়ার নিয়ে ধাওয়া দিয়ে ছুটিয়ে দিচ্ছে বাংলার কিছু মেয়ে এবং আমি অনেকটাই নিশ্চিত এমন মারমুখো হওয়াটা ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত থাকা ছাত্র রাজনীতির অন্যতম পরিচয় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যে পরিচয় নিয়ে আজকের ছাত্রনেতা কাল বড়নেতা হয়েও উঠতে পারে!!

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত এবং হতাশ মন নিয়ে যা বলতে চাই, এই সময়ের ইডেন কলেজের যে চিত্র আমাদের সামনে উঠে এলো তা আমাদের এই সময়েরই সামাজিক অবক্ষয় এবং ছাত্র রাজনীতির নামে করা অপকর্মের খণ্ডচিত্র।

দলের নীতি নির্ধারকরা এই বিষয়টা সামাল দিতে আরও কোন গোঁজামিল নিয়ে আসেন কিনা আমাদের সামনে, তা দেখার বিষয়। ছাত্রলীগের একটা ইতিহাস আছে। নানান গৌরবের সাথে জড়িয়ে আছে কোন না কোন নাম। এক সময়ের ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী পরবর্তিতে আওয়ামী রাজনীতিতে জড়ানো যাকে ভালোবেসে নাম দেয়া হয়েছিল ‘অগ্নিকন্যা’, আমি জানি না এই সময়ে এসে আছে কিনা এমন ছাত্রী প্রতিনিধি এই দলটিতে! অন্য হিসেবের বাইরে যে অভিযোগগুলো উঠে এলো তাতো অনেক বেশি লজ্জার এবং কষ্টের, তার তদন্তে কী উঠে আসে বা নিজের দলের মাঝের শৃংখলাভঙ্গের দায়েই বা কী উদ্যোগ নেয় ছাত্রলীগ নেতৃত্ব, তা দেখার জন্যে আমি অপেক্ষায় রইলাম।

তবে যে কথাটা বুকের ভেতর থেকে উচ্চারণ করতে চাই, আপনারা যারা বিশ্বাস করেন এই সময়ে ইডেনে পড়া সকল মেয়েরাই কেবল কোন না কোন ছাত্র সংগঠনকেই রিপ্রেজেন্ট করে, আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, এই কলেজে পড়া অনেক মেয়ে আছে, আমারই মতন যে বা যারা স্বপ্ন দেখে পড়ালেখা শেষ করে সংসারের দায়িত্ব নেবে, মা বাবার পাশে আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবে।
আমি বিশ্বাস করতে চাই কিছু ঝকঝকে চিন্তার সুস্থ সুন্দর মেয়ে আছে এই কলেজেই, যে তারুণ্য মাথা উঁচু করে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে গাইতে চায় জীবনের গান। অবশ্যই নয় কোন কালো রাজনীতির নোংরা খেলায় মত্ত হয়ে ভুল সুরে বেসুরো গান!

যে কথাটায় আজকের এই প্রতিক্রিয়ার ইতি টানবো, আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু-স্বজনদের অনেক বেশি মুখ সেই ৯০ থেকে এই সময় পর্যন্ত সরাসরি ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত। তাঁদের সাথে আমার আন্তরিক হৃদ্যতা আছে, আছে দ্বিমতও। আমি যা বলছি আমি জানি আমার কাছের মানুষেরা ঠিক তা বুঝে নেবে, পারবে ঠিক মেসেজটা উঠিয়ে আনতে। অস্বীকার করবে না যেটুকু দায় তাঁদের আছে!

বিশ্বাস ফেরাতে চাই, তারুণ্য ঘুরে দাঁড়াবে, ইডেনসহ বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
তারুণ্য মানে তো আমাদের ৫২, ৬৯, ৭১… ৯০।
তাহলে কেন ২০২২ নয়?!

নাদেরা সুলতানা নদী
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.